ঢাকি – সুদীপ ঘোষাল

ঢাকি           (ছোটোগল্প)

সুদীপ ঘোষাল

গ্রামের নাম পুরুলে, পূর্ব বর্ধমান জেলার কাটোয়া মহুকুমার অন্তর্ভুক্ত একটি গ্রাম। ভারতবর্ষের গ্রামগুলো না চিনলে দেশকে চেনা যায় না। অভাব, অভিযোগ, ভালো, মন্দ, আনন্দ সব নিয়েই গ্রামগুলি নদীর মত প্রবহমান। এই পুরুলে গ্রামের একটি হতদরিদ্র পরিবার হল সুনীতা দাসের পরিবার। তার স্বামী তপন দাস ঢাক বাজাত ভালো। তপন দাসের চৌদ্দপুরুষের ঢাকির পরিচিতি এলাকাজুড়ে লোকের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে।
তপন দাস ঢাক বাজিয়ে সংসার চালাত। একটা মারাত্মক দুর্ঘটনায় তার পা দুটি অকেজো হয়ে যায়। এখন সে আর তার স্ত্রী রক্ত বেচে সংসার চালায়। এক ছেলে ও এক মেয়ে নিয়ে তাদের চারজনের সংসার বেশ কষ্ট করেই চলে।
তপন দাসের দাদু তপনকে ঢাক বাজানো শিখিয়েছিল। তার দাদু বলতেন,সাধারণত ছাগলের চামড়া দিয়ে ঢাক তৈরি করা হয়। কাঁচা চামড়া সংগ্রহ করে তাতে বেশ পরিমাণ লবণ ছিটিয়ে সাত থেকে আটদিন ভিজিয়ে রাখা হয়। চামড়া থেকে পশম উঠে গেলে ভালোভাবে পরিষ্কার করে বাঁশের খুঁটি দিয়ে টান টান করে রোদে শুকানো হয়। তারপর সেই শুকনো চামড়াকে সাইজ মতো কেটে এই বাদ্যযন্ত্র তৈরি করা হয়।
বাংলার ঢাকের নানান নাম। “ঢাক”, “জয়ঢাক”, “বীরঢাক” ইত্যাদি। আওয়াজ ও আকৃতি অনুসারে তারতম্য হয়ে থাকে। ঢাকের আওয়াজের সঙ্গে সুর এবং ছন্দ মূর্ছনা তৈরি করার জন্য প্রাচীন কাল থেকেই ঢোল ও বাঁশি বাজানো হয়। প্রাচীনকালে ঢাক ডঙ্কা নামে পরিচিত ছিল। তবে সেই সময় ডঙ্কা জালা আকৃতির মাটির পাত্র দিয়ে তৈরি হত। তপন দাসের বাবা বলতেন, ঢাকের বোল বেশ কঠিন ও জটিল। তাই আমরা মুখে মুখে ছড়ার মাধ্যমে ঢাকের বোল শেখাই তোদের। বিভিন্ন উৎসব ও তার বিভিন্ন পর্যায়ে বিশেষ বিশেষ তালে ঢাক বাজানো হয়।

তপন তার বউ সুনীতাকে বলে, দুর্গাপুজোয় ঢাক বাজানো হয় দেবীর বোধনে, দেবীর ঘুম ভাঙাতে, দেবীর পূজাকালীন, দেবীর আরতিতে এবং দেবীর বিসর্জনে। প্রতিটি ক্ষেত্রে ঢাকের বাজনার ভিন্নতা রয়েছে। বর্তমানে সেই ভিন্নতা দেখা যায় না। ঢাকের বাজনা বংশ পরম্পরায় প্রচলিত। দীর্ঘদিনের অভ্যাসের মাধ্যমে অর্জিত। অনেকেই এখন বংশ পরম্পরায় এই পেশায় না আসায় তা লুপ্ত হচ্ছে।
তপন বলে, শোন,সুনীতা আমি তো আর ঢাক কাঁধে নিয়ে দাঁড়িয়ে বাজাতে পারব না। আর যাওয়া আসাও করতে পারব না। তুই এই ঢাকের বোল আমার কাছে শিখে নে।
— কী সব আজেবাজে বকছিস রে। মেয়ে হয়ে আমি ঢাক বাজাবো।
— হ্যাঁ বাজাবি। শিল্পের কোনো লিঙ্গ নাই। আমি ছড়া বলে তোকে ঢাকের বোল শেখাবো, শোন।
— বেশ বল। রক্ত বেচে খাওয়ার চেয়ে ঢাক বাজিয়ে খেটে খাবো, লজ্জা কিসের?
— ঠিক বলেছিস। আয় তোকে বোল শেখাই। এই দেখ ঢাক আর দুটো কাঠে। দড়ি দুটো আঙুলে বেঁধে নিলে কাঠি পড়ে যাবে না। এইবার শোন, গাজনের বোল, বাবা শ্মশাননাথের খেলা, বাবা বদ্যিনাথের খেলা। ড্যাং ড্যাং আ ড্যাং বাবা ড্যাং ড্যাং না ড্যাং।
— ও এটা শিবের গাজনের বাজনা। দাঁড়া মনে করে লি। বাবা শ্মশাননাথের খেলা, বাবা বদ্যিনাথের খেলা।
— হ্যাঁ এবার বাজা, বাবা ড্যাং ড্যাং আ ড্যাং, বাবা ড্যাং ড্যাং আ ড্যাং।
— কই গো বাজানো হচ্চে?
— হবে হবে, ঠিক হবে।

এইভাবে অশিক্ষিত সমাজে শ্রুতিধর ঢাকিরা বোল মুখস্থ করে বাজায়। বাজানোর সময় নাচের তালে তালে তারা এই বোল বলে আর বাজায়।

রাত নেমে এলে তপনের চোখে ছেলেবেলার দৃশ্য ভেসে ওঠে মানসপটে। সে তার ছেলেবেলার গল্প সুনীতাকে শোনায়। সুনীতা মন দিয়ে শোনে তপনের কাহিনি। তপন বলে, আমরা ছোটবেলা থেকেই অজয় নদীর ধারে এসে বর্ষাকালে জলের স্রোত দেখতাম। অজয় নদীর পাড়ে আর একটি গ্রাম আছে, তার নাম যতীনপুর। সেখানকার বন্ধু অমল, বিবেকানন্দ, গৌরী, সুজাতা সকলে আমরা ছোট ছেলেমেয়ে। আমাদের সকলের চোদ্দ থেকে আঠারো বছর বয়স। তখন সবাই একত্রে এসে নদীর পাড়ে এসে জলের খেলা দেখতাম। হঠাৎ কি হল নদীর পাড় ভেঙে একটি ছেলে পড়ে গেল। কোথায় যে চলে গেল তার কোনো খোঁজই পাওয়া গেল না। এখনোও আমাদের দুঃখের সেইসব স্মৃতি মনে আছে। অজয় নদে দেখেছি গ্রীষ্মকালে নদের মাঝখানে জমির মত ধান চাষ হয়। কিন্তু বর্ষাকালে সেই নদ আর চেনা যায় না। কী ভয়ংকর সে নদ তখন। বন্যায় মাটির ঘর বাড়ি ভেঙে যায়। আর কত শত ছাগল, গরু যে জলে ভেসে চলে যায় তার ইয়ত্তা নেই। অজয় নদের দুই ধারে যে লোকগুলো বাস করে তাদের প্রধান জীবিকা হল মাছধরা। তারা নৌকা নিয়ে বর্ষাকালে মাছ ধরে এবং গ্রামে গ্রামে বিক্রি করে। বর্ষাকালে ভরা নদে আমরা সকলে মিলে স্নান করতে ভালোবাসি। আর গামছায় করে ছেঁকে মাছ ধরি। ছোট ছোট কত রংবেরঙের মাছ ধরে যে আনন্দ হয় তা ভাষায় বর্ণনা করা যায় না। এই অজয় নদীর সঙ্গে যুক্ত আমাদের একটা কাঁদর আছে। সেই কাঁদরের নাম ঈশানী নদী। এই ঈশানী নদী আমাদের গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে চলেছে। বর্ষাকালে অজয়ের বন্যা সাথে সাথে ঈশানী কাঁদর বা ছোট নদীও ভরে ওঠে। সেখানেও মাঝিরা জাল ফেলে মাছ ধরে। তারপর অনেকে নৌকা নিয়েও এই ছোট নদীতে মাছ ধরে।একবার বন্যার সময় আমরা বন্ধুরা মিলে অজয় নদে নৌকা করে আমরা ঘুরতে গিয়েছিলাম। আমাদের দলের নেতা ছিল দিলীপ, রিলীফ, অরূপ, বিশ্বরূপ এই চারজন। তাছাড়া মিলু, পিনু, অধীর সকলেই খুব সাহসী ছেলে। তারা নৌকা নিয়ে লগি ঠেলে নৌকা নিয়ে যেতে লাগল মাঝ নদীতে, চলে গেছিলাম অনেক দূর পর্যন্ত। তারপর অজয় নদে মাছ ধরেছিলাম। সন্ধ্যেবেলায় ফিরে এসে বাড়িতে সেই মাছ ভেজে খাওয়া হয়েছিল। আজ অজয় নদীর পাশ দিয়ে গেলে সেই সব স্মৃতি মনে ভেসে ওঠে।
সুনীতা বলে, তোমার ছোটবেলার গল্প শুনে আমারও কত স্মৃতি জেগে ওঠে মনে। তপন বলে,বল না তোর সেই গল্প।
সুনীতা বলে, আমার প্রিয় বান্ধবী সোমাকে নিয়ে ঘুরতাম নানা জায়গায়। বাবা আমাদের স্বাধীনতায় বাধা দেন নি কোনোদিন। সোমা ছিল লেখাপড়া জানা মেয়ে। সোমা আর আমি লালবউ এলেই তার কাছে চুনোমাছ কেনার জন্য বায়না ধরতাম। অথচ সোমার বাবার পুকুর আছে। বড় বড় মাছ আছে। লালবউ অবাক হয়ে বলত, তুমি চুনোমাছ খাবে কেন দিদিভাই। তোমাদের পুকুর আছে। সোমা বলত, লাল শাড়ি পরে তোমাকে মাছ আনতে দেখলেই আমার মায়ের কথা মনে পড়ে যায়। আমার মা চুনোমাছ খুব ভালবাসতেন।
সুনীতা বলে, একটা মেয়ে ইচ্ছে করলে পৃথিবীর সব কঠিন কাজ হাসিমুখে করতে পারে। দশভূজা দুর্গা। স্বামীর অফিসের রান্না, ছেলেকে স্কুল পাঠানোর পরে বাসনমাজা, কাপড়কাচা ও আরও কত কি? দুপুরবেলা বই নিয়ে বসে ঘুমে ঢুলে পড়তাম আমি। আবার কোনো কোনো দিন ভাবনার সাগরে ডুব দিতো অনায়াসে। মনে পড়তো কিশোরীবেলার আলপথের ধারে ক্যানেলের জলে রংবেরংয়ের মাছের কথা। গামছা দিয়ে ছেঁকে তুলতাম কত মাছ। জলে সাঁতার কাটতো ছোটো ছোটো তেচোখা মাছ। পুকুরের ধারে বসতাম, বুড়ি গিন্নির ছাই দিয়ে বাসন মাজা দেখতে। কি ভালো যে লাগতো। মনে হতো দিই বুড়ির বাসন মেজে। কিন্তু সাহস করে বলতে পারিনি কোনোদিন। সন্ধেবেলা সিধুকাকা বেড়াতে আসতো। সুনীতা বলে, আমরা খাওয়ার পরে ঠাকুমার পাশে শুয়ে শুনতাম, পুরোনো দিনের কত গল্প। গল্প শুনতে শুনতেই ঘুমিয়ে পড়তাম ঠাকুমাকে জড়িয়ে ধরে। সুনীতা এইসব ভাবতো আর বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নামতো ঘাটে। স্বামী, ছেলে, মেয়েরা চলে আসতো তার স্বপ্ন নীড়ে। আবার শুরু হতো সংসারের ঘানিটানা কলুর বলদের মতো। দুঃখ সুখের অপূর্ব মিশ্রণে বয়স কাঁটা এগিয়ে চলে টিক টিক শব্দে। সোমা আর আমি দূর দূরান্তে না গিয়ে কাছাকাছি না দেখা গ্রাম দেখতে ভালোবাসতাম। একবার গেলাম শিবলুন গ্রামের।
তপন বলে, হ্যাঁ আমি জানি হাওড়া লালবাগ লোকাল ধরে শিবলুন হল্টে নামতে হয়। একবার সেখান থেকে অম্বলগ্রাম পাশে রেখে দু কিলোমিটার টোটো রিক্সায় বেলুন গ্রাম।
সুনীতা বলছে তপনকে, আমার বাপের বাড়ি, সিঙ্গি হল বাংলার প্রাচীন গ্রাম। এই গ্রামেরই নদী পুকুর খাল বিল জলাশয় সব আছে। ফসল বিলাসী হাওয়ার গন্ধ আছে, সিঙ্গির মাটির উর্বরতায় ফুলে ফলে ফসলের সুন্দর গ্রাম।

বাংলার সব পাখিরা কমবেশি সিঙ্গির আকাশে বাতাসে ঘুরপাক খায়। তিনি বিখ্যাত করেছেন ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছেন। কবি কাশীরাম দাস সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের কাহিনি। এই মহাপুরুষের জন্মভিটার সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আমরা দিনে তাঁর ভিটাতে দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাসংগীত শোনাতে পারি। তারপর অনেকটা হেঁটে গিয়ে দাসপাড়া পেরিয়ে গিয়ে বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়াতে পারি উদাস হয়ে। এই স্থানের মাটি কপালে বুলিয়ে নিতে একবার। সবাই ক্ষেত্রপালের মন্দিরের দিকে যায়। ক্ষেত্রপাল বটবৃক্ষের নিচে অবস্থিত। তারপরে রাস্তা দিয়ে গিয়ে সোজা শিব মন্দির। এখন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে বুড়ো শিবের মন্দির যেতে।
সোমা বলল, ছোটবেলায় আমাদের কোপা গ্রামে মাটির রাস্তা ধরে ধুলোমেখে ঘরে ঢুকতাম। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হয়ে যেত। গোরুর গাড়ি ছাড়া কিছুই যান ছিল না। আর ছিল পাল্কি। গ্রামের ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই শুনতাম পাল্কির গান।

সুনীতা এই গাঁয়ে মায়ের গন্ধ পায়। আমি বড় হলাম, সোমার বিয়ে হল কিন্তু আমার বাবা অভাবের জন্য আমার বিয়ে দিতে পারল না। তারপর তুমি এলে, আমাকে বিয়ে করলে। সোমা আর আমি সংসারে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আগের ছোট্ট মেয়েটি বড় হয়ে গেলাম গিন্নি। তারপর আমার সন্তান হল। কালস্রোতে সংসারে মিশে গেলাম ।

তপন এবার সুনীতাকে বলে, চ, আজকে দুজনায় সুখে ঘুমোই। কাল সকাল হলে রক্তদান শিবিরে যাব। ক্লাবের ছেলেরা টাকা দেবে, সেই টাকায় সংসারটা এক মাস চলবে।
সুনীতা বলে, তোকে আর ওসব করতে হবে না। আমি তিনবাড়িতে কাজে লেগেছি। আগে তিনশ টাকা দিতে বলেছি বড় মাসিকে। মাসি আমাকে টাকা দেবে, চাল দেবে। ওতেই কিছুদিন চলুক তারপর আবার ব্যবস্থা করব।
— কিন্তু সুনীতা, তু ঢাক বাজানোর তালিম নিবি আমার কাছে রোজ। তোর দশজনা বান্ধবীকে নিয়ে আমার কাছে বসবি ঢাকের বোল শেখার জন্য।

সুনীতা তার প্রতিবেশী বান্ধবীদের বুঝিয়ে রাজী করায় ঢাক বাজানো শেখার জন্য। তপন শেখায় আর ওরা ঝিয়ের কাজ করার অবসরে ঢাক বাজানো শেখে,তপনের কাছে।

এইভাবে তিলে তিলে গড়ে তোলে তপন তার স্বপ্নের মহিলা ঢাকিদল। এখন আর তাদের রক্ত বিক্রি করতে হয় না। করোনার কালো দিনগুলো পার হওয়ার পর তারা এখন বিভিন্ন জায়গায় বাজিয়ে মোটা টাকা বখশিশ পায়। টাকা দশজনের মধ্যে ভাগ করা হয় আর সকলেই একশ টাকা করে তুলে রাখে গুরুমশাই ঢাকি তপন দাসের জন্য।

এখন তপনের বয়স হয়েছে। সে এখন শুধু বিসর্জনের বাজনা শুনতে পায়। সে ভাবে দাদুর দেওয়া ঢাকের বোল, তালিম আমি সুনীতাকে দিয়েছি, সে এখন গড়ে তুলুক তার ছেলেমেয়েদের ঢাকি হিসেবে।

তপন আজ শেখায় বিসর্জনের বাজনা। বলে, বাজানোর তালে তালে তোরা বল, মা আর থাকবি কতক্ষণ, মা তুই যাবি বিসর্জন…