নিনোর রবীন্দ্রনাথ (ছোটোদের গল্প)
ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য
খুব চিন্তায় পড়েছে নিনো। স্কুলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালন হবে। আর কয় দিন মাত্র বাকি। নিনো এখনও তৈরিই হতে পারেনি। কিভাবে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না কিছুতেই। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সম্পর্কে দু কথা যে কিভাবে বলে! ভাবনায় অধীর হয়েছে নিনো।
ক্লাস-টু থেকে বক্তব্য রাখতে হবে নিনোকে। অন্য ক্লাসগুলি থেকেও অনেকে বলবে কবিগুরু সম্পর্কে। কেউ কেউ গান গাইবে। রবীন্দ্রনৃত্য আছে। ছোট ছোট দুটি নাটকও হবে। জমজমাট অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে স্কুলে। রিহার্সাল চলছে রোজ। সমস্যা হল নিনো কি বলবে? কিছু তো বলতেই হবে।
সুশান্ত স্যার সেই দিন বলেই দিয়েছেন যা পারো তাই বলবে। অবশ্যই তোমার নিজের কথা বলবে। কারোর কাছে শুনে নয়। বই দেখে মুখস্থ করে নয়। ভেবে ভেবে বক্তব্যের বিষয়বস্তু তৈরি করতে হবে। তোমার বক্তব্য যেন তোমারই হয়। বক্তব্য যেনো একান্তই তোমার নিজের কথা হয়।
কয়দিন ধরে নিনো বেশ চিন্তায় আছে সেই নিয়ে।
“মা, কি বলা যায় বল তো?” নিনো জিজ্ঞাসা করে মাকে।
মা বলেন, “আমি কেন বলবো! তুমি নিজেই ভাব। একমনে ভাবলে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তোমার মত করে ঠিক চিনতে পারবে সোনা। ভাবনা গভীর হতে হবে। আর থাকতে হবে ভীষণ ভালোবাসা।”
গতকাল বাবাকেও জিজ্ঞাসা করেছিল নিনো। বাবারও সেই এক কথা। “নিজে ভেবে নিজের মত করে বলতে শেখ। কেউ বলে দিলে, সেটা তো আর নিজের মনের কথা হয় না। অপরের ভাবনা তুমি কেন বলবে? যার যেমন ভাবনা, কবিগুরু তার আকাশে সেই মত ফুটে ওঠেন। আসলে কি জানো, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে জানতে গেলে তার সৃষ্টির দিকে মনোযোগী হতে হবে তোমাকে। কবিগুরুর কবিতা, ছড়া তুমি পড়েছ। গানও শুনেছ। সেই সমস্ত বিষয় থেকেই তোমার বক্তব্যের উপকরণ খুঁজে নাও।”
বাবা ঠিকই বলেছেন। নিনোর মনের কথা অপরে কিভাবে বলবে! তাহলে নিজেকেই ভাবতে হবে। তাই নিনো সময় পেলেই ভাবে। এক লাইন এক লাইন করে লিখেও রাখে খাতায়, যদি পরে ভুলে যায়। তাই।
আজ দুপুরে বারান্দায় বসে ছিল নিনো। সামনেই বাগান। ছোট বড় নানা গাছ ঘন হয়ে ছায়া দিয়েছে। বেশ বড় একটা পুকুরও আছে। অন্যদিন নির্জন দুপুরে কল্পনায় পুকুরে সাঁতার কাটে নিনো। গাছে চড়ে। অরণ্যদেবের মত এক ডাল থেকে অন্য ডালে চলে যায় অনায়াসে। কল্পলোকের প্রতিপক্ষের সঙ্গে যুদ্ধ করে মেঘের আড়ালে থেকে। আজ সে সবে মন নেই। ভাবনা পাক খায় শুধু একটি শব্দকে ঘিরে “বক্তৃতা।”
স্কুলে বেশ কয়বার মাস্টারমশাইদের বক্তৃতা শুনেছে নিনো। আজ ভাবে, বক্তৃতা হয় কিভাবে? মানে কবিগুরু সম্পর্কে কোন কোন কথা বললে একটা সুন্দর বক্তৃতা হবে!
স্কুলে হেডস্যার বলেছিলেন যা খুশি বললেই তো বলা হয় না। বক্তব্য সাজাতে হয় সুন্দর করে। তার জন্য পড়াশোনা করতে হয়। ভাবতে হয়। নয়তো অগোছালো কথা মানুষের মনোগ্রাহী হয়না কখনো। সঠিক ভাবনা সব সময় সঠিক পথ দেখায়।
“কি ভাবছো নিনো?” মা এসে জিজ্ঞাসা করেন। বসেন নিনোর পাশে।
“স্কুলে আমি কি বলবো তাই ভাবছি।” বলে নিনো।
মা হাসি মুখে চেয়ে থাকেন ছেলের দিকে।
“জানো মা, এর চেয়ে যদি আবৃত্তি করতাম ভালো হত।”
মা বলেন, “সবার সামনে গুছিয়ে কথা বলতে পারাটাও তো শেখা উচিত নিনো।”
মায়ের কথা শুনে চুপ থেকে নিনো। ঠিক বলেছে মা।
“নিনো, তোমার বইয়ে রবি ঠাকুরের যে কবিতাগুলো আছে পড়েছো কখন?” জিজ্ঞাসা করেন মা।
নিনো বলে “হ্যাঁ, পড়েছি।”
“তাহলে রবি ঠাকুরকে নিয়ে দু কথা বলতে গেলে কাউকে জিজ্ঞাসা করতে হয় না সোনা। কবিগুরুর সব কবিতায় তুমি রবি কবিকে পাবে। যদি মন দিয়ে পড় তবেই। বড় হয়ে দেখবে নিনো, কবিগুরুর এক একটা কবিতায়, গল্পে, গানে তিনি এক এক রকম ভাবে ধরা দেবেন তোমার মনে। আবার ভাবনার সীমিত ক্ষেত্র থেকে আমাদের কাছে কখনও তিনি অধরাও থেকে যান বৈকি।”
নিনো একরাশ জিজ্ঞাসা নিয়ে চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। ছেলের মনের কথা পড়তে পেরেছেন মা। দুই চোখ বন্ধ করেন নিনোর মা। মিষ্টি গলায় বলতে থাকেন রবীন্দ্রনাথের কবিতা। ‘গগনে গরজে মেঘ…।’ শান্ত হয়ে শোনে নিনো। মায়ের গায়ের কাছে সরে এসে বসে। কেমন এক আবেশি মায়ায় আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। চোখের সামনে বর্ষাকালের ঘন কালো মেঘ হাজির হয়। সামনের বাগানের গাছপালাগুলি বর্ষার আনন্দে মাতোয়ারা যেন। পুকুরটি কিছু সময় পরেই নদী হয়ে ওঠে। কে যেন ছোট পানসি নিয়ে ভেসে চলে নদীর বুকে। দেখতে দেখতে দুচোখ জলে ভরে আসে নিনোর। জড়িয়ে ধরে মাকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে। নদীর ওপারে কাটা-ধান নিয়ে একলা দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটার কথা ভেবে কষ্ট হয় নিনোর। ছেলের কপালে চুমু খায় মা। জড়িয়ে ধরে।
নিনো বলে “মা, কবিতা পড়লে মনে ছবি আসে জানো। এইমাত্র আমি গোটা কবিতাটার খুব সুন্দর একটা ছবি দেখতে পেলাম।”
নিনোর দু চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে মা বলেন, “আসলে কবিতায় শব্দের অর্থ হৃদয়ে সঠিক ভাবে উপলব্ধ হলে মানসপটে ছবি ভেসে ওঠে। রবীন্দ্রনাথ হলেন সেই ছবি।”
গম্ভীর হয়ে ভাবতে থাকে নিনো মায়ের কথা। কিছু বোঝে। না বোঝাও থাকে কিছু।
ছেলেকে ভাবনার জগতে ঘুরতে দেখে ভিতর ঘরে চলে যায় মা। বারান্দায় বসে কবিতা বইয়ের পাতা উলটাতে থাকে নিনো। একটা কবিতা তার পড়তে খুব ভালো লাগে। এক মনে পড়া শুরু করে, “এসেছে শরৎ হিমের পরশ…।” পড়ে চলে নিনো। কবিতার শব্দে ছন্দে ভেসে যায় কোন সে অচিন দেশে। প্রাণচঞ্চল প্রকৃতি জাপটে ধরে নিনোকে। নিখিল বিশ্বের উন্মুক্ত প্রান্তরে আনন্দে খিল খিল করে হেসে ওঠে নিনো। কত কথা বলে আমলকী গাছের সঙ্গে। কচি ধানের শীষে হাত বুলিয়ে দেয়। ফুলের ঘরে মৌমাছিদের আনাগোনা দেখে। শরতের মেঘ রোদ্দুর খেলা দেখে দুই হাত দু পাশে ছড়িয়ে কাকে যেন ডাকে চিৎকার করে।
“কি করছ নিনো সোনা? চুপ করে গেলে। কবিতা পড়ছো না?” মা এসে জিজ্ঞাসা করেন।
নিনো বলে, “মা জানো রবীন্দ্রনাথ মানে নীল আকাশ। সবুজ ঘাস। শীতল হাওয়া। টলটলে দীঘি। মৌমাছির গুনগুন। রবীন্দ্রনাথ হলো একটা ….।”
নিনো কবিতা পড়ে ওর মতন করে চিনতে শিখছে রবীন্দ্রনাথকে। রবীন্দ্রবিশ্বে পা ফেলা শুরু হয়েছে নিনোর। ধীরে ধীরে উন্মোচিত হবে রবীন্দ্র-জগত। খুশি, খুব খুশি নিনোর মা। ছেলের পাশে এসে বসে। হাত বুলিয়ে দেয় নরম চুলে। সে সবে মন নেই নিনোর। একমনে বলে চলে তার ভাবনায় ভেসে আসা কথা। কিশোর মনের বেলাভূমিতে কবিগুরুর যে ছবি ফুটে উঠেছে ছেলের মুখের সাজানো কথায় সে চিত্র চাক্ষুষ করেন নিনোর মা।