গোবর্ধনের পরীক্ষা (ছোটোদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
আমাদের এলাকায় একটা হিন্দি স্কুল আছে। বেশ বড় স্কুল। হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুল। সেই স্কুলের সামনে একটা বিরাট মাঠ আছে। আর সে মাঠে ঢুকবার মুখে একটা বড় পুকুর আছে। সে পুকুরে আছে শান বাঁধানো ঘাট।
আমি পড়ি বাংলা স্কুলে। স্কুল ছুটি হলে আমি বাড়ি ফিরে কিছু খেয়ে সেই পুকুরের শান বাঁধানো ঘাটে এসে বসি প্রায়সময়ই। বসে আমি পুকুরের জলে ফড়িঙের খেলা দেখি। আজও যাচ্ছিলাম। সেখানে গিয়ে দেখি, গোবর্ধনদা পুকুর ঘাটের সিঁড়ির এক কোণে বসে কী একটা বিড় বিড় করে বলছেন আপনমনে। আমি পেছনে গিয়ে শুনতে পেলাম, গোবর্ধনদা বলছেন,
ধা ধিন ধিনতা,
না তিন তিনটা।
ধা ধিন ধিনতা,
না তিন তিনটা।
একই কথা বারবার বলে চলেছেন। ব্যাপারটা ঠিক বুঝতে পারলাম না, এটা কি তবলার কোনো বোল কিনা।
আমি গোবর্ধনদার পাশে গিয়ে বসলাম। গোবর্ধনদা আমাকে দেখেই আবার আগের মত বললেন,
ধা ধিন ধিনতা,
না তিন তিনটা।
বলেই আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, বলো তো, এই কথাগুলির মানে কী?
আমি বললাম, জানি না, তবে তবলার বোল মনে হচ্ছে।
গোবর্ধনদা উত্তর দিলেন, তবলার বোল হলে হবে না। এ কথার অর্থ বলতে হবে। নাহলে এক নাগাড়ে আমাকে তিন গ্লাস জল খেতে হবে। উফ্ জল খেতে একদম আমার ভাল লাগে না। সারাদিনে আমি কোনক্রমে এক গ্লাস জল খাই।
ব্যাপারটা কিছুই বুঝতে না পেরে আমি গোবর্ধনদাকে বললাম, আমাকে খুলে বলুন ব্যাপরটা। তারপর দেখি কথাটার কোনো মানে বের করতে পারি কিনা।
এবার গোবর্ধনদা সমস্ত ব্যাপারটা আমাকে খুলে বললেন। সকালে দাদার কথামত গোবর্ধনদা বাজার থেকে মাছ কিনে এনেছিলেন। মাছওয়ালা বলেছিল, টাটকা মাছ। বিশ্বাস করে সেই মাছ কিনে এনেছিলেন গোবর্ধনদা। বাড়িতে এলে সে মাছের গন্ধ শুঁকে হর্ষবর্ধনদা একটু ক্ষেপে গিয়ে বলে ফেললেন, তুই কীসব পচা মাছ এনেছিস, একটা কাজও ঠিকভাবে করতে পারিস না। কথাগুলি শুনে একটু খারাপ লেগেছিল গোবর্ধনদার, বলেছিল, বা রে, মাছওয়ালা বলেছিল টাটকা মাছ। বিশ্বাস করে তাই তো কিনেছিলাম।
— কেউ কিছু বললেই বিশ্বাস করবি? নিজের কি বুদ্ধিসুদ্ধি নেই!
— কে বললে আমার বুদ্ধিসুদ্ধি নেই ? তুমি তো আমার ভাল দিকটা দেখতে পাও না।
— আছে তোর বুদ্ধিসুদ্ধি ? তাহলে বল, ‘ধা ধিন ধিনতা, না তিন তিনটা’ কথাটার মানে কী?
— এ আর এমন কি কঠিন কাজ।
— বল তাহলে। না পারলে তোকে তিন গ্লাস জল খেতে হবে।
— বলব। একটু ভাবতে হবে। বলেই গোবর্ধনদা বাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে এখানে বসে ভাবছিল, এর অর্থ কী হতে পারে? ভাবতে ভাবতে সময় গড়িয়ে গেছে, দুপুরের খাওয়াটাও হয়ে ওঠেনি।
গোবর্ধনদা আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, তুমি এবার বলো, কথাটার অর্থ কী?
আমি একটু ভেবে বললাম, একটা লোক হয়তো নাচছে ধা ধিন করে, আর সঙ্গে হয়তো ওর তিনটে নাতিনও নেচে যাচ্ছে।
গোবর্ধনদা লাফিয়ে উঠলেন। বললেন, একদম ঠিক। আমি এখন বাড়ি যাচ্ছি।
দেখলাম গোবর্ধনদা হনহন করে চলে যাচ্ছেন। আমি নিজেও বুঝতে পারলাম না, আমার কথাগুলি ঠিক হল কিনা। গোবর্ধনদার মুখে কথাগুলির অর্থ শুনে হর্ষবর্ধনদা কী বলেন তা জানার ইচ্ছে হল। আমি একটু দূরে দূরে গোবর্ধনদার পিছে যেতে লাগলাম।
গোবর্ধনদা তাদের গেট খুলে ভেতরে ঢুকে যেতেই আমি দৌড়ে গিয়ে গেটের সামনে দাঁড়ালাম। দেখলাম, হর্ষবর্ধনদা বাড়ির সামনের ফুলগাছে জল দিচ্ছেন। গোবর্ধনদা হর্ষবর্ধনদার সামনে দাঁড়িয়ে বললেন, ধা ধিন ধিনতা, না তিন তিনটা-র মানে হচ্ছে, একটা লোক নাচছে ধা ধিন করে, আর সঙ্গে ওর তিনটে নাতিনও নেচে যাচ্ছে।
হর্ষবর্ধনদা জল দেওয়া থামিয়ে বললেন, কী বলছিস?
গোবর্ধনদা আবার বললেন, একটা লোক নাচছে ধা ধিন করে, আর সঙ্গে ওর তিনটে নাতিনও নেচে যাচ্ছে।
উত্তর শুনে হর্ষবর্ধন হো হো করে হাসতে থাকেন। হাসি থামলে গম্ভীর মুখে বললেন, হয়নি।
গোবর্ধনদা তো অবাক, হয়নি ! আশ্চর্য, তাহলে তমি বলো, অর্থটা কী ?
— বলব। তার আগে তোকে তিন গ্লাস জল খেতে হবে।
— তোমার সামনে খাব না ভেতরে খেয়ে আসব।
— আচ্ছা ভেতরেই খেয়ে আয়।
কিছুক্ষণ পর গোবর্ধনদা ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বললেন, এবার বল, কথাগুলির মানে কী?
হর্ষবর্ধনদা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে বললেন, কথাগুলোর কোনো মানেই নেই। আমি এমনিই তোকে পরীক্ষা করছিলাম, কথাগুলোর যে কোনো মানে নেই সেটা তুই বুঝতে পারিস কিনা।
শুনে গোবর্ধনদা মাথার চুল ছিঁড়তে ছিঁড়তে বলে উঠলেন, হায় হায় দাদা, এইভাবে পরীক্ষা করা কি তোমার ঠিক হল? এদিকে তিন গ্লাস জল খেয়ে ঠিক মত ভাতও খেতে পারব না এখন। ছি ছি।