চিংড়িমামার শিল্প (ছোটোদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
রবিবারের বিকেল। আমরা পাঁচজন মানে আমি, জগা, গোবরা, ফটকে এবং সুদেব চিংড়িমামার বাড়ির দিকে যাচ্ছি। চিংড়িমামা আমাদের নেমন্তন্ন করেছে; আমাদের সবাইকে নাকি ডবল ডিমের ওমলেট খাওয়াবে। সত্যি কথা বলতে কি খাবারের কথা হলেই আমাদের জিভে জল আসে। সবসময় আমাদের সবার মনে খাবারের প্রতি এক লোভ এসে পড়ে। তাই ডবল ডিমের ওমলেটের কথা শুনে আমাদের আর তর সইছিল না। অবশ্য ব্যাপারটা শেষপর্যন্ত সত্যি হবে কিনা আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ ছিল। বলা যায় ডবল ডিমের ওমলেটের লোভেই আমরা চিংড়িমামার বাড়ির দিকে যাচ্ছিলাম।
চিংড়িমামা ডাক নামটা আমাদেরই দেওয়া, আর এই নামটা চিংড়িমামার একদম পছন্দই নয়। চিংড়িমামার বাড়ির কাছে আসার পর আমি সবাইকে বললাম, দেখো, খাবার আগে কিন্তু চিংড়িমামা বলে ডাকা যাবে না; আমরা চিংড়িমামার পরিবর্তে জটুমামা বলেই ডাকবো।
এতে সবাই সায় দিল।
আমরা চিংড়িমামার গেইটের সামনে এসে পড়লাম। চিংড়িমামা যেন আমাদের অপেক্ষাতেই ছিল, এসে গেইটের দরজা খুলে দিল। তারপর আমাদের তার একেবারে নিজের লিভিং রুমে নিয়ে গেল। চারটা প্লাস্টিকের চেয়ার এবং দুটো প্লাস্টিকের টুল চিংড়িমামার ঘরে রয়েছে। বোধহয় আমাদের জন্যেই অন্য ঘর থেকে এনে রাখা হয়েছে। আগের একটা টেবিলটা তো ছিলই।
আমি বললাম, বাড়িতে তো কাউকে দেখছি না। ডবল ডিমের ওমলেট কে করে দেবে এখন?
চিংড়িমামা একটু রেগে উঠল, তোদের শুধু খাই খাই। না, বাড়িতে কেউ নেই। সবাই এক নেমতন্ন রক্ষা করতে অন্য পাড়ায় গেছে। আর ডবল ডিমের ওমলেট আমিই করে খাওয়াবো, চিন্তার কিছু নেই। এখন একটু জিরিয়ে নে।
যাক, আমি একটু নিশ্চিন্ত হলাম, তাহলে ওমলেটটা আসছে।
কিছুক্ষণ পর চিংড়িমামা বললো, আচ্ছা আমাকে দেখে তোদের কি শিল্পী-শিল্পী মনে হয় কিংবা কবি-কবি?
আমি বললাম, হয়তো মনে হবে, তবে এখন তো কিছুই মনে হচ্ছে না। ওমলেট খেয়ে আবার চিন্তা করব। তোরা কী বলিস? বলেই আমি জগাদের দিকে তাকালাম। জগারা উত্তর দিল, একদম ঠিক তাই।
আমাদের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে চিংড়িমামা বলল, আমি আসলে দুটোই — শিল্পী এবং কবি। আমার ভাবটাই এই ধরনের, যদিও আমি কবিতা লেখা শুরু করিনি। তবে শিগগির আমি কবিতা লেখা শুরু করবো। আর শিল্পী হিসেবে আমি একটা ছবি ইতিমধ্যেই এঁকে ফেলেছি। তোদের আজ দেখাবো।
আমার তো এসব কথায় কান যাচ্ছিল না। আমি চিংড়িমামার দিকে হাঁ করে তাকিয়ে দেখছি আর ভাবছি, এই বুঝি চিংড়িমামা ওমলেট বানাতে রান্নাঘরের দিকে যাচ্ছে। তাই অন্য ব্যাপারে আমার মনোযোগ একদম হচ্ছিল না।
ব্যাপার দেখে চিংড়িমামা কিছুক্ষণের মধ্যেই ‘ধুত্তোরি’ বলে উঠে রান্নাঘরের দিকে পা বাড়াল। যেতে যেতে চিংড়িমামার মুখ থেকে একটা অস্পষ্ট আওয়াজ পেলাম, রাক্ষসের দল।
কিছুক্ষণের মধ্যেই চিংড়িমামা একটা চিনে মাটির ডিশে একটা ডাবল ডিমের ওমলেট বানিয়ে নিয়ে এসে টেবিলের ওপর রেখে বিছানায় বসে বললো, একটা বানিয়ে নিয়ে এলাম। কিছুক্ষণ পরে আরো বানাচ্ছি। আর হ্যাঁ, আমার খুব ক্ষিদে পেয়েছে, তাই ওমলেটের অর্ধেক আমি খাচ্ছি। বাকি অর্ধেক তোদের পাঁচজনকে দিচ্ছি পাঁচ ভাগ করে।
বলেই চিংড়িমামা ওমলেটের অর্ধেকটা গপ গপ করে খেয়ে বাকিটার পাঁচ ভাগ করে আমাদের দিকে এগিয়ে দিল।
আমাদের সবার বেশ মনঃক্ষুণ্ণ হল। ঐ টুকু খাবার খেয়ে আরো ক্ষিদে বেড়ে গেল। তবে আরো আসবে ভেবে চুপ করে গেলাম।
চিংড়িমামা বলল, আরে, আসবে আরো ওমলেট আসবে। চিন্তা করো না। এখন আমার আঁকা ছবি তোদের দেখাচ্ছি। আমি যে শিল্পী তা না দেখলে তো তোরা বিশ্বাস করবি না।
চিংড়িমামা বিছানার তোষকের নিচ থেকে একটা ভাঁজ করা বড় কাগজ বের করল। সেটা সামনের টেবিলের ওপর রেখে আস্তে আস্তে আমাদের সামনে মেলে ধরে বলল, আরে আমার সিগনেচারটা করা হয়নি। নইলে আবার আলতু-ফালতু কেউ নিজের নাম দিয়ে সই করে দেবে। বলেই চিংড়িমামা কাগজের একপ্রান্তে লিখল জটিলেশ্বর শর্মা। বুঝতে পারলাম আলতু-ফালতু হিসেবে আমাদের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। দেখলাম, কাগজে একটা সুন্দর ছবি আঁকা আছে — গাছপালা, পাহাড় এবং নদীর মাঝখানে নৌকোয় এক জেলে মাছ ধরছে। তবে লক্ষ করলাম, কাগজটা দুমড়ানো। আমি বললাম, ছবিটা সুন্দর, তবে কাগজটা দুমড়ানো কেনো?
চিংড়িমামা তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, আরে ওটা আধুনিক আর্টের একটা অংশ। তোদের মাথায় এসব ঢুকবে না।
জগা রেগে উঠল, কেন, আমাদের মাথায় কি গোবর? আমরা কি আলতু-ফালতু?
আমি জগাকে থামালাম। নিচু গলায় বললাম, দাঁড়া আগে ডাবল ডিমের ওমলেট খেয়ে নিই।
কিন্তু আমার কথাগুলি চিংড়িমামা ঠিক শুনে ফেলল। বলল, খাওয়া-দাওয়া পরে, আগে বল্ আমার আঁকা ছবিটা কেমন হয়েছে?
আমি বললাম, সব বলবো, তবে ওমলেট খাবার পর।
চিংড়িমামার উত্তর এল, না, আগে বলতে হবে ছবিটা কেমন হল। তারপর খাবার পালা।
আমি বেশ বুঝতে পারলাম চিংড়িমামার ফন্দিটা অন্যরকম । একটু ভেবে তাই বললাম, সত্যি বলব, মিথ্যে বলতে পারব না। ছবিটা বেশ সুন্দর, তবে ওটা তোমার আঁকা মনে হচ্ছে না।
সুদেব বলল, আমার মনে হচ্ছে, ছবিটা দুমড়ে-মুচড়ে কেউ ফেলে দিয়েছিল।
গোবরা বলল, আর সেই দুমড়ানো ছবিটাই তুমি বাড়িতে এনেছো।
ফটকে বলল, তুমি ওটা কোত্থেকে মেরে এনেছ?
এসব শুনেও চিংড়িমামা আজ শান্ত, মোটেও রাগ করছে না। আমরা একটু আশ্চর্য হলাম। চিংড়িমামা একটু মুচকি হাসল, তারপর বলল, আমি আগেই জানতাম, আমার ওপর তোদের একদম আস্থা নেই। কিন্তু আমার শিল্পী মন। আলতু-ফালতু লোকদের কথায় শিল্পীদের তোয়াক্কা করতে নেই। তোদেরকে আর ওমলেট খাওয়াবার কোনো দরকারই নেই আমার। তোরা এখন গেট আউট। চিংড়িমামা আঙুল দিয়ে আমাদেরকে গেইট দেখিয়ে দিল।