মানতবৃক্ষ – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

মানতবৃক্ষ       (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

দেখতে দেখতে আমি একটা মানতবৃক্ষ হয়ে উঠলাম। চারটে কেমো নেবার পর  ডাক্তার বললো আপাতত হসপিটালে না এলেও চলবে। অর্থাৎ ঘুরিয়ে শুনিয়ে দিলো এরপর আমার বাঁচা মরা উপরওয়ালার মর্জি। তারপর থেকে প্রায় রোজই বিভিন্ন দেব বা দেবীর মন্ত্রপূত পুষ্প মাদুলি বন্দী হয়ে আমার দুই হাতে নয়তো কোমড়ে বেঁধে দিতে লাগলো আমার স্ত্রী। মাঝে মধ্যে মেয়েও এসেছে প্রসাদী ফুল বা স্নানজল নিয়ে। গলাতে ঝুলিয়ে দিয়ে গেছে বেশ কয়েকটি মাদুলি। সব চেয়ে বড় যে মাদুলি গলায় ঝুলছে সেটা আসলে মহামৃত্যুঞ্জয় কবজ। সেটিও আমার মেয়েই এনেছে। এখন নিজেকে দেখলে মনে হয় কোনো তীর্থস্থানের নিম বা বট গাছ। যার ডাল পালায় মনস্কামনা পূরণের জন্য লোকে গুলটি বেঁধে দিয়ে গেছে। অর্থাৎ নিজেকে আমার মানতবৃক্ষ বলেই…।
শুধু দেব দেবীতেই থেমে থাকেনি আমার স্ত্রী। পীরের দরগায় সিন্নিও চড়িয়েছে। সেখানের তাবিজ আমার বাম হাতের বাহুতে রয়েছে। একটি নয়, তিন-তিনটি তাবিজ। মানে জীবনমৃত্যুর দৃশ্যমান সীমারেখায় যখন আমি দাঁড়িয়ে তখন হিন্দু-মুসলিম দুই ধর্মের উপরেই আস্থা রেখেছে আমার পরিজনরা।
এসব বিষয়ে আমিও না বলিনি। হ্যাঁ বা না বলবার মত অবস্থায় আমি নেই। নিজের বিচারবুদ্ধি বন্ধক রেখেছি আমার স্ত্রী, মেয়ে আর আমার জামাই দিবাকরের কাছে। ভীরু মনটা নিয়ে অপেক্ষায় থাকি অলৌকিক কিছু যদি ঘটে। আর সাক্ষী হিসাবে বসে থাকে হারাই। আমার সামনেই থাকে। হারাই আমার জমি দেখাশোনা করে।

আসলে কি হলো, মাস চারেক আগের কথা। হঠাৎ করেই রক্ত বের হোলো আমার মুখ দিয়ে। একটা দমকা কাশি আর তার সঙ্গে বেশ খানিকটা তাজা থকথকে রক্ত। এমনি রক্ত দেখলেই আমার শিরদাঁড়া দিয়ে হিমস্রোত নামে। রক্ত নিজের হোক বা অপরের, রক্তই তো। কিছুতেই দেখতে পারিনা চেয়ে। তা সেই থকথকে রক্ত দেখে মাথা ঘুরে গেল আমার। নিজেকে কোনো রকমে সামলে নিয়ে বসে পড়ি বাড়ির উঠানে। শরীরও ঘেমে উঠেছে। স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে ডেকে আনলো সুধীরকে। আমাদের অজ গ্রামের সেই একমাত্র ডাক্তার। হাতুড়ে হলেও আপদে বিপদে লোকে সুধীরকেই ডাকে। প্রেসার মেপে সুধীর বললো, রক্তচাপ সামান্য উপরের দিকে। হয়তো সে কারনেই এই রক্ত। নাকে না এসে মুখে এসেছে। স্ত্রী দুহাত জড়ো করে কপালে ঠেকিয়ে দত্তবাড়ির  দুর্গাকে স্মরণ করে ঈশানকোণে প্রণাম ভাসিয়ে দিলো। রক্ষা করেছে মা দুর্গা। ভাগ্যিস রক্ত মাথায় পৌঁছানোর আগেই মুখে এসেছে। নয়তো মৃত্যু নিশ্চিত! ঘটনাটা সঙ্গে সঙ্গে ফোন করে আমার মেয়েকে শোনালো ওর মা। উদ্দেশ্য দিবাকরের পরামর্শ নেওয়া। সে মুহূর্তে তা আর সম্ভব হয়নি। দিবাকর ব্যস্ত। রাতের আগে কথা বলা যাবে না।
ব্যপারটা হারাই শুনেছিলো দুপুরে। এসেছিলো আমাকে দেখতে। বললো, ডাক্তার দেখাও মেজোবাবু। এ রোগ ফেলে রেখো না। আমার বাপেরও হয়েছিলো। প্রথমে সামান্য রক্ত বের হয়েছিল মুখ দিয়ে।
— তারপর?
— তারপর আর কি চুপচাপ বসে ছিলো, জ্বালা নেই যন্ত্রণা নেই। ভেবেছিলো পেট গরম নিশ্চয়। ডাব, মিছরির জল সবই হোলো কিছুদিন।
— তারপর?
— তার অনেক পর, ধরো মাস চারেক পর শুরু হলো বাপের কষ্ট আর আমার ছোটাছুটি। সে তো তুমি জানো।
— হ্যাঁ
আমি জানি। হারায়ের  বাপটা খুব কষ্ট পেয়ে মরেছে। শেষ দিকে কাশির প্রত্যেক ধাক্কায়…।
তবুও জানতে চাইলাম, তারপর?
— ওতো ভেবো না মেজোবাবু, তুমি দেরি না করে ডাক্তার দেখাও। আল্লাহ যেনো খারাপ কিছু না করে। তুমি ডাক্তার দেখাও।

রাতের বেলায় পরামর্শ এলো দিবাকরের কাছ থেকে। পরপর কয়েক দিন রক্তচাপের উপর নজর রাখতে হবে। বাকিটা তারপর।
মেয়ে বললো তোমার স্নানের বহর কমাও। ওই গ্রামে পড়ে থাকো। চিন্তা হয়। তোমার জামাইও সেই কথাই বলে।
দিবাকর আমার কথা ভাবার সময় পায় কিনা জানি না। তবে সুধীর রোজ এসে প্রেসার মেপে দিয়ে গেলো কয়দিন। গোলমাল নেই প্রেসারে। কথাটা শুনে দিবাকর বললো ইটস ফাইন, চিন্তার কিছু নেই।
থকথকে রক্তটা আমার মনে ভয়ের অস্পষ্ট দাগ রেখে শুকিয়ে গেলো। এদিকে চাষের সময় এসেছে। বসে থাকলে চলবে কেনো। ব্যস্ত হয়ে পড়লাম আমি। হারাই বললো চাষ আমি সামলে দেবো, তুমি ডাক্তার…।

হারাই আমার কাছের লোক। সেই ছোট্টবেলা থেকে  আমার জমি দেখাশোনা করছে। জমির  ফসল গোলায় ওঠে ওর জন্যই। দু চারটে গরু দুবেলা খোল, খড় পায় সেও ওর জন্যই। সব বিষয়েই আমি হারায়ের সঙ্গে আলোচনা করি। আসলে শান্তি পাই কথা বলে। এর জন্য আমাকে নানা কথা শুনতে হয় স্ত্রীর কাছে। তবে এ ব্যপারে সবচেয়ে ভালো কথা বলে দিবাকর। আমাকে বলে চাষা। নিজের কানে আড়ালে থেকে শুনেছি।
সেকথা হারাই শুনে বলে, না মেজোবাবু, এ ভারি অন্যায়। তুমি মাস্টার মানুষ, চাষা বলবে কেনো? জমি চাষ করলেই কি চাষা? এ ঠিক নয়।
হারাই ঠিকই বলেছে। তিরিশ বছরেরও বেশি আমি শিক্ষকতা করেছি। আমার গ্রামের প্রাইমারি স্কুলে। অবসর নিয়েছি বছর দুয়েক আগে। তবে দিবাকরের কথায় আমি মনে করিনা কিছু। অমন স্মার্ট ছেলে। বড়ো কোম্পানির চাকরি। হাজার দায়দায়িত্ব। তার কাছে আমি চাষা ছাড়া আবার কি। আমার স্ত্রী বলে, লাখে একটা মেলে অমন জামাই। গ্রামের সবাই নাকি বলে সে কথা।
যাইহোক এরপর দিব্যি ছিলাম। কোনো সমস্যা নেই। হারাই কিন্তু রোজ বলে সেই এক কথা। হারাই বললেই তো হোলো না। দিবাকর কি বলে শুনতে হবে। বাড়িতে একদিন বললাম হারাই বলছে চাষ সামলে দেবে। আমার ডাক্তার দেখানো উচিত। রক্ত বের হবার বিষয়টা হেলাফেলা করা উচিত নয় মোটেই। কথাটা আমার স্ত্রীর কাছ থেকে মেয়ের কাছে গেলো। তার থেকে দিবাকর। পরদিন স্ত্রী আমাকে বললো দিবাকর মেয়ের কাছে তোমার কথা শুনে হেসেছে। অর্থাৎ…।

এরপর কেটে গেছে কয়েক মাস। একদিন সকালে উঠে দেখি গলার স্বর গেছে পালটে। নিজের ইচ্ছে মতো জিভটাকে নাড়াতে পারছি না।
ঠাণ্ডা লেগেছে, গার্গেল করাও। মেয়ে বললো মাকে। তেমন ভাবে চললো দিন কয়েক। সঙ্গে বুকে হালকা ব্যথা। কিছুদিন পরে গলার অবস্থা আরো শোচনীয় হোলো। সাজানো কথা গলায় এসে হোঁচট খেয়ে থমকে দাঁড়ায়। কথা বলতে পারি না কিছুতেই।
কেমন একটা ভয় ভয় ভাব ঘুর ঘুর করতে লাগলো আমার চারপাশে। অস্পষ্ট রক্তের দাগটা যেনো স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে উঠানে। দুয়ারে বসে ছিলাম। সন্ধ্যা জ্বালানোর আয়োজনে ব্যস্ত আমার স্ত্রী। হারাই গলা নামিয়ে বললো একদম আমার বাপের মতো হচ্ছে তোমার মেজবাবু, আমার ভালো ঠেকছে না। আল্লাহ মালিক। তুমি ডাক্তার…।
আমার স্ত্রীর মুখে সবটা শুনে দিবাকর বললো, একজন নাক-কান গলার ডাক্তার দেখালেই চলবে। এটা তেমন কিছু নয়।
এরপর ঘটনা এগোতে থাকলো খুব তাড়াতাড়ি। শহরের ডাক্তারের ওষুধে সাড়া দিলো না গলার ব্যামো। এতদিনে আমার স্ত্রী সামান্য হলেও ভয় পেতে শুরু করেছে। দিবাকর বললো চিন্তার কিছু নেই। সামনের সপ্তাহে কোম্পানির কাজে চেন্নাই যাবো, ওখানেই ট্রিটমেন্ট করিয়ে আনবো। ভয় পেলাম। দিবাকর ব্যস্ত ছেলে। কোম্পানির কাজে মেতে থাকবে। আর আমি কি একা সামলাতে পারবো ডাক্তারের ঝামেলা। তাই বললাম হারাইকে সঙ্গে নিলে কেমন হয়। দিবাকর রেগে গেলো। ড্যাম ইউর হারাই। আরো অনেক কথা বললো। আমি আর কিছু বলার সুযোগ পাইনি। স্ত্রী আর মেয়ে বললো দিবাকরের উপর ভরসা রাখো। এরপর…।
নিজের কাজ আর আমাকে সামলাতে বেশ বেগ পেতে হয়েছিলো দিবাকরকে। তবুও আমার চিকিৎসার কোনো ত্রুটি রাখেনি। ডাক্তার, বিভিন্ন টেস্ট তারপর ইংরেজিতে কথা এসব হারাই কি পারতো, না নিশ্চয়। ততদিনে আমার কথা বলা প্রায় বন্ধ হয়ে এসেছে। বুকের উপরের দিকে আর ডান দিকের পাঁজরের যন্ত্রণাও অসহ্য হয়ে ওঠে সময়ে সময়ে। একদিন হসপিটাল থেকে ফিরে খুব কষ্টে জিজ্ঞাসা করলাম আমার কি হয়েছে দিবাকর? প্রশ্ন শুনেই রেগে গেলো দিবাকর। বললে, কি করে বলবো বলুন। আগামী কাল  রিপোর্টস পাওয়া যাবে। ডাক্তার কি বলে দেখি। আর এই অবস্থায় জোর করে কথা বলার প্রয়োজন কি আছে। আমার সাহস হয়নি আর কিছু জিজ্ঞাসা করার। হতে পারে কোম্পানির কাজের চাপের মধ্যে থেকে আমাকেও সামলাতে হচ্ছে তাই হয়তো মেজাজ মাপের মধ্যে নেই। তবে সেই রাতে আমার ঘুমানোর ব্যবস্থা করেছিল দিবাকর। সারা রাত টের পাইনি যন্ত্রণা। গভীর ঘুম জাপটে ছিলো আমাকে। ঘুমের ওষুধ নাকি দিবাকরের সঙ্গেই থাকে।

পরদিন আমি হোটেলেই ছিলাম। হসপিটাল যাবার প্রয়োজন হয়নি। রিপোর্ট দিবাকর আনবে। সারাদিন মনের মধ্যে তীব্র উৎকণ্ঠা। আর হারায়ের কথাটা কানে বাজে। ওর বাপের নাকি আমার মতই লক্ষণ ছিলো।
দিবাকর ফিরলো সন্ধ্যার দিকে। হাতে আমারই রিপোর্ট এর ফাইল। কথা বলতে  সাহস পাচ্ছি না। আবার নিজেকে সামলানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। দিবাকর আমার অবস্থাটা আঁচ করেছে হয়তো। আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ভালো খবর। কাল আমরা ফিরে যাচ্ছি। শুকনো গলায় বলতে চেষ্টা করলাম আচ্ছা। পারিনি। দিবাকর সামনে দাঁড়িয়ে। এইবার আবার সাহস করে জিজ্ঞাসা করার চেষ্টা করলাম, আমার কি হয়েছে দিবাকর? আমি যে এই প্রশ্ন করবো টের পেয়েছে দিবাকর। কাকে যেনো ফোনে হ্যালো হ্যালো বলতে বলতে রুমের বাইরে চলে গেলো। রিপোর্টের ফাইলটা বিছানার উপর পড়ে। সাহস নিয়ে দেখলাম বেশ কিছুক্ষন। লাং, টিউমার, বায়োপসি, চেষ্ট, পেন, কার্সিনোমা সমস্ত বোধ্য শব্দ গুলো কেমন ভাবে সুতীব্র ভয়ের অর্থ সৃষ্টি করেছে। এক অদ্ভুত অনুভূতি আমাকে  নির্জন মৃত্যু উপত্যকায় হাজির করলো। আমি বুঝেছি আমার কি হয়েছে। এরপর…।

যন্ত্রণা চব্বিশ ঘণ্টার সঙ্গী হোলো। দিবাকর বললে তিন কি চারটে কেমো নিলেই মনে হয় সুস্থ থাকবেন। এই প্রথম দিবাকরের গলায় সর্বক্ষণের সেই তেজটা আর নেই বলে মনে হোলো। কলকাতায় মেয়ের বাড়িতে থেকেই কেমো নিয়ে ফিরলাম গ্রামে। দিবাকর বললে সাবধানে থাকতে হবে। তবে আপনার প্রবলেমগুলো প্রথমেই শুনলে একবার বোম্বেতে ট্রাই করা যেতো, এনিওয়ে…।

ততদিনে আমি বুঝেছি চিকিৎসা শেষ হয়েছে। এইবার শুধু দিন গোনা। সব শুনে ভেঙে পড়েছে আমার স্ত্রী। মেয়ে মাঝে মাঝেই আসে। একাই এসে দেখে যায় আমাকে। আমিও দিনে দিনে মাদুলি, তাবিজ আর কবজ নিয়ে মানতবৃক্ষ হয়ে উঠছি। একদিন খুব সকালে আমার মেয়ে এসে আমার গলায় বড়ো মাদুলি ঝুলিয়ে দিয়ে  বললো দিবাকর আসাম গিয়েছিলো। এক বিখ্যাত তান্ত্রিক দিয়েছে, মহামৃত্যুঞ্জয় কবজ। সকাল সন্ধ্যা প্রণাম করবে। সুস্থ হয়ে যাবে ঠিক। সেই শুরু। তারপর থেকে রোজ মহামৃত্যুঞ্জয় কবজটাকে প্রণাম করি আর দু চোখের সামনে ভেসে ওঠে রক্তের দাগ। কানে ভেসে আসে হারায়ের কথাগুলো। আপাতত বিছানাতেই আমার রাত দিন কাটে। যন্ত্রণা আর রক্ত দুই হাজির। হারাই দু বেলা আসে আমাকে দেখতে। মুখে কিছু বলে না। শুধু তাকিয়ে থাকে আমার মহামৃত্যুঞ্জয় কবজের দিকে। নীরব আমি। মানতবৃক্ষ সেজে প্রহর গুনি প্রহর শেষের আশায়।