বাস্তব কিংবা অবাস্তব (অনুগল্প)
অঞ্জলি দে
রোজ সকালে সকলের গেটের কলিং বেল টিপে ছেলেটা ঘুম থেকে ওঠায়। ঘাস, পাতা, ফুল ও মালা দিয়ে যায়। রাস্তায় ও গাইতে গাইতে গাইতে যায়, “জয় মাতা দি! জয় মাতা দি! জয় মাতা দি! …..”। যারা ও আসার আগেই ভোরে উঠে সংসারের কাজ করে, তারা ওকে অনেকসময় ডেকে বসিয়ে আবার চাও খাওয়ায়। শুধু যে ও ফুলওলা তা কিন্তু নয়। ফুল দেওয়া হয়ে গেলে ও আবার পাড়ায় ঘুরে ঘুরে ঘুরে গাড়ি পরিষ্কার করে। সকাল থেকেই ওর রোজগার করা শুরু হয়ে যায়। গাড়ি পরিষ্কারের কাজ হয়ে গেলে ও সব্জি বিক্রি করে রাত পর্যন্ত।
আজ সকালে সে পাড়ার এক বাড়িতে অনেকবার ধরে গেটে বেল বাজিয়েই গেল। কেউ গেট খুলতে এল না। এরকমটা কখনই হয়নি আগে। ও পাশের বাড়ির কাছে ওই বাড়ির ফুল রেখে গেল। এরকমটা এখানে হয়, পরে পড়শীকে দিয়ে দেয় অন্যরা। আজ পরে ওই পড়শী পাশের বাড়ির গেটে বহু বার বেল বাজলো। কেউ এল না। ফোন করল। কেউ তুলল না। ও নিজের বাড়িতে ঢুকে গেল। বেলা বাড়ল।
গাড়ি পরিষ্কার করতে এসে ছেলেটা আবার বেল বাজাল, কিন্তু খুলল না। পড়শীকে বলল, “কেউ খুলছে না কেন?” পড়শী অন্য আরেক পাশের বাড়ির মানুষকে ডাকল। সকলে একসঙ্গে গিয়ে বেল বাজাল, ফোন করল, কেউ খুলল না। কি আর করে? গেট ভাঙল সকলে মিলে। ঢুকে দেখে ভদ্রলোক তার বিছানায় মৃত অবস্থায় পড়ে আছেন। বয়স তাঁর পঁচাত্তর মত হয়েছিল। ওঁর স্ত্রী নেই, করোনা হয়ে মারা গেছিলেন আগেই। তাঁদের কোনো সন্তানও ছিল না। দুজনেই সরকারি চাকরি করার পরে রিটায়ার্ড নিয়েছি্লেন। স্বামী কাশ্মীরি ও স্ত্রী মারাঠি। দুজনেই ভ্রমণপ্রিয় ছিলেন। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশই ওঁদের ভ্রমণ করা হয়ে গেছিল। একটা পুরোনো গাড়ি ছিল। মাঝে মধ্যে কোন এক ড্রাইভারকে ডেকে সেটাকে নিয়ে, নিজে তাতে বসে বাজার-টাজার করে আনতেন ভদ্রলোক। ওই গাড়ির সিটে সবসময় ওঁর মৃত পত্নীর ছবি বসিয়ে রাখতেন।
পাড়াপড়শীরা লোকটার ফোন ঘেঁটে যেসব ফোন নাম্বার পেল, তাদেরকে কল করে বলা হল। তবে একজন ছাড়া আর কেউ এলো না, সে নাকি ভদ্রলোকের স্ত্রীর অফিসের বান্ধবীর মেয়ে। অবশ্য তার উড়োজাহাজে করে আসতে প্রায় তিন ঘণ্টার মত লাগল। এসেই সে সবার সঙ্গে কথা বলে, দাহ করতে নিয়ে গেল। ফিরে এসে সে সবাইকে বলল, “আমি খানিকটা এদেরও সন্তান। উনার স্ত্রী তো বন্ধ্যা ছিলেন। তাই আমার মায়ের গর্ভে চিকিৎসক এনার সন্তান হবার ব্যবস্থা করেছিল। তবে কোনো শারীরিক সমন্ধ ছিল না। আমার মায়ের গর্ভ থেকে জন্ম নিলেও কিন্তু আমার বায়োলজিক্যাল বাবা ছিলেন উনিই। এসব কথা শুনে সবাই আশ্চর্য হয়ে গেল। এতদিন এসব কেউই জানতো না।
মেয়েটি কয়েকটা দিন থেকে শ্রাদ্ধশান্তি করিয়ে, বাড়িতে তালা লাগিয়ে চলে গেল। পাড়ার লোকেরা শুধু গবেষণা করতে লাগল, বাস্তব কোন্টা? অবাস্তবই বা কোন্টা?