থার্ড পার্টি (ছোটোগল্প)
সদানন্দ সিংহ
ট্রেনটা সময়মত পৌঁছোয় নি। দু’ঘন্টার মতো বেশি লেগেছে। স্টেশান যশবন্তপুর। প্ল্যাটফর্মের বাইরে এসে লোকেন মোবাইল বের করে উবের-ওলার অ্যাপ খোলে। কাছাকাছি কোনো উবের বা ওলাকে দেখতে পায় না। সামনে তবে অনেক প্রাইভেট কার-ক্যাব দাঁড়িয়ে আছে। গন্তব্যস্থল তার কর্মস্থল, এখান থেকে প্রায় দুঘন্টার জার্ণি। সঙ্গে নববধূ রূপা, আর একটা বড় লাগেজ। দুটো হ্যান্ড ব্যাগেজ দু জনের কাঁধে। লাগেজটা সামলাচ্ছে লোকেন।
তাঁদেরকে বেরুতে দেখে বেশ কয়েকজন কার-ক্যাবের দালাল ছেঁকে ধরেছে, কঁহা জানা হেঁ। লোকেন দালালদের সামলিয়ে, পাশ কাটিয়ে সামনে এগিয়ে যায়। একটু এগোতেই ওরা দেখে একটা ক্যাবের ভেতরে একজন ড্রাইভার বসে খৈনি টিপছে। লোকেন ড্রাইভারটির সঙ্গে কথা বলে দরদাম ঠিক করে। ড্রাইভার লোকটি খৈনি মুখে পুরে বেরিয়ে এসে লোকেনদের লাগেজটা গাড়ির পিছে রাখে। লোকেনরা ক্যাবের ভেতরে ঢুকে এসির ভেতর গা ডুবিয়ে দেয়, আঃ কী আরাম এখন। কিন্তু আরাম যে হারাম সেটা কিছুক্ষণের মধ্যেই টের পায়। ড্রাইভার লোকটি ভেতরে ঢুকে গাড়ি স্টার্ট করে দশহাত এগোবার পর গাড়ি থামায় আর পেছনে ফিরে বলে, সাবজী, ইয়ে গাড়ি খারাপ হ্যায়। আপলোগ বৈঠিয়ে, দুসরা গাড়ি লেকে হম আ রহা হুঁ।
ড্রাইভার লোকটি গাড়ি থেকে নেমে সামনে কাছের আরেকটা ক্যাবের ড্রাইভারের সঙ্গে কীসব কথাবার্তা বলে আবার ফিরে এসে লোকেনদের বলে, ওহী গাড়িমে চলিয়ে সাবজী। ওহী জায়েগা। বলেই সে লোকেনদের লাগেজটা সামনের ক্যাবে তুলে দেয়।
অগত্যা লোকেনরা সামনের গাড়িতেই উঠে পড়ে। সেই গাড়ির ড্রাইভারটা লোকেনদের দেখে হাসে। ‘চলিয়ে’ বলেই গাড়ি স্টার্ট করে দেয় এবং প্রায় ত্রিশ ফুট যাওয়ার পরই গাড়িটা অফ করে দেয়, পেছন দিকে ফিরে বলে, সাব, হাম কো মালিক বুলায়া। যানা পড়েগা হাম কো। আপলোগ মত্ ঘাবড়াইয়ে। হামারা ভাই কা গাড়ি আপকো লে যায়েগা। আপ বৈঠিয়ে। মেরে ভাইকো বুলা রহা হুঁ। বলেই সে মোবাইলে দক্ষিণী ভাষায় কারুর সঙ্গে কথবার্তা বলতে থাকে।
লোকেন এবার ভালোই বুঝতে পারে যে দালালের হাত থেকে নিস্তার পাওয়ার চেষ্টা করেও সে সফল হয়নি। সে দালালের হাতেই পড়েছে এবং এক দালাল আরেক দালালকে কমিশনে বেঁচে দিচ্ছে তাকে। সে একবার ভাবে, নেমে যাবে কিনা। কিন্তু নামে না, শেষটা দেখার অপেক্ষায় থাকে।
এদিকে মুহূর্তের মধ্যেই দ্বিতীয় ড্রাইভারের তথাকথিত ভাইটি সাদা রঙের একটা মারুতি অল্টো কার নিয়ে এসে লোকেনদের সামনে দাঁড় করিয়ে গাড়ি থেকে নেমে এসে লোকেনদের লাগেজটা তার গাড়ির পেছনে রেখে দেয়। তারপর লোকেনদের দিকে তাকিয়ে একটা মিষ্টি হাসি দিয়ে বলে, হম যায়েগা স্যার, প্লিজ কাম।
তারপর লোকেনরা আর কী করে, আবার সেই মারুতি অল্টো কারে। তবে সে গাড়িটা আর থামে না, ছুটে চলতে থাকে। লোকেন নিশ্চিত হয়, যাক, আর চার নাম্বার দালালের হাতে আর পড়তে হবে না।
গাড়িটাতে এসি নেই, আবার আগের তুলনায় বেশ ছোট। প্রথম ড্রাইভারটার সঙ্গে যে ভাড়ায় কথা হয়েছিল সে ভাড়া থেকে বেশ কম হবারই কথা। লোকেন যখন ভাবছে কত কম ভাড়া দেওয়া উচিত, ঠিক তখনই ড্রাইভারটা তাকে জিজ্ঞেস করে ওঠে, কীধরা যায়েগা সাব? প্রশ্ন শুনে লোকেন তাজ্জব। বলে কী লোকটা, কোথায় যাবে তা না জেনেই গাড়ি চালিয়ে যাচ্ছে! লোকেন বলে, তুম ক্যায়সা আদমী হে রে ভাই। কীধর যায়েগা মালুম নেহী, ভাড়া কিত্না হেঁ মালুম হেঁ?
ড্রাইভার লোকটি হেসে বলে, স্যার, আই তেলেগু। হম থোড়া হিন্দি, থোড়া ইংলিশ, থোড়া কন্নড় জানতা। হোয়াট বাড়া?
লোকেন একটু জোরে বলে, বাড়া নেহী, ভাড়া ভাড়া। রেন্ট, কার রেন্ট।
এবার ড্রাইভারটা বুঝতে পেরে বলে, অ-অ-অ, কার রেন্টা। দে টোল্ড মি। মালুম হেঁ।
লোকেন এবার বুঝতে পারে, ভাড়া কমবে না। মনে মনে বলে, শালা। অবশ্য তার গন্তব্যস্থলের ঠিকানাটা সে জানিয়ে দেয়।
গাড়ি ছুটে চলছে দ্রুতগতিতে। রূপা তার মাথাটা লোকেনের কাঁধে এলিয়ে দিয়েছে। একহাত দিয়ে লোকেন রূপাকে নিজের দিকে আঁকড়িয়ে ধরে আছে। নতুন বিয়ে, তাই ধীরে ধীরে ওরা এক স্বপ্নিল জগতের দিকে চলে যাচ্ছে গাড়ির ভেতর। মনে হচ্ছে, ওরা যেন এক নির্জন দ্বীপে বসে আছে। চারিদিকে কেউ নেই। সিনেমার মত দ্বীপের ঝাউ গাছগুলির ভেতর থেকে এক অপূর্ব ধোঁয়ার রিং চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। রূপার চোখ দুটো বন্ধ, ওকে অপূর্ব লাগছে। লোকেন ধীরে ধীরে রূপার ঠোঁটে তার ঠোঁট রাখে।
আর এই সময়ই কিনা হঠাৎ ক্যাঁচ করে গাড়িটা দাঁড়িয়ে যায়। লোকেন খুব বিরক্ত হয়ে বলে, ফির ক্যায়া হুয়া?
ড্রাইভারটা ওদের দিকে না তাকিয়েই বলে, স্যার, আপ ফ্রন্ট সীট মে বৈঠিয়ে।
শুনে লোকেনের মেজাজ খিঁচড়ে যায়, হোয়াট ডু য়্যু মীন?
ড্রাইভার লোকটি এবার পেছনে ফিরে অনেকটা কাঁচুমাচু চোখে বলে, আই ফীল স্লিপিং। ইয়েস্টার ডে, নো স্লিপিং। হোল নাইট মাই ডিউটি।
— তো?
— ফ্রটসীট মে আপ বৈঠিয়ে। বাত কিজিয়ে হামারা সাথ।
লোকেন ভেবেছিল বৌয়ের সঙ্গে একটু আরাম ফস্টিনস্টি করে যাবে, এখন কিনা সামনের সীটে বসে লোকটার ঘুম তাড়াবার জন্যে তাকে কথা বলে যেতে হবে! একটু রেগে ওঠে সে বলে, নহী তো ক্যায়া হোগা?
ড্রাইভার লোকটা হাসে, নেহী তো ক্যায়া হোগা হমারা মালুম নেহী। হো সকতা হে গাড়ি ইধর ওধর চলা গয়া।
লোকটার কথা শুনে লোকেন মনে মনে একটু শিউরে ওঠে, বলে কী লোকটা? অ্যাকসিডেন্টের ভয় দেখাচ্ছে?
রাস্তায় আর দেরী করে লাভ নেই ভেবে লোকেন রূপাকে বলে, আমি সামনে বসছি। হারামজাদাটা বড্ড জ্বালাচ্ছে।
লোকেন সামনে এসে বসার পর আবার গাড়িটা চলতে শুরু করে।
মিনিট দশেক চলার পর লোকটা লোকেনকে আবার বলে, স্যার বাত কিজিয়ে। আই ফিল স্লিপিং।
লোকেন কী কথা বলবে ভেবে পায়না, বলে, তেরে বাপ মর্ গ্যা ক্যায়া ? মানে, ফাদার জিন্দা হ্যায় ক্যায়া?
লোকটি হেসে উত্তর দেয়, টেন ইয়ার পহেলে উপর চলা গয়া। আপকা ?
— জিন্দা হ্যায়।
বলেই লোকেন রূপাকে দেখে। রূপা ক্লান্তিতে এলিয়ে পড়েছে। ইস, পেছনে থাকলে সে রূপাকে জড়িয়ে ধরে রাখতে পারত আর এক ফাঁকে হয়তো টুকুস করে আবার চুমোও দিয়ে ফেলত। এভাবে সামনে বসে এখন নিজের হাত নিজে কামড়ানো ছাড়া উপায় নেই।
কারটা ছুটে চলেছে। লোকেনও ক্লান্ত। সে পেছন ফিরে আবার দেখে রূপা এখন ঘুমিয়েই পড়েছে। রূপাকে আর ডিস্টার্ব করেনা সে। তারও চোখ বুজে আসছে আস্তে আস্তে। এইসময় ড্রাইভারটা আবার বলে ওঠে, স্যার বাত কিজিয়ে। আই ফিল স্লিপিং।
একটু চমকে ওঠে লোকেন। বেশ বিরক্ত হয়। বলে, তেরা মা মর গয়ি ক্যায়া?
লোকটি এবার হেসে বলে, নহী, জিন্দা হ্যায়
লোকেন উত্তর দেয়, মেরে মা ভি জিন্দা হ্যায়।
তারপর আবার চুপ। ড্রাইভার লোকটির সঙ্গে কীই বা কথা বলবে লোকেন ভেবে পায় না। তবে সে বুঝে যায়, সে এবং রূপা এক মুশকিল বাস্তব জগতের মধ্যে আছে। সেই জগতের চালক এখন সে নিজে নয়, অন্য কেউ — এক থার্ড পার্টি। এই থার্ড পার্টি ছাড়া এখন চলাও অসম্ভব। এই থার্ড পার্টিকে জিইয়ে রেখেই তার মত লোকদের এখন এগোতে হবে। নইলে পিছিয়ে যেতে হবে। তাই লোকেন ড্রাইভারকে বলে, আভি এক গানা গা রহা হুঁ। বলেই সে মুকেশের গলার মতো গাইতে শুরু করে, জীনা য়াঁহা, মর না য়াঁহা, ইসকে সিবা জানা কহা………