কাতুপিসির ডাইরি ও ইন্দিরা – বিজয়া দেব

কাতুপিসির ডাইরি ও ইন্দিরা   (ছোটোগল্প)

বিজয়া দেব

খোলা জানালায় চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল ইন্দিরা। রাজন ঘুমোচ্ছে। এখন বিকেল। রোববার বিকেল। গত রোববার এমনি বিকেলে ঋতু ফোন করেছিল — মা, এখানে কত জায়গার ছাত্রী। আমার রুমমেট গোয়ানিজ, একটু ফুটানি আছে, কথা বলে কম, আমার সিনিয়র, তাই কথা তেমন এগোয় না। দেখা যাক, ধীরে ধীরে সবই অভ্যেস হয়ে যাবে। তারপর পুরো হপ্তা কেটে গেল ফোন করেনি ঋতু। মুম্বইতে বিবিএ কোর্স করতে গেছে ঋতু বারো ক্লাস উৎরে যাওয়ার পর। এখনও রপ্ত হয়ে উঠতে পারেনি। গতকাল থেকে একটা ভয় ভেতর থেকে পাক খেয়ে উঠছে। এসব নিয়ে বেশি কথা বলা রাজনের পছন্দ নয়। ঋতুর কলেজ বেশ বেশ বড় ও ভালো। আছে সে কলেজেরই হোস্টেলে। ফোনের ব্যাপারেও বিধিনিষেধ আছে। কিন্তু কলেজ থেকে তো ফোন করতে পারত ঋতু। আগের সপ্তাহে দুটো বাড়তি ফোন পেয়েছিল সে। অবশ্য সে অন্যের ফোন থেকে করেছিল ঋতু। আর করেছিল কলেজ থেকে। তাহলে? এ সপ্তাহে এমনটা হতে পারত না? ঋতু ভাল আছে তো সুস্থ আছে তো?

পেছনের খোলা জমিটায় মাথা উঁচু বাড়ি উঠেছে। যেভাবে ভিতের কাজ হল, মনে হয় বেশ উঁচু বাড়িই হবে। পেছনের বারান্দার সামনে দাঁড়িয়ে থাকবে ইঁটের পাঁজা, অদূরের জলা জঙ্গল ঘরবাড়ি আকাশবাতাস সব আড়ালে চলে যাবে। ওখানে আগে কাতুপিসির বাড়ি ছিল। তিনতলা পুরনো বাড়ি। যা হয় আর কি, প্রমোটারদের আনাগোনা শুরু হয়ে গেল। কাতুপিসির ছেলে অভি ওদের পাতানো জালে অতি সহজেই ধরা পড়ল।
গতকাল ইন্দিরা কাতুপিসির বাড়ি গিয়েছিল। কাতুপিসি মানে কাত্যায়নী। নতুন বাড়ি করে কাতুপিসি বাড়ি বদল করেছেন। পুরোন বাড়িটা প্রমোটারের হাতে তুলে দিয়েছে তার একমাত্র ছেলে অভি। একটুকরো জমি শহরতলির দিকে আগেই কেনা ছিল। ওখানে এখন ছোট্ট দোতলা বাড়ি করেছেন কাতুপিসি। ইন্দিরা বাড়ি খুঁজে বের করতে পারছিল না। খুঁজতে খুঁজতে যখন হয়রান হয়ে যাবার যোগাড় তখন পেছন থেকে যেন কেউ ফিসফিস করে বলল — কাতুপিসির বাড়ি খুঁজছ? ঐ দেখো। ইন্দিরা সামনে তাকাল। বেশ সুন্দর ছিমছাম বাড়ি সামনে ফুলগাছ। কাতুপিসি তাকে দেখে খুব খুশি। কাতুপিসির পরনে সাদাখোলের ওপর চওড়া পাড়ের শাড়ি, মুখখানাতে সাদামাটা সরলতা। নাহ পিসি আগের মতই। কোনও পরিবর্তন নেই। ইন্দিরাকে আগ্রহভরে ঘরে নিয়ে বসালেন। সে স্বস্তি পাচ্ছিল না কিছুতেই। ফোনটা ভুল করে বাড়িতে ফেলে এসেছে। এখন যদি ঋতুর ফোন আসে! কাতু পিসি পুরনো কথা তুললেন। রাজনের মা-র কথা বাবার কথা জেঠুর কথা জেঠাইমার কথা, তারপর ঋতু রাজনের কথা। খিড়কি দোর দিয়ে দেখাচ্ছিলেন স্বচ্ছ জলের পুকুর তার ওপর ভেসে বেড়াচ্ছে দুটো পাতিহাঁস। এ শহরে এখনও পুকুর আছে? অবাক লাগছিল ইন্দিরার। পিসি কত কথা বলছিলেন। দুটো ডিম এনে দেখালেন, পাতিহাঁসের ডিম। বললেন — নিয়ে যা। তোর ও রাজনের জন্যে। এতসব নিরুপদ্রপ শান্তির ছবি তবু ইন্দিরাকে শান্তি দিচ্ছিল না। সে উশখুশ করছিল। পিসি বলল — এত উতলা হয়ে আছিস কেন? ইন্দিরা বলে –তিনচারদিন হল পিসি ঋতুর ফোন আসেনি। তাই খুব চিন্তা হচ্ছে। আজ আমি যাই। একটু সুস্থির হয়ে আবার আসব। ভুল করে ফোনটা বাড়িতে ফেলে এসেছি। পিসি একটু হেসে বললেন — এত উতলা হোস না। ঠিক আছে তুই আজ আয়। কত কথা ছিল। বেশ, সে পড়ে হবেখন। ইন্দিরা দেখল কাতুপিসির সারা মুখে বিকেলের রোদ লেগে আছে।
বাড়ি ফিরে অস্থির হাতে ফোনটা তুলে দেখল ইন্দিরা ঋতুর কোনও মিসড কল আছে কিনা। না ফোন আসেনি। এই উদ্বেগ অস্থিরতা শান্তি দেয় না। দিনরাতের রং বদল হয়ে যায়। রাজনকে এসব নিয়ে কিছু বললে বিরক্ত হয়ে ওঠে।
রাতে কাতুপিসির ফোন আসে। — কি রে ঋতুর ফোন এসেছে? আসেনি? অভি যখন প্রথম বাইরে গেল আমিও এই তোর মতোই উচাটন করেছি। অভি এতে খুব বিরক্ত। দেখলাম আমাদের শক্ত হতে হবে। যার জন্যে ভেবে মরছি সে তো সেভাবে ভাবছে না। তার আলাদা জীবন তৈরি হয়ে গেছে। তার চলার পথটাই আলাদা। ঠিক আছে ঋতু প্রথম পড়তে গেছে বয়েসটাও কম, ভাবনা তো হবে। তবে এত উতলা হোস না। আমার ডাইরি শুনবি? যদি তোর আগ্রহ থাকে শোনাতে পারি।
— তুমি এখনও ডাইরি লিখো পিসি?
— হ্যাঁ রে আমি এসবেই ভাল থাকি। আগে বল শুনবি?
— বেশ তো শোনাও।
— “ভেবেছিলাম নিজেকে বদলাব না। যেমন ছিলাম যেমন আছি তেমনটি যেন থাকি। সেজন্যেই এই পুকুর গাছপালা বাগান, পাতিহাঁস এইসব। অভি ফোন করে আমিও করি। তবু চিঠি লিখি। যেদিন চিঠি পোস্ট বক্সে ফেলে আসি সেদিন স্বপ্ন দেখি জ্যোৎস্না রাতের হাওয়া মাঠঘাট ভেঙে মেল ট্রেন ছুটে চলেছে ছোটনাগপুরের দিকে। তুই জানিস ওখানে আমার শৈশব কৈশোর ও প্রথম যৌবন কেটেছে।
খামবন্দি চিঠিটা কাকে দিই? কেউ না। একটা ভুল ঠিকানায় পাঠিয়ে দিই। যাক সে যেদিক খুশি। চিঠি কেউ পড়বে না। অভি তো রেগে উঠবে। তাই আর কি! পুরো একপৃষ্ঠা চিঠি। ডাকঘরে জমে হয়তো পাহাড় হয়। তারপর আবর্জনার স্তূপে চলে যায়। কিন্তু এই চিঠি লিখে আমি ভারমুক্ত হই। অভিকে নিজে থেকে ফোন খুব কম করি। কারণ তাতে ও বিরক্ত হয়। এই অভির যখন ডানা শক্ত হয়নি তখন মা ছাড়া কিছু বুঝতো না। তবে এজন্যে আপশোশ নেই আমার। আমার জগতে আমি ভালোই আছি।” এইটুকু শোনালাম ইন্দু। আরেকদিন আসবি তাহলে আরও শোনাব। ঋতু ফোন করবে দেখিস। চিন্তা করিস না।

রাতে সত্যিই ফোন এল ঋতুর — “তুমি এত ফোন করেছ মা। মিসড কল আটচল্লিশ বার। পাগল হয়ে গেলে! কোথায় বাবা তো এমন করছে না! তোমাকে তো বলেছি আমার কিছু হলে হোস্টেল থেকে ফোন করবে। আমাদের ফোন সুপার এর কাছে থাকে। শনি রবি দুদিন আমাদের হাতে দেওয়া হয়। আজ শনিবার, সুপার আমার হাতে ফোন দিয়ে বলল — তোমার মা ফোরটিয়েইট টাইমস তোমায় কল করেছে।কিন্তু কেন ? তুমি বলোনি এনি ইমার্জেন্সি ইওর পেরেন্টস ক্যান কল অন দ্য অফিসিয়াল নং অফ হোস্টেল। ঈশ আমি কী লজ্জা পেলাম সবার সামনে!
ইন্দিরা ভাবে এখন ঋতু লজ্জা পেয়েছে তারপর ঋতুর রাগ হবে। তখন তো শুরু হবে ইন্দিরার অন্য লড়াই। আসলে এখন ইন্দিরার প্রস্তুতিপর্ব।