জোকার – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

জোকার              (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

জিনা যহাঁ মরনা যহাঁ
ইসকে শিবা জানা কাহাঁ…।
মুখোশে রং করতে করতে নিচু গলায় গান গাইছিল শিবু। অভ্যাস। সময়ে অসময়ে এই গানটাই গুনগুন করে। জীবনের সার কথা ওই গানের মধ্যেই। সুরটা ধরলেই মনের মধ্যে হাজির হয় রাজ কাপুর। জোকারের সাজ। সেই বিখ্যাত অঙ্গভঙ্গি। মন তোলপাড় করে শিবুর।

আজ মনটা খুব একটা ভালো নেই শিবুর। মেয়েটার বিয়ে ঠিক হয়েছে। চলে যাবে পরের বাড়ি। কি করা যাবে আর। সুখ দুঃখ সবই আসে জীবনে। মেয়ের কথা ভাবতে ভাবতে মুখোশে রং করছিল শিবু। আজ রাতের বেলায় বিয়ে বাড়ীতে অনুষ্ঠান আছে। সিজিনের প্রথম বিয়ে। মুখোশটাকে পালিশ না দিলেই নয়।

সুলতা এসে দাঁড়ায় উঠানে। মনে ঝড়। গলায় আগুন। মেয়ের বিয়ে বুঝি ভেস্তে গেল শিবুর জন্য। গলা চড়িয়ে শিবুকে বলে, নির্লজ্জ বেহায়া লোক। জীবনটা জ্বালিয়ে খেলে। সব কিছুতে জল ঢেলে এখন জিনা যহাঁ হচ্ছে। নিষ্কর্মার ঢেঁকি। বলে কিনা আমি আর্টিস্ট! কি আমার দরের আর্টিস্ট রে।
বউয়ের কথা গায়ে মাখে না শিবু। বিবাহিত জীবনের প্রথম দু বছর বাদ দিলে পরের সতের বছর ধরে সুলতার মুখে এমন কথা রোজ হাজার বার শোনে। অভ্যাস হয়ে গেছে। বউয়ের কথায় কান না দিয়ে কাজে মন দেয় শিবু।

— তোমায় পই পই করে বললাম তারপরেও শুনলে না তুমি?
সুলতার প্রশ্ন শিবুকে স্পর্শ না করে ধাক্কা খায় দেওয়ালে। শিবু ব্যস্ত মুখোশের রং ফেরাতে।
— বলি ওরা জিজ্ঞাসা করেছিলো তোমাকে, যে তুমি কি কর? দু’পা সামনে এসে গলা চড়িয়ে প্রশ্ন ছোঁড়ে সুলতা।
ঠোঁটে গান ধরে রেখে সুলতার দিয়ে তাকায় শিবু। দুই ভ্রু কুঁচকে মাথাটা নীচের থেকে উপরের দিকে তোলে একবার। অর্থাৎ সুলতা কোন বিষয়ে কি কথা বলছে বুঝতে পারছে না শিবু।
স্বামীর ভাব দেখে তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে সুলতা। বলে, কি প্রয়োজন ছিলো অত কথা বলার এ্যাঁ ? আগ বাড়িয়ে দুম করে বলে বসলে আমি আর্টিস্ট! ওঃ আর্টিস্ট! জোকার সেজে হনুমানের মতো লম্ফোঝম্পো করে। তিনি নাকি আর্টিস্ট! এবার মেয়ের বিয়েটাই ভেঙে যাবে তোমার জন্য। ছি ছি ছি! সব আমার কপাল। কোন মানুষকে নিয়ে আমি চলি! ভগবান।
তুমুল চিৎকার চেঁচামেচি করে সুলতা।
সংসারে সামান্য কিছু অনর্থ হলে সে দায় পড়ে শিবুর উপর। সহস্র কথা শিবুকে শোনায় সুলতা। হাজারবার বলে জোকার। গালিগালাজ করে। শুনে শুনে অভ্যাস হয়ে গেছে শিবুর। এই ধরনের কথার ঝাঁঝ গায়ে লাগে না আর।
— বলি বসে রয়েছ যে! যাও। আগুলের হল্কা ধেয়ে আসে শিবুর দিকে। শিবু তাকিয়ে থাকে। সুলতার ‘যাও’ এর অর্থ বুঝতে পারে না। কোথায় যাবে, কেনোই বা যাবে সেই মুহূর্তে বুঝে পায় না শিবু। সুলতার মুখের উপর বলে বসে, আজ কোথাও যাবার সময় নেই গো। রাতে বিয়ে বাড়ির প্রোগ্রাম আছে।
শিবুর হাত ধরে সুলতা। টানতে টানতে নিয়ে যায় বাড়ির বাইরে। দাঁতে দাঁত চেপে বলে, যাও মেয়ের জন্য পাত্র খুঁজে নিয়ে এসো। তারপর বাড়ি ঢুকবে। এখুনি যাও। শিবুর মুখের উপর সদর দরজা বন্ধ করে কাঁদতে কাঁদতে বাড়ির ভিতরে চলে আসে সুলতা।

পিছন পিছন শিবুও আসে। উঠানে এসে দাঁড়ায়। তাকিয়ে থাকে সুলতার দিকে।
দুয়ারে বসে সুলতা। বলে, কতো কষ্ট করে মেয়ের জন্য জামাই জোগাড় করলাম আর…।
ঘরের ভিতর থেকে শিবুর মেয়ে বলে, থাক মা, বলে কি লাভ! তোমার কোন কথা ওর কানে যাচ্ছে! যা হয় হোক। বিয়ে হোক আর না হোক ওর কিছুই যায় আসে না।

এই প্রথম শিবুর মনে হয় কিছু একটা গণ্ডগোল বেঁধেছে। মেয়েকে উদ্দেশ্য করে বলে, কি হয়েছে সেটা তো বলবি আগে।
সুলতা ফোঁস করে ওঠে, বলে আমার ছেরাদ্দ হয়েছে। হারামজাদা লোক। আর্টিস্ট! আজ দেখছি আমার আর্টিস্টকে। হাতের কাছেই মুখোশটা ছিল। রান্না চালায় গিয়ে সেটিকে কাঠের উনুনে গুঁজে দেয় সুলতা। জ্বলে যায় মুখোশ। এখানেই শেষ নয়। লম্বা লম্বা পা ফেলে ঘরে যায় । দেওয়ালে আটকানো বড় বড় ছবি গুলো ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে দেয়। একপাশে দাঁড়িয়ে থাকে শিবু। রাজ কাপুর শিবুর ভগবান। ছবির টুকরো গুলোর দিকে চেয়ে বুক ভেঙে যায় শিবুর। চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে। এমন কিছু হতে পারে ভাবতেই পারেনি।

সুলতা অদৃষ্টকে দোষ দিয়ে হাজার কথা বলে। আমি মেয়ের বিয়ের পাত্র জোগাড় করবো আর উনি সবকিছুর পিণ্ডি চটকাবেন। ওহ, মানুষ বটে! মরলে বাঁচি।
লোক মুখে খবর নিয়ে মেয়ের বিয়ের পাত্র জোগাড় করেছে সুলতা। ছেলে হসপিটালে কাজ করে। বাবা প্রাইমারি শিক্ষক। ছোট পরিবার । ছেলে দেখতেও বেশ। মেয়ের সঙ্গে মানানসই।
হবুজামাই দুই জন বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে এসে দেখেও গেছে শিবুর মেয়েকে। পছন্দ হয়েছে। মনে মনে খুশি হয়েছে শিবুর মেয়ে। মেয়ের মনের খবর বুঝতে অসুবিধা হয়নি সুলতার। এরপর দুজনের মধ্যে সম্পর্ক জমাট বেঁধেছে দিনে দিনে। দিনের মধ্যে হাজার বার হবুজামাইয়ের ফোন আসে। শিবুর মেয়ে মন খুলে গল্প গুজব করে হবুবরের সঙ্গে। সামান্য কথাও সাজিয়ে গুজিয়ে বলে। তবে সচেতন হয়েই আড়ালে রেখেছে শিবুকে। বাবার প্রসঙ্গ এলে অন্য কথা তুলে পাশ কাটিয়ে গেছে । রাজ কাপুর সেজে মঞ্চে, অনুষ্ঠান বাড়িতে নাচ দেখায় শিবু। সে কথা কি বলা চলে সব জায়গায়! লজ্জা পায়।
শিবু শিল্পী। কদর ছিল এক সময়। উৎসবে অনুষ্ঠানে এদিক সেদিক থেকে ডাক আসত। নেচে গেয়ে আসর মাতিয়ে তুলত। মুকেশ সাহেবের গান গলায় নিয়ে রাজ কাপুর সেজে নিজেকে হাজির করত মঞ্চে। খুশি হত দর্শক।
শিবুকে মঞ্চে দেখে মুগ্ধ হয়েছিল সুলতা। পর পর দু চারটে অনুষ্ঠান দেখে অষ্টাদশী মনে প্রেমের জোয়ার। তারপর বিয়ে।
বন্ধুরা বলেছিল তোর বর এক্কেবারে রাজ কাপুর। শিল্পীর বউ। অহংকার। গর্ব। কয়েক বছর মাত্র। তারপর পালা বদল। মঞ্চে এলো বাংলা ব্যান্ড। রক। জীবনমুখী গান নিয়ে আরো অনেক অনেক শিল্পী। এলো টিভি সিরিয়ালের পরিচিত মুখ। তাদের চোখ ধাঁধানো হাসি। সেই সব শিল্পীর চাহিদা তুঙ্গে। ব্যস্ততা কমে এলো শিবুর। সংসারে আঁধার। অনটন। অশান্তি নিত্যসঙ্গী।
মেলা, বিয়ে বাড়ি, পৈতে বাড়ি অন্নপ্রাশনে রাজ কাপুর সেজে বেঁচে থাকবার অর্থ খুঁজে নিয়েছে শিবু। স্বামীর এমন কাজ! পাঁচ জন পাঁচ কথা বলে। পথে ঘাটে কথা বাঁচিয়ে চলত সুলতা। শিবুকে বলত কাঁচা সবজির ব্যবসা কর। নয়তো অন্য কিছু।
বউয়ের কথা কানে তোলেনি শিবু। সে শিল্পী। কাপুর সাহেব শিবুর মজ্জায়। সততা আর নিষ্ঠা থাকলে বড় হবেই শিবু। কাপুর সাহেবের আশীর্বাদ শিবুর সঙ্গে। আনন্দ, আনন্দ দেবে মানুষকে। রাজ কাপুর আনন্দ দিয়েছে দেশ দুনিয়ার সবাইকে। শিবুও দেবে। সফল হবে একদিন। লোকে কি বলে তাতে শিবুর কিছু যায় আসে না। সংসারে অশান্তি সেই নিয়ে।
স্বামীর এমন কাণ্ড দেখে ভীষণ বিরক্ত সুলতা। পেটে ভাত না জুটলে নেচে গেয়ে লাভ কি। এইভাবে চললে না খেয়েই মরতে হবে। ততদিনে মেয়েটা এসেছে সংসারে। অবশেষে নিজেই হাল ধরে। মুদি দোকান ঠেলে সংসারের চাকা ঘোরায় সুলতা।

সারা জীবন শুধু পাগলামি। সংসারের কোন কাজে নেই। আইবুড়ো মেয়ে ঘরে বসে। বিয়ের চিন্তা নেই। ঘর ভর্তি ছবি। বাড়ি না সেলুন! কাপুর সাহেব! বদমাইশ লোক। বাইরের লোকজনের সামনে ফলাও করে রাজ কাপুরের কথা বলতে গেছে। আবার জ্বলে ওঠে সুলতা।

আজ শিবুর মেয়েকে দেখতে এসেছিল পাত্রের বাবা আর মা। বিয়ে এক রকম পাকা। কথা শুনে তেমনই মনে হয়েছে সুলতার। সামনের শ্রাবণেই চারহাত এক করতে চান সুলতার হবু বেয়াই। বেয়ানেরও মত তাই। সে কথা শুনে ভিতরে ভিতরে খুশির বন্যায় ভেসে গেছে সুলতা। ভালো ঘরে মেয়ের দেবে, বহুদিনের লালিত স্বপ্ন। স্বপ্ন পূরণের নিশ্চয়তা অতিথিদের সামনেই ক্ষণিকের জন্য দুলিয়ে দেয় সুলতাকে। চোখে জল নিয়ে সরে আসে বেয়াই বেয়ানের সামনে থেকে। দাওয়ার খুঁটিতে মাথা ছুঁইয়ে দুর্গা নাম করে। তারপর দু চোখ খুলে দেখে উঠানে দাঁড়িয়ে শিবু। অজানা আতঙ্কে বুক কাঁপে সুলতার। না জানি কি বলতে কি বলে বসবে বাইরের লোকজনের সামনে। আর…।
ইশারায় শিবুকে ডাকে সুলতা। বলে, মেয়ের বিয়ে পাকা করে ফেলেছি। সোনার টুকরো ছেলে তোমার জামাই হবে। পাত্রের বাবা মা এসেছে। ওরা নিজেরাই বলেছে শ্রাবণে বিয়ের কথা ভাবছে। তুমি বেশি কথা বলতে যেও না যেন।
মেয়ের বিয়ের ব্যাপারে কোনো কিছুই জানত না শিবু।
এমনকি আজ মেয়েকে দেখতে আসবে সেই কথাও শিবুকে জানায়নি সুলতা। তাতে শিবুর দুঃখ নেই কোনো। সংসারের সব কথা শিবুর জন্য নয়। এটা বিশ্বাস করে শিবু।

বউয়ের মুখে মেয়ের বিয়ের কথা শুনে মুহূর্তের বিমর্ষতায় কাতর হয় শিবু। আজ হোক বা কাল, মেয়ের বিয়ে তো দিতেই হয়।
দেখ, আবার বুঝি কাপুর সাহেবের কথা ভাবছে দাঁড়িয়ে। শোন, আমাদের বেয়াই মাস্টার মানুষ। মেপে কথা বলবে। তোমার নাচ গানের কথা তুলবে না। শিবুকে বলে সুলতা।
সুলতার সাবধান বাণী। বলাই সার! কে মনে রাখে সে সব। পাত্রের বাবা মায়ের সামনে গিয়ে শিবু শিবুর মতোই বলতে থাকে নানান কথা। নিজে যে আর্টিস্ট সে কথাও শুনিয়ে দেয়। রাজ কাপুর সাহেবের প্রসঙ্গ বাদ যায় না। পাশের ঘর থেকে বাবার সব কথা শুনে লজ্জায় মাথা কাটা যায় শিবুর মেয়ের। মনে মনে ভীষণ রেগে ওঠে সুলতা। প্রমাদ গোনে। বিয়েটা বুঝি ভেস্তে যায়। বাধ্য হয়েই পরিস্থিতি সামাল দিতে হয় সুলতাকে। পাত্রের বাবা মায়ের সামনে থেকে ডেকে নেয় শিবুকে। নয়তো আরো কি কি বলে বসত ভগবান জানে।

— তুই একবার ফোন কর না জামাইকে। ওর বাবা মা কিছু মনে করলো কি না জিজ্ঞাসা কর। রান্নাচালা থেকে মেয়েকে বলে সুলতা।
— মনে করবার কি আছে মা। দেখলে না বাবার সঙ্গে কথা বলার পর থেকেই ওরা কেমন চুপ করে গেল। অথচ এলো যখন কত হাসি খুশি ভাব। ঘর থেকে বলে শিবুর মেয়ে।
— কপাল, কপাল। নয়তো আজকেই উনি বাড়িতে থাকবেন কেন! শিবুর দিকে কথা গুলো এগিয়ে দেয় সুলতা।
— তুই না পারিস আমাকে দে। আমিই না হয় কথা বলে বুঝে নেবো বিয়াই বেয়ান কিছু মনে করলেন কি না।

হবুজামাইকে ফোন করে সুলতা। ফোন ধরে জামাই। বলে পরে কথা বলবো। এখন ব্যস্ত আছি। পাত্রের কথা শুনে দুশ্চিন্তার ছায়া লম্বা হয় সুলতার মনে। দুচোখে জল আসে শিবুর মেয়ের।
দাওয়াতে বসে শিবু। এতক্ষণে বুঝেছে মেয়ে বউয়ের কথা। তবে মিথ্যে তো আর বলেনি কিছু। যা সত্যি তাই বলেছে পাত্রের বাবাকে। এর জন্য যদি বিয়ে ভেঙে যায় শিবুর কিই বা বলবার থাকে!
— এ্যাই, বসে বসে আর কাপুর সাহেবের ধ্যান করতে হবে না। তুমি বিদেয় হও বাড়ি থেকে। আমি নিজে যাব কাল। হাতে পায়ে ধরে রাজি করাবো হবুবেয়ান বিয়াইকে।

বাড়িতে যে আর আজ ভাত জুটবে না বুঝেছিল শিবু। নিজের ঝোলা নিয়ে রওনা দেয়। সময়ের অনেক আগেই পৌঁছে যায় বিয়ে বাড়ি। আজ আর জোকারের মুখোশ নেই সঙ্গে। পুড়িয়ে দিয়েছে সুলতা। রং মেখেই ম্যানেজ করতে হবে শিবুকে।
অনুষ্ঠান শুরুর আগে সব সময় কাপুর সাহেবকে মনে করে শিবু। আজও তার ব্যতিক্রম হয়নি। নিজের মনের তাপ উত্তাপের কথা চাপা রেখে মাতিয়ে তোলে বিয়ে বাড়ি।
আজও নিজের মত করে অনুষ্ঠান করেছে শিবু। সত্যিই হৃদয় দিয়ে গান গেয়েছে মানুষটা। সবার মুখে এক কথা। এরই মধ্যে এগিয়ে আসে এক ভদ্রলোক। জড়িয়ে ধরে শিবুকে।
রাতে হবুজামাই সুলতাকে ফোন করে। বলে শিবুবাবুর অনুষ্ঠান দেখেছে আমার বাবা। মুগ্ধ হয়েছে। বাড়িতে ফিরে বলে, রাজ কাপুর যেন ভর করেন মানুষটার উপর।
আজ বিয়ে বাড়ীতে আমন্ত্রিত ছিল শিবুর হবুবেয়াই। সেখানে শিবুর অনুষ্ঠান দেখেছে। ভীষণ খুশি। সবার সামনে বুকে জড়িয়ে ধরেছে শিবুকে। গলা তুলে পরিচয় দিয়েছে নিজের বিয়াই বলে।

তুমি বাবার কথা বলতে লজ্জা পাও। শিল্পী মানুষরা খেয়ালী হয়। মানুষটার মনের কদর তোমরা দাও না। আমার বাবা সে কথা বুঝেছেন তোমাদের বাড়িতে গিয়ে। অসন্তুষ্ট হয়েছেন তোমাদের উপর। একটা একটা করে শিবুর মেয়েকে কথাগুলো বলে হবুজামাই। তবে সামনের শ্রাবণেই বিয়ে হবে, সে কথাও বলে।
মেয়ের মুখে সব কথা শোনে সুলতা। আজ উনিশ বছর শিবুর সঙ্গে ঘর পেতেছে। মানুষটা কেমন সে কথা কি বলে দিতে হয়। জানে, সুলতা সব জানে। জানে বলেই তো ছেড়ে দিয়েছে শিবুকে। সংসারের কাজে জড়িয়ে রাখেনি। রাজ কাপুর বলতে শিবু ঈশ্বর দেখে। দেখুক। চুরি ডাকাতি তো আর করে না। নেচে গেয়ে নিজে আনন্দ পায়। সবাইকে আনন্দ দিতে চায়। দিক। সংসার সামাল দিয়েছে সুলতা নিজে। তবে সুলতা তো মানুষ। রাগ অভিমান তারও থাকে। ধৈর্যের সীমাও আছে। বাড়িতে আইবুড়ো মেয়ে। অমন ছেলের সঙ্গে বিয়ের সম্বন্ধ যদি ভেঙে যায়! তাই পাত্রপক্ষের লোকজনের সামনে শিবুর কথা শুনে ভয় পেয়েছিল সুলতা। অপমান করবে বলে বাইরের লোকজনের সামনে থেকে সরিয়ে আনেনি শিবুকে।
গ্রামে গঞ্জে অনেকেই তো শিবুকে ঠেলা দিয়ে কথা বলে। তাদের দু চার কথা শুনিয়ে দেয় সুলতা। তাই বলে হবুজামাইবাড়ির লোকে এসে স্বামীর ভালোবাসা নিয়ে মজা করবে, সে কি সইতে পারবে। নাকি মুখের উপর দু কথা শোনানো চলে! তাই তাড়াতাড়ি করে সরিয়ে এনেছিল শিবুকে।

কাল হবুজামাইবাড়ি যাবে সুলতা। শিবুকেও সঙ্গে নেবে। নিজের কথা বলে আসবে বেয়াইকে।

দুর্ভাবনার মেঘ কেটেছে শিবুর মেয়ের। থিতিয়ে এসেছে মনের রাগ, ক্ষোভ। বাবা ফেরেনি এখনও। চিন্তা হয় এইবার। সুলতাকে বলে, বাবাকে ফোন কর না মা।

রাতের শেষ গাড়ি চলে গেছে অনেকক্ষণ আগে। শিবু আজ বাড়ি ফেরেনি। এমন হয় না কখন। উদ্বিগ্ন হয়ে বসে ছিল সুলতা। ফোন করে শিবুকে। দাওয়ার কুলুঙ্গী থেকে বেজে ওঠে শিবুর ফোন। ফোন নিয়ে যায়নি মানুষটা। চিন্তায় আচ্ছন্ন হয় সুলতা। আজ মুখে কিছু না দিয়েই চলে গেছে শিবু। সুলতাই বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। ভীষণ কষ্ট হয় সে সব কথা মনে করে। কত কথাই তো শিবুকে বলে সুলতা। কোনো কথা ফিরে আসে না শিবুর থেকে। কি দিয়ে যে গড়া মানুষটা!
নানা কথা ভাবতে ভাবতে কখন যেন ঘুমিয়ে গিয়েছিল সুলতা। চোখ মেলে দেখে ফরসা হয়েছে পুব আকাশ। উঠে পড়ে ধরফর করে। শিবুর কথা ভেবে অজানা বিপদে কেঁপে ওঠে সুলতার বুক। বাসি কাপড় ছেড়ে ঘটিতে জল নেয় সুলতা। রোজ দিনের অভ্যাস। ঘরে বাইরের চৌকাঠে জল দেবে। সদর দরজা খোলে সুলতা। দেখে বসে রয়েছে শিবু। সুলতাকে দেখে হেসে বলে, কাল বিয়ে বাড়ির লোকজন ছাড়লো না জানো। বললো আরো গান শুনবে। জানি তুমি চিন্তা করবে। ফোন নম্বর তো মনে নেই যে খবর দেব। ভোরের দ্বারভাঙ্গা প্যাসেঞ্জারে ফিরেছি। ভাবলাম এখন আর ডাকাডাকি করবো না। একটু পরেই তো উঠবে। মেয়ের বিয়ে নিয়ে চিন্তা করো না। কাল বেয়াই মশাইয়ের সঙ্গে দেখা হয়েছে। আমার অনুষ্ঠান দেখে খুব খুশি হয়েছেন।
ততক্ষণে কান্নায় ভেঙে পড়ে সুলতা। শিবু বলেই চলে গত রাতের কথা।
শিবুর বুকে মাথা রাখে সুলতা। বলে, আমার উপর কি তোমার কোন রাগ নেই? কেমন মানুষ তুমি!