অলৌকিক অন্ধকারে (ছোটোগল্প)
বিজয়া দেব
ডাক্তার এক্স রে-র ছবিটা পেশেন্টকে দেখিয়ে বললেন, দেখুন আপনার পিঠের ছবি। মেরুদণ্ড বেঁকে গেছে। এবার আসুন হাতে। আপনার ডান হাত বেঁকে গেছে। এবার আসুন পায়ে। ডান পা বেঁকেছে, হাঁটুর অবস্থা খুব খারাপ। এই অবস্থায় আপনাকে নিয়ে যে কী করি! হাঁটু অপারেশন লাগবে। তাহলে চলাফেরাতে থাকতে পারবেন।
মিনতি আঁতকে উঠল। বলল — না না ডাক্তারবাবু, আমি অপারেশন করাব না।
— করাবেন না? কেন?
— বাড়িতে খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে যাবে।
— সে তো হবেই। আগে কিংবা পরে। গাড়ির মেশিন যখন খারাপ হয়ে যায় তখন কলকব্জা মেরামত করে দিলে আরও কিছুদিন চলে। নাহলে দেখবেন রাস্তার পাশে কিছু গাড়ি ফেলে দিয়ে চলে যায় মানুষ। আমার কথা কি বুঝতে পারছেন?
মিনতি চিন্তিতভাবে মাথা নাড়ে।
ডাক্তার বলেন — ভেবে জানাবেন।
মিনতি বাড়ি ফিরে দেখে রবি এখনও কাজে বেরোয়নি। দুটি যুবক তার পাশে বসে। গুজগুজ ফিসফিস চলছে। বুকটা কেঁপে ওঠে তার। পিঠে একটা চাপা ব্যথা। ডাক্তার ডাক্তারের কথা বলেছে, কিন্তু তার কাছে গোটা চিকিৎসার ব্যাপারটা অদ্ভুত ও অবাস্তব ছাড়া কিছুই নয়। মিনতির বর মানে রবির বাবা রসময় তার পুঁথি-পত্র নিয়ে গেছে ধান্দায়। পথের পাশে বসে হাত দেখবে কোষ্ঠীবিচার করবে। মিনতি ভাবে কাকে বলবে সে নিজের অসুবিধের কথা। আচ্ছা, রবি ও তার বন্ধুদের সাথে ব্যাপারটা নিয়ে খোলামেলা আলাপ করে দেখা যেতে পারে। রবির চেহারা দিনে দিনে পালটে যাচ্ছে। একটা বদল এসে গেছে বেশ কিছুদিন হল। তার মতই দেখতে রবি। নরমসরম কোমলভাব আছে। আছে বললে ভুল হবে, ছিল। দেখতে দেখতে ছেলেটার ভোল পালটে গেল। কোনরকমে বি এ পাশ করেছিল। তারপর চাকরির চেষ্টা করে করে যখন হয়রান তখন রসময় এলাকার প্রভাবশালী হারুবাবুর দ্বারস্থ হয়েছিল। এরপর থেকে রবি আরেক জগতে চলে গেছে। মাঝেমধ্যে কিছু টাকা এনে দেয়। একসাথে পাঁচ হাজার সাত হাজার এইরকম। তবে তার কোনও স্থিরতা নেই। টাকা থেকেই ডাক্তার দেখানো, এক্স রে ইত্যাদি হল। নাহলে মিনতির সর্বাঙ্গে ব্যথা তো আর আজকের নয়। হ্যাঁ ইদানীং বেড়েছে। এদিকে ঘরের কাজের খামতি নেই। ব্যথার কথা তেমন করে বলাও যায় না, রসময় রবি দুজনেই বিরক্ত হয়। রবি তো বলেই ওঠে — ওসব ব্যথা বেদনা থাকবে। ঘ্যানঘ্যান করো না তো।
যদিও তারপর একদিন টাকা হাতে দিয়ে বলল — ডাক্তার দেখিয়ে নিও এর থেকে।
এই টাকা কোথা থেকে আসে? কেন আসে? ও কি কাজ করে হারুবাবুর কাছে? রসময়কে এসব প্রশ্ন মিনতি করে। রসময় শুনে না শোনার ভান করে। একদিন রেগে বলল — আমি কী করে বলব? তোমার মতই আমি কিছুই জানি না। তাছাড়া এত জেনে কী করবে দুপয়সা ঘরে আসছে, সেটা কি যথেষ্ট ভালো ব্যাপার নয়?
এই যথেষ্ট ভালো ব্যাপারটির জন্যে রসময় হারুবাবুর কাছে যায় না। জিজ্ঞেস করে না রবি ঠিক কী কাজ করে। সারাদিন কোথায় থাকে। মাঝেমাঝে রাতেও বাড়ি ফেরে না কেন। মিনতির বুক ঢিপঢিপ করে। রাতে ভালো ঘুম হয় না। রাতে দুঃস্বপ্ন তার বিছানার চারপাশে সাঁতার কাটে। এভাবেই দিনের পর রাত আসে, রাতের পর দিন।
রবির ঘরের দরজা ভেজানো। ভেতর থেকে কথা আসছে খুব তরল আওয়াজে। মিনতি একটু নক করল দরজায়। ভেতর থেকে রবির গলা — কে?
— আমি বাবা।
রবি বেরিয়ে এল।
— খুব দরকার মা? ইমারজেন্সি?
— হ্যাঁ বাবা। তুই তো বেরিয়ে যাবি। তারপর কখন ফিরবি কে জানে!
রবি একটু ভাবল। তারপর বলল ঠিক আছে চল তোমার ঘরে চল। তারপর ভেজানো দরজাটা একটু খুলে বলল — আমি একটু ভেতরে যাচ্ছি।
অই একচিলতে খোলা দরজার ফাঁকে ইস্পাতের মত কিছু ঝলসে উঠতে দেখল মিনতি। বুকের ভেতর রক্ত যেন এক ঝলকে বুকের মাঝখানে খামচে ধরল। পড়ে যেতে যেতে সামলে নিল কোনক্রমে। রবির সেটা চোখে পড়ল না।
মিনতির হাঁফ ধরছিল, পিঠের ব্যথাটা চাগাড় দিয়ে উঠছিল, ভেতর ঘরে ঢুকে রবি বলল — বলো, কি বলতে চাইছিলে।
মিনতি প্রেসক্রিপসন দেখায়, এক্স রে রিপোর্ট দেখায়, হাঁটু অপারেশন এর ব্যাপারটা নিয়ে বলে।
রবি সবকিছু দেখেশুনে বলে — মা আজ রাতে আমি ফিরব না। যদি অপারেশন সাকসেসফুল হয় তবে তোমার নি রিপ্লেস হবে এটা জেনে রেখো।
মিনতি কেঁপে ওঠে বলে — কীসের অপারেশন বাবা?
রবি মায়ের দুহাত ধরে মা-র চোখে তাকিয়ে থাকে কয়েক পলক। তারপর বলে — সে আছে। দেখা যাক। আপাতত আমাদের কিছু খেতে দাও।
রাত গভীর হলে কত কী প্রাকৃতিক শব্দ শূন্যে ভাসে। মিনতির চোখে ঘুম নেই। রবি আজ কি করতে যাচ্ছে? বিছানায় রাখা ঝকঝকে ইস্পাতের আলো তার চোখ ধাধিয়ে ছিল। ছুরি ছিল? দুটো ষণ্ডামার্কা ছেলেকে সে চেনে না। আগে কখনও দেখেনি। “অপারেশন সাকসেসফুল ” বলতে কী বোঝাতে চাইল ছেলে? মিনতি কুলকুল করে ঘামছে। রাতজাগা পাখির ডানা ঝাপটানোতে কেমন এক অলৌকিক অন্ধকার। ঘুটঘুটে অন্ধকারের ভেতর সরু টর্চের আলো এগোচ্ছে এগোচ্ছে একটা আর্ত চিৎকার… রসময় ধাক্কা দেয় মিনতিকে। কি হল? বোবায় ধরেছে?
মিনতি বিছানায় উঠে বসে। একগ্লাস জল এনে দেয় রসময়। বলে — খাও। সারাদিন উল্টোপালটা ভাবো। আরে, যে করেই হোক ছেলে তো হাতে তুলে দু’ পয়সা দিচ্ছে, না কি?
মিনতি কি আজকের কথাটা বলবে রসময়কে? নাহ থাক। বলে কোনও লাভ নেই। অকর্মা লোকটার সেই রকম ভাবনাচিন্তা করার ক্ষমতাও নেই। অই জ্যোতিষ করে করে দু’পয়সা রোজগার করেছে। মিনতি একটা সরকারি অফিসে গ্রেড ফোর কর্মীর কাজ করে সংসার চালিয়েছে টেনেটুনে ছেলেকে পড়িয়েছে। এখনও সামান্য পেনসন পায়।
রসময় বলে — অত চিন্তা করে কিছু হবে না। তোমার ছেলের হচ্ছে গিয়ে বৃষরাশি। লগ্নে এখন …।
কোনও এক শক্তিমান গ্রহের নাম বলল বুঝি রসময়। তারপর বলল — গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান বলছে আর্থিক ক্ষেত্র খুব ভালো।
— তোমার ছেলে যদি আজ রাতে খুন করে?
— মানে? কী অলুক্ষুণে ভাবছ বলোতো? হারুবাবু অত খারাপ লোক নয়। কত সাহায্য করে লোকজনের।
পরদিন সকাল থেকেই থমথমে অবস্থা চারপাশের। রসময় বাজারে বেরিয়েছিল। রায়বাড়ির পুকুরের পাশে এক রক্তাক্ত দেহ উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বাজারে না গিয়েই রসময় প্রায় ছুটে বাড়ি ফিরে এল। বাজারের থলে ছুঁড়ে ফেলে সে হাঁপাতে লাগল। মিনতি বলে — কি হয়েছে? বাজারে গেলে না?
রসময় সদর দরজার দিকে তর্জনি দেখিয়ে বলে — খুন।
মিনতি বাকহারা। মিনতি তাকিয়ে আছে রসময়ের দিকে বিস্ফারিত চোখে। রসময়ও নিষ্পলক। প্রথম হেমন্তের প্রগাঢ় রোদে ভাসছে দিগ্বিদিক । শব্দহীন শূন্যতা ভেদ করে রসময় বলে ওঠে — রবি ফিরেছে কাল রাতে?
মিনতি কলের পুতুলের মত রবির ঘরের সামনে গিয়ে ভেজানো দরজাটা খোলে। বিছানায় হাত পা ছড়িয়ে ঘুমোচ্ছে রবি।
এরপর ক’দিন পাড়া ছমছমে। থানা পুলিশ মৃতদেহের ময়নাতদন্ত ইত্যাদি ইত্যাদির পর কিছুটা শান্ত পরিবেশ। এরই মাঝে রবি দু’লাখ টাকা এনে মায়ের হাতে দিল।
মৃতের পরিচয় মেলেনি। খুনির সন্ধান চলছে। পত্রপত্রিকা কিছুদিন সরগরম থেকে ধীরে থিতিয়ে গেল।
এখন মিনতি অপারেশন থিয়েটারে। চারপাশে হলদেটে আলো আর মানুষের সমাহার। সে রাতে রবির অপারেশন সাকসেসফুল হয়েছিল, অপারেশন সেরে রবি নিরুপদ্রব ঘুম দিয়েছিল। আজ মিনতির অপারেশন, সেটা সাকসেসফুল হলে সে ব্যথাহীন কষ্টহীন পদপাত করতে পারবে পৃথিবীর বুকে। কিন্তু কেন যে এই দুই অপারেশনের মাঝখানে একটা উপুড় হয়ে পড়ে থাকা রক্তাক্ত অচেনা মৃতদেহ বারবার মুখ তুলে তার দিকে তাকিয়ে তার বুকের ক্ষতকে দগদগে করে তুলছে সে জানে না, এই বলয়ে কত মুখ এমনি পরিচয়হীনভাবে অন্ধকারের বৃত্তে উপুড় হয়ে পড়ে আছে কে জানে! তারা কেন এই অপারেশন এর মুহূর্তে একযোগে তার দিকে মুখ তুলে চাইছে?
মিনতি জানে এখন তার একমাত্র সন্তান রবি তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ হাসপাতালের লবিতে তার জন্যে অপেক্ষায় আছে। মিনতি জানে রুনু নামের তরুণীটি আপাতত তার রান্নাঘর সামাল দিচ্ছে। সে সুস্থ হয়ে উঠলেই রুনু তার পুত্রবধূ হয়ে আসছে, তার পরিবারের সদস্যসংখ্যা বাড়তে চলেছে।
কেউ এসে তার চোখ বেঁধে দিল। ডাক্তার তার কপালে হাত রাখলেন। মৃদুস্বরে বললেন — অত কী ভাবছেন। দুর্ভাবনা সংকট এগুলো আছে, ছেড়ে যাবে না কখনও, ওগুলো থাকে, ওসব গায়ে জড়িয়ে চলতে হয়। আপনি আপাতত মনটাকে শূন্যে ভাসিয়ে দিন। ভাবুন আপনি আপনিই, কারওর কেউ নন। ব্যস ভাসতে থাকুন।
অপারেশন শুরু হয়েছে। লোকাল অ্যানাসথেসিয়া। শুধু শূন্যতার খোঁজে হাবুডুবু খাচ্ছে মিনতি।