শ্যামসুন্দরের দুটি ফোন – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

শ্যামসুন্দরের দুটি ফোন  (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

— তার মানে আপনি রোগী আর রোগীর বাড়ির লোকের মুস্কিল আসান।
দু হাতের দুটো ফোন নাচাতে নাচাতে শ্যামসুন্দর বলে, সে আপনে বুলতে পারেন দাদা। কতাটা খানিকটা ঠিকই। আমার সঙ্গে এলে পেসেনট পাটির কুনো চিন্তা নাই। সব দায় আমার। আপনে আমার অ্যাকাউন্টে টাকা ঢেলে দিয়ে নিচচিন্তে বসে থাকুন। থোক টাকাও হাতে দিতে পারেন। সে আপনের ইচ্চে। রোগী আপনের বাড়ি থেকে তুলবো আবার ঠিক সময়ে ফিরিয়ে দেবো। সমস্ত খরচের খাঁটি হিসেব পেয়ে যাবেন। দুনম্বরীর কুনো ব্যেপার নেই দাদা। পেরাপ্যটুকু ছাড়া এক পয়সা বেশি নেব না। কথাগুলো গড়গড় করে বলে থামলো শ্যামসুন্দর, গেরাম গনজে কতো মানুষ আচে দাদা, লোকের অভাবে বাইরে টিটমেন করাতে আসতে পারে না। অথচ টাকা পয়সার অভাব নাই তাদের।

অদ্ভুত পেশা শ্যামসুন্দরের। রোগী নিয়ে চেন্নাই, ব্যাঙ্গালোর আরো কোথায় কোথায় যায়। সঙ্গে থাকা রোগীর সব দায় দায়িত্ব শ্যামসুন্দরের।

আজ রবিবার। হাসপাতাল বন্ধ। চিকিৎসার জন্য ভিন রাজ্যে এসে আর অন্য কাজ কিই বা থাকে। কাজেই সারাদিন হোটেলেই বন্দী রাখতে হবে নিজেকে। ঘরের সামনে চেয়ারে বসে ছিলাম। দাদা কুতা থেকে আসচেন? বলে আমার পাশের চেয়ারে এসে বসে শ্যামসুন্দর। তারপর কয়েক মিনিটের মধ্যে নিজের সম্পর্কে নিরেট নিটোল একটি ভূমিকা শুনিয়ে দিল আমাকে। টুকটাক কথাবার্তা এগিয়ে চলেছে। সেই সময় আমার ঘরের ঠিক পাশের ঘর থেকে ডাক আসে, ” শ্যামসুন্দর।”
উঠে দাঁড়ায় শ্যামসুন্দর। আপনে বসেন দাদা, কত্তা ডাকচে। দেকি। মনে হয় বাতরুম যাবে।
কিছুক্ষণ পরে ফিরে আসে শ্যামসুন্দর। জিজ্ঞাসা করি, বয়স্ক লোকটি…। আমার কথা মাঝ পথেই থামিয়ে দিয়ে শ্যামসুন্দর বলে, আপনে কত্তার কতা বুলচেন? উনি হলেন গিয়ে..। অনাদি ব্যানার্জী। বয়স প্রায় আশি। শ্যামসুন্দরের পেশেন্ট পার্টি। ছেলে ব্যবসা করে। পয়সা কড়ির অভাব নেই। বাবাকে পাঠিয়ে দিয়েছে শ্যামসুন্দরের সঙ্গে।
গিন্নির শরীর ভালো নেই দাদা বুইলেন। তবুও এয়েচি। কত্তা আমার নিজের গেরামের লোক দাদা। বিপদে পড়েচে। আসতেই হয়।
— বাহ, এক্কেবারে চেনা লোক সঙ্গে নিয়ে এসেছেন দেখছি।
— পোবলেম তো সেকেনেই দাদা। পোবলেম সেকেনেই। ঘাড় দুলিয়ে বলে শ্যামসুন্দর। পেসেনট একেবারে চেনা লোক হলে ঝক্কি অনেক বেশি নিতে হয়। মুকের ওপর না বলা চলে না। তারপর ধাত বুজে কতা কইতে হয়। কত্তার বেলায় আমার তাই হয়েচে দাদা। সামলাতে গিয়ে আমার হাল শোচনীয়। পরশু দিন থেকে এমন ফেঁসে গেচি কি বলবো। একন মানুষটাকে নিয়ে দেশে ফিরবো কি ভাবে তাই ভাবচি।
— কেনো? কি সমস্যা?
আমার কানের পাশে মুখ নিয়ে এসে নিচু স্বরে বলে, কি বলি দাদা, আসলে পরশু…। আমার প্রশ্নের উত্তর অসম্পূর্ণ রয়ে যায়। শ্যামসুন্দরের ফোন বেজে ওঠে। তাড়াতাড়ি করে ডান পকেটের ফোনটা বের করে। দেখে সেইটির কোনো সাড়া শব্দ নেই। সঙ্গে সঙ্গে ফোন ডান পকেটে রেখে দিয়ে বাম পকেটের ফোনটা বের করে। হ্যাঁ, বাজছে। বিরক্তির সুরে বলে, কোন ফোনের বাঁশি যে ককন বাজে বুইতে পারি না দাদা। বোতাম টিপে ফোন ধরে শ্যামসুন্দর। কথা বলে। বাড়ি থেকে ছেলে ফোন করেছে। স্ত্রীর শরীরের খবর নেয় শ্যামসুন্দর। কথা শেষ হতেই আগের কথার সূত্র ধরিয়ে দিই আমি। জিজ্ঞাসা করি, অনাদি বাবুর সমস্যা কি?
— মাতার পোবলেম দাদা। আজকের নয়। রোগ অনেক দিনের। মাতা গপ গপ করে। মেজাজ তিরিক্ষি। কতা মনে রাকতে পারে না। ধরেন এবেলা দেকা হলো আপনের সঙ্গে। বিকেল বেলায় সব ঘেঁটে ঘ। কিচুই মনে নেই। আবার যকন যাকে মনে পড়ে তকন তার কতা বলে বলে মুকে ফেনা কাটিয়ে ফেলবে। সে বায়না সামলানো খুব মুসকিল দাদা। খুব মুসকিল। এই দেকেন, কাল রাত থেকে গিন্নি মায়ের কতা মাথায় এয়েচে। ব্যস। সে যে কি যন্ত্রণা আমার ঘাড়ে চেপেচে বোজাতে পারবো না দাদা বুইলেন। গতকাল রাতে শুয়ে রয়েচি। আমাকে ঘুম থেকে তুলে বলে তোর গিন্নিমাকে ফোন কর। কি বিপদ। গিন্নিমাকে আমি কোথায় পাই। আমি যতো বলি রাতের বেলায় খামোকা ঝেমেলা বাড়িয়ে লাভ নেই। সবাই ঘুমচ্চে। ইদিকে কত্তা নাচোড়। বলে, বাড়ির মানুষ বাইরে রয়েচে আর ওরা নিচচিন্তে ঘুমাবে। তুই ফোন কর। বলে কত্তা…।
— তারপর?
— তারপর আর কি দাদা। কত্তা তো নিজে ফোনে কতা বলা পচন্দ করে না। মানে ভয় পায়। বোজেন তো। পুরোনো লোক। বলে এই বয়সে কানের পাশে ফোন ধরলে কান নষ্ট হবে। বাকি জীবন কালা হয়ে থাকতে হবে। সে নিয়ে বাড়িতে মাজে মদ্যেই অশান্তি হয়। কোথায় গিয়ে বসে থাকে, সঙ্গে ফোন নেই। খোঁজ খোঁজ। যাইহোক, অত রাতে ফোনে…। কথা শেষ করবার সুযোগ হয় না শ্যামসুন্দরের। অনাদি বাবু হাঁক পারে আবার, “শ্যামসুন্দর।”
— দেকেচেন দাদা। তিসটোতে দেয় না। ঘরে যায় শ্যামসুন্দর। অনাদিবাবুকে বাইরের চেয়ারে এনে বসায়। বলে, ঘরে বসে আচেন নাগাড়ে। ভালোলাগবে কেনে। বসেন একেনে। রাস্তার গাড়ি ঘোড়া দেকেন। আপনের মত মানুষ বলেই সারাদিন ঘরে বসে আচেন। নয়তো…।
— থাক থাক। থাম তুই। বড্ড বাজে কথা বলিস। শান্তিতে বসতে দে। চেয়ারে বসে অনাদিবাবু। চেয়ে থাকে রাস্তার দিকে। মুখের প্রত্যেক ভাঁজে বিরক্তির বর্ণ স্পষ্ট। অনাদি বাবুর জিজ্ঞাসু দৃষ্টি বেশ কয়বার ছুঁয়ে গেছে আমাকে। ওদিকে শ্যামসুন্দরের মুখে কৃত্রিম হাসি। অনাদিবাবুকে খুশি করতেই নকল হাসির প্রয়াস। আমাকে দেখিয়ে বলে, দাদা আমাদের দেশের লোক কত্তা। খুব ভালো মানুষ। টিটমেনের জন্যে এয়েচে।
শ্যামসুন্দরের কথা শুনে ভাবান্তর হয়না অনাদিবাবুর। আমাকে আরো একবার দেখে নিয়ে মুখ ফিরিয়ে বসে থাকে। মুখের বিরক্তির মেঘ জমাট হয় আরো।
— জোয়ান দে, বলে অনাদিবাবু।
— এই যে দিই কত্তা। ‘শ্যামা মা টি আমার কালো’ , গুন গুন করে শ্যামা সঙ্গীত গাইতে গাইতে পাঞ্জাবির পকেট থেকে জোয়ানের শিশি বের করে শ্যামসুন্দর। শিশিটা বার কয়েক ঝাঁকিয়ে নিয়ে অনাদি বাবুর হাতে খানকিটা জোয়ান দেয়। নেবেন নাকি দাদা, ভাজা জোয়ান। জিজ্ঞাসা করে আমাকে। না না থাক। একটু আগেই চা খেয়েছি। বলি আমি। নিজের মুখে খানিকটা জোয়ান ঢেলে দিয়ে শ্যামসুন্দর বলে, কত্তার সঙ্গে এই কদিন থেকে আমারও কেমন নেশা লেগে গিয়েচে দাদা। চা পেটে যেতেই জোয়ানের জন্যে টনটন করে জিবটা। তকন জোয়ান না খেলে আনচান করে। নকল হাসির আভা ফিরে আসে আবার শ্যামসুন্দরের মুখে।
— নিজের পয়সায় তো আর জোয়ান খাচ্ছো না। পরের পয়সায় খেতে সবারই ভাললাগে। কাল তুই বাড়ি নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করবি। নয়তো…। অনাদিবাবুর গলায় রাগের ঝাঁঝ ভীষণ।
— টিকিট পেলেই ফিরে যাবো কত্তা। চিন্তা নাই। বলে শ্যামসুন্দর।
— থাম। তুই বড্ড বাজে বকিস। অনাদির ধমক খেয়ে মুখ বন্ধ রাখে শ্যামসুন্দর। আপনে কত্তার কাচে বসেন দাদা। আমি বিছানাটা গোচগাচ করে কত্তার ধুতি আর পাঞ্জাবিটা ধুয়ে দিই। যদি টিকিট কনফারম হয়ে যায় কাল রাতে টেন ধরতে হবে। ঘরে যায় শ্যামসুন্দর।
অনাদিবাবু বলে, হতভাগা এক নম্বরের বদমাইশ। সারাদিন দুটো ফোন নিয়ে আগর-বাগর কথা বলে। কাজের বেলায় নেই। কতদিন হলো নিয়ে এসেছে। বাড়ি নিয়ে যাবার নাম নেই। বলে চিকিৎসা শেষ হয়নি। আজ সকালে বলে কিনা আরো একদিন লাগবে। ওর আর কি। নিজের টাকাটা ঠিক বুঝে নেবে। রাগে গজ গজ করতে থাকে অনাদিবাবু।
কিছু সময় পরে ফিরে আসে শ্যামসুন্দর। বলে, কাল ডাক্তার রিপোটগুলো দেকে মেডিসিন দেবে। ব্যস। কত্তার ছুটি। বলেই ডান পকেট থেকে ফোন বের করে। বাড়িতে একবার ফোন করে নিই। দেখি, ছেলেটা…। ফোনের বোতাম টেপে শ্যামসুন্দর। অনাদি বাবু চেয়ে থাকে শ্যামসুন্দরের দিকে। বলে, সারাদিন শালার কাজ হচ্ছে নিজের বউ আর ছেলেকে ফোন করা। এদিকে আমার খোঁজ নেবার কেউ নেই। যমের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে শান্তিতে আছে আমার বাড়ির সবাই।
— এ আপনের ঠিক কতা নয় কত্তা। অধম্ম হবে। আপনে বাতরুমে ছিলেন। সাত সকালেই গিন্নিমা ফোন করেছিল। আপনের কতা আমার মুকে শুনে তবেই শান্তি পেলে। বলে পরশু থেকে লাইনের গোলমাল। তোর কত্তার খবর পাচ্চি না। একটু আগেই বিজয়ও আপনের খবর নিলো।
শ্যামসুন্দরের কথা শুনে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে অনাদিবাবু। বলে, হ্যাঁ আমার খবর নিতে হলেই লাইনের সমস্যা। আসলে দায় পড়েছে খোঁজ নিতে। কেউ ফোন করেনি। যতো সব তোর বানানো গল্প। ভাগ হারামজাদা।
— সত্যি কতা কত্তা। আপনে বিশ্বাস করেন। কথা বলতে বলতে ডান হাতের ফোনের বোতাম টিপে কানে ধরে শ্যামসুন্দর। ঠিক তখনই বাম পকেটের ফোন বেজে ওঠে। ডান হাতের ফোন পকেটে রেখে বাম হাতের ফোনটা অনাদি বাবুর সামনে ধরে শ্যামসুন্দর। মুখে হালকা হাসির ঝলক। বলে হ্যাঁ, বাঁশি শুনেই বুইচি। দেকেন কত্তা দেকেন। আপনে বুলছিলেন কেউ খবর নেয় না আর এই দেকেন বিজয় ফোন করেছে।
— হাসবি পরে, ফোনটা ধর। আমাকে দেখাবি বলে বিজয় ফোন করেছে? ধর, দেখ কি বলে। ফোন ধরে শ্যামসুন্দর।
অনাদি বাবু চেয়ে আছে শ্যামসুন্দরের দিকে।
— হ্যাঁ, বল বিজয়। গড়গড় করে কথা বলে শ্যামসুন্দর। জানি জানি লাইনের পোবলেম। আমিও আমার বাড়ির খবর নিতে পারিনি। যাইহোক, চিন্তা করিস নে মানিক, তুই বেবসা সামাল দে। আমি তো আচি। কত্তাকে একেনে এনেচি যকন মাতা ঠিক করে নিয়ে তবেই ফিরবো। তুই বাপ বলতে পাগলরে। কত্তার কপাল ভালো। বেশ বেশ রাক। আবার কাল কতা হবে, রাকি। ভালো থাকিস বাপ। আর শোন গিন্নিমা কে বলিস সব ঠিক আচে। হাতের ফোন বাম পকেটে রাখে শ্যামসুন্দর। বলে, কপাল করে ছেলে পেয়েচেন কত্তা।
— বাজে কথা কম বল। কি বললো?
— কে?
— বিজয়, আবার কে?
— ও, হ্যাঁ বললে বাবা কেমন আচে। তারপর বললে কি করচে। খাবারে অরুচি আচে কি না।
— আর?
— আর বাড়ির কতা বলচে কিনা।
— আর?
— ঘুম হয়েচে কিনা।
— আর?
— আর কি। এইসব কতাই জানতে চাইচে।
— রোজ রোজ একই কথা। আর তোর…।
কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলো অনাদিবাবু। সাপের হাঁচি বেদেয় বোঝে। অনাদিবাবুর মনের কথা পড়তে পারে শ্যামসুন্দর। বলে গিন্নি মায়ের কতা তো বললে না কিচু। তাহলে আবার ফোন করবে ঠিক। বলে শুকনো হাসি হাসতে থাকে শ্যামসুন্দর।
ফুঁসে ওঠে অনাদিবাবু। তোকে গিন্নি মায়ের কথা জিজ্ঞাসা করেছি হারামজাদা। গিন্নিমা কেমন আছে জেনে আমি কি করবো। আমার খোঁজ নিয়েছে সে। বলে অনাদি।
শ্যামসুন্দর বোঝে এইসবই অনাদিবাবুর রাগের কথা। বার্ধক্যের দাম্পত্য প্রেম বিচিত্র বড়ো। সেখানে কথার সুবাস ফিকে হয়ে আসে। নিত্যদিনের কপট কলহেই ধরা থাকে নিখাদ ভালোবাসার সুরভি।
— সবই হলো দাদা, আমার বাড়ির খবর ঠিকঠাক ভাবে নেওয়া হলো না। বলে ডান পকেটের ফোন আবার বের করে শ্যামসুন্দর। আমার দিকে তাকিয়ে ঘাড় নাড়ে, মনে লাইন লেগেছে। বোদন, তোর মা কেমন আচে বাপ? ছেলের সঙ্গে সবে দু এক কথা হয়েছে, বেজে ওঠে বাম পকেটের ফোন। থমকে দাঁড়ায় মুখের কথা। বাম পকেট থেকে ফোন বের করে শ্যামসুন্দর। তাকিয়ে থাকে বাজতে থাকা ফোনের দিকে। পরে কতা বলচি বাপ, বলে ডান হাতের ফোনের লাইন কেটে দেয়। বাম হাতের ফোনটা অনাদিবাবুর সামনে এনে ধরে। বলে দেকেন কত্তা দেকেন। আপনে কত কতাই বুললেন। দেকেন গিন্নিমা নিজে ফোন করেচে। শ্যামসুন্দরের বাম হাতের ফোনের দিকে একবার তাকায় অনাদি বাবু। বলে, ফোনটা ধর হারামজাদা।
— … বুলেন গিন্নি মা। কত্তা সারাদিন আপনের কতাই বলছে…। ফোনে কথা বলতে বলতে সামনের বারান্দার শেষপ্রান্তে চলে যায় শ্যামসুন্দর।
এদিকে অনাদিবাবু রেগে ওঠে। বলে, হারামজাদা, আমি কখন বললাম গিন্নি মায়ের কথা। সে ফোন করলেই বা কি। আর না করলেই কি। আমার খিদে পেয়েছে।
কথা বলা শেষ করে শ্যামসুন্দর। চলেন কত্তা চান…।

গতরাতে মশার উৎপাতে ঘুম হয়নি ভালো। দুপুরে ভাত খেয়ে বালিশে মাথা রেখেছিলাম। চোখ মেলে দেখি রাস্তার আলো ঘরের আঁধার ধুয়ে দিয়েছে খানিক। বাইরে যাবো একবার। চা খাবো। রাতের খাবার কিনতে হবে। দরজায় টোকা পরে। দেখি শ্যামসুন্দর। আমার ঘরে ঢুকে এসে ভিতর থেকে দরজা বন্ধ করে। বলে, দাদা কত্তা বায়না ধরেছিল সমুদ্দুর দেকবে। নিয়ে গেলাম। খুব খুশি। আমাকে বলে শ্যামসুন্দর বহুকাল আগে তোর গিন্নী মাকে …।
বিয়ের পর পর স্ত্রীকে নিয়ে পুরী বেড়াতে গিয়েছিল অনাদিবাবু। দুধ সাদা ঝিনুক চাই, আবদার করেছিল অনাদিবাবুর স্ত্রী। মনের মত সাদা ঝিনুক পায়নি। নতুন বউকে সাদা ঝিনুক দিতে না পারার আপশোশ গায়ের ধুলো ঝেড়ে জেগে ওঠে আজ। দুধ সাদা ঝিনুক খুঁজে দেয় শ্যামসুন্দর। ডান হাতের মুঠি খুলে বেশ কয়েকটি সুন্দর ঝিনুক দেখায় আমাকে শ্যামসুন্দর। সবচেয়ে সাদা ঝিনুকটা কত্তা নিজের পাঞ্জাবির বুক পকেটে রেকেচে। বলে বাড়ি গিয়ে তোর গিন্নী মাকে দেবো।
— বাহ, এইবার আপনার গিন্নিমা খুশি হবেন ভীষণ। বলি আমি।
মাথা নাড়ে শ্যামসুন্দর। বলে, পোবলেম তো সেকেনেই দাদা। গিন্নিমা কে কোতায় পাবেন আপনে? কোতায় পাবেন?
— মানে?
— পরশু দিন…। কান্নায় ভেঙে পড়েছে শ্যামসুন্দর। বলে, এমন পোরিসথিতি এই পথম।
অনাদিবাবুর স্ত্রী মারা গেছে পরশু দিন দুপুরে। হার্ট এ্যাটাক। হঠাৎই। শোকে বিহ্বল অনাদিবাবুর একমাত্র সন্তান। এই অবস্থায় বৃদ্ধ বাবার সঙ্গে স্বাভাবিক কথা অসম্ভব। বাড়ির বাইরে দিন ছয়েক থেকে উতলা হয়ে উঠেছে অনাদিবাবু। দেখতে চায় সকলকে। উপায় বের করেছে শ্যামসুন্দর। ডান পকেটের ফোনে ডবল সিম আছে। সেই ফোন থেকে বাম পকেটের ফোনে রিং করলে কখন ফুটে ওঠে বিজয়ের নাম কখনো বা গিন্নীমা। স্ক্রীনে স্ত্রী বা ছেলের নাম দেখে আশ্বস্ত থেকেছে অনাদি বাবু।
— এই করে পরশু থেকে চলচে দাদা। আর পারচি না অভিনয় কত্তে। ফুঁপিয়ে ওঠে শ্যামসুন্দর।
বাকরুদ্ধ আমি। সামনে বসে ঝিনুকগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে শ্যামসুন্দর। কাল রাতের ট্রেনে রওনা দেবে অনাদিবাবুকে নিয়ে। তারপর?
তারপর কি হবে জানে না শ্যামসুন্দর। বাড়ি ফিরে কত্তা যে কি করে…।
পাশের ঘর থেকে হাঁক পারে অনাদিবাবু। চোখ মুছে উঠে যায় শ্যামসুন্দর। খানিক পরেই কানে আসে শ্যামসুন্দরের গলা। কথা বলছে ফোনে। হ্যাঁ গিন্নিমা, শ্যামসুন্দর বলচি। কেমন আচেন মা? কত্তার মনে আজ বেজায় ফুরতি। মজার কতা কি বলবো মা, শোনেন কত্তার কাণ্ড। আজ সমুদ্দুর গিয়ে আপনের জন্যে দুদ সাদা ঝিনুক পেয়েচে। বলে কিনা আমি গিয়ে…। কথা বলতে বলতে ঘরের সামনে পায়চারি করে শ্যামসুন্দর।