বৃষ্টিভেজা কাঠগোলাপ – কামরুল হাসান

বৃষ্টিভেজা কাঠগোলাপ     (ছোটোগল্প)

কামরুল হাসান

“সন্ধ্যা নামে পা ছোটে মেয়েটির আছে তাড়া
চমকে উঠে থমকে দাঁড়ায় হঠাৎ যায় খাড়া।

ঝরে পড়া কাঠগোলাপ, কে দেবে তাহার মূল্য
হাতে তুলে সযত্নে ওর কাছে যেন পূজো-তুল্য।

কাঠগোলাপের কঠিন মায়া কাড়ে মেয়েটির প্রাণ
সাদা সাদা পাঁপড়ি কী মিষ্টি মোলায়েম তার ঘ্রাণ।”

কাঠগোলাপের গাছটির কাছে আসলেই চঞ্চল মেয়েটির মন যেন আরো চঞ্চল-অস্থির হয়ে উঠে। দৌড়ে কাছে যায়, যেন অন্য কেউ নিতে না পারে।
পড়ে থাকা ফুল চোরের মতো লুকায় হাতের মুঠোয়। ডানে-বামে তাকায়। ও ভাবে, পরে না ফুল-চুন্নির অপবাদ জোটে ভাগ্যে! কারণ দেয়ালে লেখা, “ফুল ছিঁড়বেন না, ফুল ছিঁড়া নিষেধ” – আদেশক্রমে কর্তৃপক্ষ।

যা হোক, বিব্রতকর পরিস্থিতি পেরিয়ে স্বস্তির শ্বাস ফেলে ফের হাঁটা দেয় মেয়েটি। যেতে যেতে আলতো করে ফুলের ঘ্রাণ নিতে থাকে ও। শুভ্র সুন্দর ফুল আর মায়াবী মুখের মিষ্টি হাসি — কী যে ভালো লাগে, একেবারে মাখোমাখো অবস্থা!

ফুল তো আর প্রতিদিন ঝরে না। যেদিন ফুল পায় না, সেদিন বেশ মন খারাপ হয় ওর, যেন শরতের নীল আকাশে অকস্মাৎ কালবৈশাখীর থাবা!
হ্যাঁ, কাঠগোলাপকে কেন্দ্র করে একটি মিষ্টি প্রেমের গল্পই বলছি এখন।

মহাসড়ক। একটু ভিতরে প্রবেশ করলেই আঁকাবাঁকা সরু সড়ক। সড়কের ধারে কারখানা। কারখানার ভবনের মাঝ একটু চিপা জায়গা। সেই চিপায় অপুষ্টিতে বেড়ে উঠছে কাঠগোলাপের একটি গাছ। গাছটি বাঁচবে কি না — সেটা নিয়েই ঘোরতর সন্দেহ ছিল খোদ কারখানার কর্তৃপক্ষের!

তবে কর্তৃপক্ষের শঙ্কাকে কর্ণপাত না করে কাঠগোলাপের গাছটি সুরভি ছড়াচ্ছে চারিদিকে। আর এই কাঠগোলাপের রঙে-ঘ্রাণে-সুবাসে মুগ্ধ হয়ে নিজেকে সমর্পণ করেছে পথচারিণী একটি মিষ্টি মেয়ে।

মেয়েটি প্রতিদিন সন্ধ্যায় এই পথে যাতায়াত করে। আর সে সময় পাশের মাঠে ক্রিকেট খেলা দেখে মহল্লার একটি ছেলে। নাম ওর মুরাদ। দিনে দিনে কাঠগোলাপ-পাগল মেয়েটির প্রতি এক ধরনের ভালোলাগা তৈরি হয় মুরাদের। মাঝে মাঝে চোখাচোখিও হয় দুজনের। একদা বিনিময় হয় মুচকি হাসিও।

ভালোলাগার কল্পনায় মুরাদ ভাসতে থাকে মেঘের ভেলার মতো সমস্ত আকাশজুড়ে। খাবার দেখলে উপোস থাকা ব্যক্তির চোখ যেমন চকচক করে উঠে, পেটের মাঝে করে উঠে আড়ুবাড়ু, মেয়েটিকে দেখামাত্র মুরাদেরও তেমনি বুকের ভিতর দরফর করতে থাকে, অশান্ত হয়ে উঠে হৃদযন্ত্র!

মেয়েটির কাঠগোলাপের প্রতি কঠিন ভালোবাসা দেখে মুরাদের মন বেজায় ভার! বাড়ে আফসোস! আক্ষেপ কোরে ও মনে মনে বলে….

“আহা, হতাম যদি হলুদাভাব এই অপূর্ব কাঠগোলাপ
ছোঁয়া পেয়ে আদর পেয়ে তার সাথে জমত যে আলাপ।

অপার সৌন্দর্যে কাঠগোলাপ যেমন করে বসবাস
তোমার হৃদয়ে ফেলি আমি তেমন বাঁচার দীর্ঘশ্বাস।

বলবে স্বজন বলবে লোকে দুজনকে মানিয়েছে তো বেশ
জানবে সবাই হে কাঠগোলাপ কারণ তুমি-ই তো শেষ-মেশ”


সেদিন ছিল বুধবার। চৈত্র মাস। সকাল থেকে আকাশজুড়ে মেঘেদের আনাগোনা। সন্ধ্যায় হঠাৎ করেই গুড়ুম-গুড়ুম শব্দ। সবাই বাসায় চলে গেছে। মেয়েটাকে দেখার আশায় মুরাদ চেয়ে আছে চাতক পাখির মতো। ওর চোখ যায় কাঠগোলাপের গাছের পানে। ডালপালা বাতাসে দোল খাচ্ছে। একটা একটা ফুল ঝরে ঝরে পড়ছে। ও ভাবে, এই ফুলগুলোও তো মায়ার হাতে সযতনে কুড়াবে মেয়েটি।

মেঘের গর্জন বেড়েই চলছে। তবু মেয়েটার দেখা নেই। মুরাদ ভাবে, তবে কি ও আজ বিকল্প পথে…। এটা-সেটা ভাবছে মুরাদ।

ওই তো মেয়েটা আসছে। কাছাকাছি এলো। হলো চোখ-সংযোগ। মেয়েটা যায় কাঠগোলাপের দিকে, মুরাদ এগোয় মেয়েটার কাছে।

মেয়েটি একটি ফুল হাতে নিতেই কানফাঁটা বজ্রপাত। মেয়েটি ভয়ে জাপটে ধরে মুরাদকে। পরপর আরো কয়েকটি বিকট শব্দে বজ্রপাত, সঙ্গে তুমুল বৃষ্টি। ল্যাম্পপোস্টের আলো নিভে গেছে। মেয়েটি আরো শক্ত করে মুরাদকে জড়িয়ে ধরছে। অভয় দিতে মুরাদও মেয়েটিকে দু বাহুতে নিয়েছে বুকে টেনে। এমন বিপদের মাঝেও বৃষ্টিভেজা কাঠগোলাপটি কিন্তু বিপদমুক্ত। মেয়েটি অতি সতর্কতার সাথে ফুলটি ধরে রেখেছে মুরাদের বুকের উপর! মুরাদ থুতনি বুকে আটকে চোখ নিচু করে খেয়াল করে কাঠগোলাপটি। ওর ঠোঁটের কোণে বিশ্বজয়ের সুখের হাসি!

প্রবল বর্ষণে পায়ের গোড়ালি পর্যস্ত ডুবে গেছে দুজনের। আতঙ্কিত মেয়েটি কিছুই বলছে না। আর মুরাদ অনেক কিছুই বলতে চেয়েছিল। কিন্তু এই মুহূর্তে হারিয়ে গেছে ওর সব কথা। দৃশ্যটি কবিগুরুর “এক রাত্রি” গল্পের নায়ক এবং নায়িকা সুরবালার সেই রাত্রির মতোই…

“আর-সমস্ত জলমগ্ন হইয়া গেছে কেবল-হাত-পাঁচ ছয় দ্বীপের উপর আমরা দুটি প্রাণী আসিয়া দাঁড়াইলাম।

তখন প্রলয়কাল, তখন আকাশে তারার আলো ছিল না এবং পৃথিবীর সমস্ত প্রদীপ নিবিয়া গেছে– তখন একটা কথা বলিলেও ক্ষতি ছিল না– কিন্তু একটা কথাও বলা গেল না। কেহ কাহাকেও একটা কুশল প্রশ্নও করিল না।”