একটি নির্জন পাহাড়ের কথা – অভিজিৎ চক্রবর্তী

একটি নির্জন পাহাড়ের কথা    (ছোটোগল্প)

অভিজিৎ চক্রবর্তী

দেহেরও কোলাহল থাকে। নির্জনতা থাকে। থাকে নীরবতাও। একসময় যার তরঙ্গ সবাইকে স্পর্শ করত, এখন কাউকেই হয়তো ছোঁয় না। হয়তো সে মানা যায় না। হয়তো সে বেদনার, তবু সেই নীরবতাও সত্য। তারও অস্তিত্ব রয়েছে।
ট্রেন চলে গেলে পর তেমনই ঝিঁ ঝিঁ ডাকা নীরবতা। সরিতা চুপ করে তাকিয়ে রইল ট্রেনের চলে যাওয়ার দিকে। কেমন বড় সাপের মত বাঁক নিয়ে সেটি পাহাড়ের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল। সে যেখানে বসা, সেখানে থেকে ট্রেনের আসার দৃশ্য তেমন দেখা যায় না। ঘন সবুজ জঙ্গলের ভেতর থেকে হঠাৎ যখন বেরিয়ে আসে ট্রেনটি তখন অবাক লাগে। কী বিশাল। কী বিপুল। অস্বাভাবিক। পুরো একটা শহর যেন। কিন্তু চলে যাওয়ার দৃশ্যটি দেখতেই তার ভালো লাগে বেশি। কেন লাগে, সে জানে না সরিতা। আসার সময় ভীষণ শব্দে আশপাশ সচকিত হয়ে ওঠে। ধ্বনি প্রতিধ্বনি মিলে মিশে একাকার। খেয়াল না করলে মনে হয় কোনদিক থেকে যে আসবে সে। মাটি ফুঁড়ে নাকি জঙ্গল তছনছ করে। যেন ভীষণ দৈত্য এক। আর যখন চলে যায় একটু পরেই নেমে আসে তীব্র এক নীরবতা। ফের ঝিঝির ডাক। ঘণ্টিপোকার ধ্বনি। ফের রি রি করা নাম না জানা পতঙ্গের পাখার শব্দ। জলের কলকল। একটু আগে চলে গেছে ট্রেন। এখন ঠিক তেমনই নীরবতা। সরিতার মনের মতই নির্জন।
সরিতা বসেছে ঝরনার কাছে পাথরের উপর। অবশ্য একে ঝরনা বলা সঙ্গত নয়। খুব যে বড় তেমন নয়। আগে আরেকটু সরুই ছিল জলের রেখাটি। সরিতা ছোটোবেলা মায়ের সঙ্গে আঙুল ধরে, সখীদের সঙ্গে খেলতে খেলতে এখানে কত এসেছে। সেই শৈশবে, তখন চারদিকে খুমপুই ফুল ফুটে থাকত। বড় একটা নাগেশ্বরের গাছ ছিল এখানেই কোথাও। ট্রেন লাইন ছিল না। পাহাড়ের খাঁজে বাঁশের টল লাগিয়ে রাখলে পরিষ্কার জল চুঁইয়ে চুঁইয়ে নামত সারাক্ষণ। সরিতারা কলসী ভরে এখান থেকে জল নিয়েছে কত। এইরকম ঝরনা যদিও এই পাহাড়ে অনেকগুলিই ছিল। রেল কোম্পানির লোকেরা ওপাশের পাহাড় কাটলে ঝরনাগুলি গায়েব হয়ে যায়। তবে এই ঝরনাটি একটু মোটা রেখায় বইতে থাকে এরপর থেকে। বিভিন্ন দিকের জল চুঁইয়ে একসময় এদিকেই আসতে থাকে। এর ফলে নিচে গর্তের মতন হয়েছে। গর্তের মধ্যেই সে বসে থাকে কোমর ডুবিয়ে।
তবে সমস্যা হয়েছে একটাই। ঝরনাটি এখন রেলপথের প্রায় পাশেই। আগে ছিল বনের ভেতর গোপনে। এখন প্রকাশ্যে। সারাদিনই যখন তখন ট্রেন আসে। কোনটা যে কখন আসে, আসবে এসব এত হিসেব করতে পারে না সরিতা। আগে ছিল যাওয়া আসা মিলিয়ে চারটি ট্রেন। এখন বিভিন্ন দিন বিভিন্ন রকম। এক এক দিন তো সারাদিনই আসছে যাচ্ছে। কত কত মানুষ। মাঝে মধ্যে মাল ট্রেন। এছাড়া ট্রলি নিয়ে একটু পরে পরেই লাইন চেক করতে আসা শ্রমিকেরা তো আছেই। তাদের গায়ে কমলা রঙের শার্ট। ওই লোকেরা এখানে এলেই হা করে তাকিয়ে থাকে। হয়তো সে স্নান করছে। অনাবৃত শরীর। হয়তো জল ভরছে কলসীতে। ট্রলিটি এখানেই এসে থামবে। তারপর কিছুক্ষণ ফিসফিস গুঞ্জন। দূর থেকে না তাকালেও ঠিক বুঝতে পারে সরিতা লোকগুলোর মধ্যে একটা চোখের দৃষ্টি তাকিয়ে আছে তার দিকেই। ভয় অবশ্য হয় না। আগে অস্বস্তি হতো তার। অনেকদিন ইচ্ছা হতো জল না নিয়ে, স্নান না করেই ফিরে যাবে। তবে ইদানীং কেন জানি ভালো লাগে। নিজের মনের অদ্ভুত পরিবর্তনে নিজেই অবাক হয় সরিতা। মনে হয় দেখুক। দূর থেকে দেখুক। পাহাড়ের উচ্চতা যেমন সবাই দেখে দূর থেকে। সে সময় সে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে ঘাড় মাজে। হাত পা মাজে। জল ঢালে গায়ে। ঝরনার নিচে বসে থাকে। ঠাণ্ডা জলের ভেতরেও যেন উষ্ণতা টের পায়।

একদিন তো ট্রলি থেকে নেমে একটি যুবক সরাসরি তার দিকে এগিয়ে আসে। সরিতা হঠাৎ কী করবে ভেবে পায় না। আড়চোখে সে দেখে দু পাশে তাকাতে তাকাতে যুবাটি তার দিকেই এগিয়ে আসছে। তার সঙ্গীরা অবশ্য কেউ ট্রলি থেকে নামেনি। সরিতার বুক ঢিপ ঢিপ করতে থাকে। যত কাছাকাছি আসে ছেলেটি, সে যেন পোড়া বিড়ির গন্ধ পায়। রোদে পুড়ে তার গায়ের রঙ যেন ট্রেনের বাদামি গায়ের মত। কমলা রঙের শার্ট আর একটা ঘি রঙের প্যান্টে ওকে দেখাচ্ছে জমকালো। চেহারা ঠিক ঠাহর করতে পারে না সে। ভেতরে ভেতরে ত্রস্ত সরিতা একসময় অলক্ষ্যে পাশে রাখা খারাঙের ভেতর হাত চালিয়ে দেয়। সেখানে পাতা আর কলার মোচার তলায় রাখা আছে টাক্কল। লোকটি একেবারে কাছে আসতেই একেবারে পাথর হয়ে গিয়েছিল সে। কিছু একটা করলেই কোপ বসিয়ে দেবে, এই যখন সে ভাবছে আর দা-টি বের করেছে, লোকটি বলল, ‘পানি পিনা হ্যায়।’
সরিতা মুখে যেন কথা খুঁজে পেল না। সে খারাঙ নিয়ে একপাশে সরে দাঁড়াল। বাঁশের টলের নিচে হাত অঞ্জলি করে কিছুটা খেয়ে কিছুটা মুখে ছিটিয়ে আর কিছুটা পুরানো প্লাস্টিকের বোতলে ভরে যুবকটি চলে গেল। তার দিকে আর ফিরেও তাকাল না। সরিতার মনে মনে হাসি পেল। ছেলেটি সম্পর্কে ও কী ভেবেছে এতক্ষণ! যদি সে কোপ বসিয়ে দিত! যদি দিত, তবে ওইদিকের বাকি লোকগুলো কী করত! পালাত, না তার উপর আক্রমণ করত। ওরা তো জানে না তার রাগ।
এই যে এখন তার দিকে আর ফিরেও তাকাচ্ছে না যুবকটি, এটা কেমন যেন আবার মানতে পারছে না সরিতা। তার মধ্যে কি দেখার কিছুই নেই। ফিরে তাকাবার কিছু নেই! কেবল মাত্র জল খেতেই এসেছিল সে! সরিতা ফের তাকায়। বারবার তাকায়। যুবকটি সোজা ট্রলিতে উঠে বসে। প্যাডেলে চাপ পড়ে। ঘড় ঘড় শব্দে ট্রলিটি এগিয়ে যায়। যেতে যেতে দূরে পাতার আড়ালে অদৃশ্য হয়ে যায়। আবার নীরবতা। কান ফাটানো নীরবতা। আর কিছু নেই। যেন কোনো ঘটনা ঘটেনি এই মুহূর্তে। নিজের শ্বাসের শব্দে নিজেই চমকে ওঠে সে। নিজেকে নিজেই যেন চিনতে পারে না। এমন কেন হয়! কোন যুবক কাছে এলেই তার সমগ্র মনটি সংকুচিত হয়ে প্রতিরোধ খাড়া করে। অথচ তার মনই দূর থেকে ওকে চেয়েছিল। আবার দূরে গেলেই তার দিকে ধাবিত হয় মন।
মাঝে মাঝে ভাবে সরিতা সমান্তরাল এই ট্রেনের লাইন ছাড়া গোটা পৃথিবীর সঙ্গে তার যেন আর কোনো যোগাযোগ নেই। পৃথিবী হয়তো অনেক বদলে গেছে। মানুষের জীবনে কত কিছু এসেছে। কত কত আয়োজন। কতটুকুই জানে সে। তাদের গ্রামের লোকেরাও আর কতটুকু জানে। বাইরের ব্যাপারে যেন কোন আগ্রহই নেই। তাদের এই পাহাড় জঙ্গল ঝরনা সবুজ পাতার ভেতর এমন রি রি করা নীরবতার ভেতর কোথাও এই যে জীবন রয়ে গেছে, তাও তো আর মিথ্যা নয়। দরকারই যেন নেই। ঘন জঙ্গলের ভেতর থেকে হা হা শব্দে দৈত্যাকার ট্রেনটি বেরিয়ে এলে মনে হয় পৃথিবীতে তাদের গ্রাম পাহাড়ের বাইরেও আরো ভয়ঙ্কর কোনো মহাজগত আছে। তার ঠিকানা সে জানে না। কেবল এই ট্রেনের পাত দুটোতে হাত রাখলে, কান রাখলে যেন সে অনুভব করতে পারে দূর কোনো শহরের হৃদয়স্পন্দন। আবার ট্রেন চলে গেলে মনে হয় কিছুই নেই আর কোথাও। সবই কুহক। সবই বিভ্রম। সবই মায়া। কেন যেন মনে হয়, কেউ তার মনের খবর না জানলেও, এই যে দূর সভ্যতার লোকেরা তাকে দেখে যায়, এতে যেন তার হৃদয়টি সে খুলে দেখাতে পারছে। যেন তার সম্ভ্রম রইল গ্রামে, আবার কেউ জানতেও পারল না তার ভেতরের নির্জনতার কথা।

তাদের টিলায় লোক অনেক কম। গ্রাম বলা যায় না একে। মূলত সরিতাদের পরিবার আর তার কাকাদের পরিবার। আর একটা পাহাড় পেরিয়ে লুঙ্গার পরে পশ্চিম দিকে আছে একটি বস্তি। সেখানে অবশ্য বেশ কিছু মানুষ থাকে। তবে আগে নাকি ছিল এখানে বেশ লোক। সে অনেক দিন হবে। সরিতা দেখেনি সেসব। তার দাদুর তখন ছিল যৌবন। পরে গ্রামের অনেকেই চলে যায় টিলা ছেড়ে। মড়ক লেগেছিল নাকি সে সময়। ঘরে ঘরে ছোট ছোট ছেলে মেয়ে দুদিন তিনদিনের জ্বরে মারা যাচ্ছিল এক এক করে। কুমুদ চৌধুরি ছিলেন এলাকার চন্তাই। বলেছিলেন, এই পাহাড়ে কু বাতাস লেগেছে। সে এখন অভিশপ্ত। রক্ত চায়। গ্রামের অনেকেই সাধ্যমত কবুতর মুরগি শুয়োর বলি দিয়েও রক্ষা পায়নি। পরে ভয়ে সবাই সরে যায়। কেবল রয়ে যায় সরিতার দাদু। এখন অবশ্য কেউ নেই এদিকটায়। দাদু ঠাকুরমা শুধু নয় বাবা মা-ও মারা গেছে কয়েক বছর। কাকাও চলে গেছে আগরতলা। কাকাতুতো ভাইটি নাকি হকার্স কর্নারে কোনো দোকানে চাকুরি করে। আগরতলা বড় শহর। রাজ্যের রাজধানী। কখনো যায়নি সরিতা। নাম শুনেছে। বর্ণনা শুনেই তার অবাক লেগেছে। এমন হয়! হতে পারে! এই ট্রেনের লাইন ধরে এদিকে এগোলে অনেক গ্রাম পাহাড় জঙ্গল লুঙ্গা পার হয়ে নাকি আগরতলা, সেই রহস্যের দেশ!
রেলের পাত বসানোর পর ঝরনার এদিকটায় এখন আড়াল অনেক কমে গেছে। নির্জনতা অনেক কম। এক এক সময় মনে হয়, এখানে আর আসবে না। তবু আসতে হয়। ভালো লাগে আসতে। কেন সে আসে জানে না সরিতা। এই যে দূর পৃথিবীর মানুষ ওকে দেখে, তাদের প্রতিও কেমন যেন আকর্ষণ। বাড়ি থেকে এই জলের উৎসটিও অবশ্য কাছে। দুটো পাহাড় পেরোলেই। একটি পাহাড় পুরো পেরোতেও হয় না। তবে আরেকটি ঝরনা আছে পাহাড়ের ওধারে। সেটিতে তাদের গ্রামের অনেকেই যায়। সরিতা ওখানে খুব কমই যায়। তার গায়ের রঙ এখনো ফরসা। তবে রোদে পুড়ে গালের দুদিকে তামাটে বর্ণ ধারণ করেছে ইদানীং। কেমন ছোপ ছোপ দাগ। লাল রঙের কারুকাজ করা গাঢ় নীল রঙের রিগনাইটি সে আলগোছে বেঁধেছে স্তনের ঠিক উপরে। মুখে হাতে পায়ে সাবানের ফেনা বারবার জল দিয়ে ধুয়ে ধুয়ে পরিষ্কার করে। এবার দাঁড়িয়ে পাথরে পা ঘষতে থাকে সে। পাশে রাখা খারাঙ। ভেতরে জলের খালি কলসী। দুটো গাছের মূল আজ পেয়েছে সে, একটি খাকলুঙ, একটা কচু গাছের মোড়া, কলার থোড়। এগুলো সবই সে এখানে আসার সময় রাস্তা থেকে সংগ্রহ করেছে।
খারাঙটি পিঠ ও মাথার সঙ্গে বেঁধে মাথায় জলভরা কলসীটি নিয়ে সে পাহাড় বেয়ে উঠতে থাকে। এখানে জঙ্গল অনেক কম। সুপারি আর কলা গাছের দুর্ভেদ্য বন। ডান পাশের টিলায় রণিতারা জুম করেছে। ধান লাগিয়েছে। সবুজ ধানের শিখা সমস্ত পাহাড়টিকে শিশুর মাথার ছোট ছোট খাড়া চুলের মত ঢেকে রেখেছে। পুড়ে যাওয়া কালো গাছটির মাথায় দু একটি পাতা গজিয়েছে। মানে সেটি মরেনি এখনও। সরিতা ভাবে, জুমের এত আগুনেও গাছটি মরেনি। কোন কোন মানুষ থাকে এমন, অনেক যন্ত্রণাতেও কিছু হয় না। যেমন তার মা। এই পাহাড়ে তার মা আগে ধান লাগাত নিজের হাতে। সারা বছর তাদের আর খাবারের চিন্তা করতে হতো না। এখন অবশ্য রণিতাই করে ক্ষেতটি।
রণিতা সরিতার আপন ছোট বোন। বিয়ে হয়েছে দু বছর হল। তাদের গ্রামেই থাকে। তাদের ঘরের পাশেই ওরা ঘর তুলেছে। সরিতা থাকে পুরানো টঙেই। রণিতার স্বামীটি সারাদিন মদ খায় আর চঙপ্রেঙ বাজিয়ে গান গায়। খুব সুন্দর গান বাঁধে ও। সরিতার আগে মনে হতো তাকেই যেন শোনায় সে তার গান।

তোমার চোখে জুম
আমার চোখে তুমি
এসো, হাত ধরো

মাথায় দিই খুমপুই
বুকে বেঁধে দিই রিসা
যদি এসে হাত ধরো

আমি একা একা
টিলা থেকে পড়ে যাই
আমাকে বাঁচাও

তুমি জনহীন
লালসুতো রিগানাই
চঙপ্রেঙে সুর জাগাও

গানগুলো তার শরীর অবশ করে দেয়। কাউকে কিছু বলে না সরিতা। টিলার উপর যখন ভুবন চঙপ্রেঙ বাজিয়ে গান করে মন উদাস হয়ে যায় তার। কেবলই মনে হয়, সেও হয়তো কাউকে ভালোবাসতে পারত। কেউ যদি ওকেও ভালোবাসতো!
এসব ছাড়াও ভুবন খুব দারুণ শুয়োর বলি দিতেও পারে। গেল বছর সরিতার বাবা মারা গেলে অনুষ্ঠানে সবাইকে খাওয়ানোর জন্য সে-ই তো এক কোপে বলি দিয়েছে শুয়োর। শুয়োরটি হয়েছিল বটে খুব নধর। খাসা তার শরীর। যে খেয়েছে ধন্য ধন্য করেছে। রণিতা তার মর্জি মতো বিয়ে করেছে। ভুবন অবশ্য তাদের জাতের। রিয়াং। দক্ষিণে আরো দুই পাহাড় পেরোলে ওর ঘর। পশ্চিমের বস্তিতে শিমুলদের বিয়ের সময় এর সঙ্গে যোগাযোগ ঘটে রণিতার। রণিতা আর ভুবন নাকি সারারাত লাঙ্গি খেয়ে সবার সঙ্গে নেচেছে। এরপর কোনদিকে সরেও পড়ে। পরে ভোরের দিকে ঘরে ফিরেছে রণিতা। বাবা কিছু বলেনি। মা খুব ধমকেছিলেন। রণিতা ছোটোবেলা থেকেই একটু উচ্ছৃঙ্খল। খালি ছেলেদের সঙ্গে। চেহারা এত সুন্দর নয়, ঠিকই কিন্তু তার চলাফেরা ছেলেদের নজর কাটত বেশি। সে বার একটু বেশিই হয়েছিল। মাকে সরিতা কিছুই জানায়নি। কিন্তু শুনেছে জোছনা রাতে রণিতা আর ভুবন দক্ষিণে ঝিলের কাছে বুড়া দেবতার থানের কাছে সারারাত একে অন্যকে উলঙ্গ হয়ে আদর করেছে। বুড়া দেবতা মানে তো শিব। শিব ঠাকুরের সামনে এমন কাজ! কুমুদ চন্তাইয়ের ছেলে রাখাল মত দিয়েছে, ওদের বিয়ে দিতে হবে। সেই মোতাবেক বিয়ে। বিয়ের পর ভুবন অবশ্য বাড়িতে আর ফিরে যায়নি। রীতিনীতি মেনে এখানেই থেকে গেছে। এক দুবার গেলেও বাড়িতে আর রাত্রি যাপন করেনি। বিয়ের পর এক দুবার ওদের টঙের পেছনে, কখনো টিলার ভাঁজে, রাত্রিতে বা খুব ভোরে ওদেরকে জাপ্টাজাপ্টি করতে দেখেছে সরিতা। ভুবন সে সময় বুনো শুয়োরের মত হয়ে যায়। ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দ করতে থাকে। অথচ অন্য সময় সে কতো শান্ত। সরিতা মাঝে মাঝে তাকায় ভুবনের দিকে। কী সুন্দর পেটানো শরীর!
রণিতা যত উচ্ছৃঙ্খল হয়েছে, সরিতা তত নিজেকে সংযত করেছে। সবাই তখন কেবল সরিতারই প্রশংসা করত, কত সুন্দরী মেয়ে, লক্ষীমন্ত। কোথাও কারো সাতেপাঁচে নেই। মনে হত, এভাবেই চলতে হবে। সবার কথা মতো। সবাই যাতে ভালো বলে। কারো দিকে তাকায়নি। কোনো ছেলের দিকে না। যদি কেউ তাকিয়েছে, পরক্ষণেই তীব্র রাগ আর ভর্ৎসনায় তছনছ করে দিয়েছে সব। একবার পশ্চিমের বস্তির একটি ছেলে ওর হাত ধরে টান দিয়েছিল। সন্ধ্যা হয়েছে সবে। জোছনা রাত। মা আগে আগে হাঁটছিলেন। বাড়িতে ফেরার কথা। ছেলেটি হাত টান দিয়ে ওকে ঝোপে এনে ফেলেছিল। কাশের বন। কাশ ফুটেছে সমস্ত খোলা প্রান্তর জুড়ে। সরিতা হুমড়ি খেয়ে মাটিতে পড়ে যাচ্ছিল। ছেলেটির কী অমানুষিক শক্তি। আকড়ে ধরেছিল।
‘আমি তোকে ভালোবাসি সরিতা।’
সরিতা কিছুটা আচমকা টানের ঝোঁকে, কিছুটা বিহ্বল হয়ে কথা হারিয়ে ফেলেছিল। ছেলেটি তীব্র আকর্ষণে তার ঠোঁটদুটো নামিয়ে এনেছিল প্রায় তার ঠোঁটের উপর। কিছুই বুঝতে পারছিল না সরিতা। শরীর অবশ হয়ে পড়েছিল। একটা ভালো লাগা ছিল ভেতরে কোথাও। আবার একটা বিতৃষ্ণা। পাক খেয়ে ডুবে যেতে যেতে হঠাৎ সরিতা এক ঝটকায় ওকে দূরে ঠেলে দিয়েছিল। তারপর লাফ মেরে ওঠে দাঁড়িয়ে বলেছিল, ‘আয়, এগিয়ে আয় একবার, তোর ঠ্যাঙ ভেঙে ফেলব।’
‘ঠ্যাঙ ভাঙবি? আমি তো তোকে ভালোবাসি।’
‘ভালোবাসি? আমাকে কী পেয়েছিস? দুশ্চরিত্র! ছিঃ ছিঃ আমার শরীরটা ছুঁয়ে দিলি।’
‘ছুঁয়ে দিলে কী হবে? ভালোবাসলে তো ছুঁতেই হয়।’
‘না।’ এমনভাবে সে আর্তনাদ করে উঠল ছেলেটি ভয় পেয়ে গেল।
‘কেন? আমি কতদিন তোর পিছন পিছন ঘুরেছি। তুই বুঝতে পারিসনি, তোকে ছাড়া আমি পারব না সরিতা।’
‘তা বলে বিয়ের আগেই?’
‘আমি তোকে বিয়ে করতে চাই।’
‘না।’
‘কেন না? বাবা মা আমাকে যেখানে বিয়ে দেবেন, আমি যাব সেখানেই।’
‘শোন, সরিতা আমরা এখানে টঙ বানাবো, জুম করবো। আমাদের বাচ্চা হবে।’
ছেলেটি ওর দিকে ধীরে ধীরে এগোচ্ছিল। ভীত সে পিছন দিকে যাচ্ছিল। হঠাৎ রাগ উঠে গিয়েছিল তার। সেই বুনো রাগ। যে রাগ উঠলে তার হুঁশ থাকে না কিছুই। পেছনের খারাঙ থেকে একটি কাচি বের করে সে অন্ধকারে সাঁই করে ঘোরালো। এরপরই সুতীব্র চিৎকারে আকাশ বাতাস পাহাড় কেঁপে উঠলো।
‘মেরে ফেললো রে।’ ছেলেটির একটি আঙুল কেটে নিচে গড়িয়ে পড়েছে। বাঁহাতে তাকে মুঠি করে ধরে ছেলেটি জঙ্গলের ভেতর কোথায় যে অদৃশ্য হল, আর তাকে দেখা যায়নি।
এরপর কেউই তার দিকে তেমন তাকাত না। ভয় করত। ভাবত কী দেমাক ওর। বলতে গেলে তখন সরিতার ভালোই লাগত এসব। সে যেন, নিজের চরিত্রে, পবিত্রতায় সবাইকে মাথা নুইয়ে দিত। ছেলেদের তাকানোটাই তার কাছে অপবিত্র মনে হতো। ঘিন ঘিন করে উঠত শরীর। সে থাকবে খুমপুই ফুলের মত। সেসব এখন অতীত।

কীভাবে যে সময় চলে গেল। বাবা মা মারা গেল ঝটপট। এখন বয়স পড়েছে। শরীর ভেঙেছে। আগের সেই রূপ কোথাও যেন নেই সরিতার। অথবা থাকলেও না তাকানোটাই যেন অভ্যাস করে ফেলেছে সবাই। বা তাকে কি এখন সবাই নারী ভাবে আর! পুরুষই ভাবে হয়তো! যেন তার নারী অস্তিত্বই কোথাও যেন নেই। তার শরীর জীর্ণ নয়। তবে তার স্তন ছোট হয়ে এসেছে। নিতম্বও শুকনো। গায়ের ঔজ্জ্বল্য যেন ম্লান হয়ে আসছে। পড়ন্ত যৌবন। কিন্তু এখনো সে মনেপ্রাণে রমণীয়। হ্যাঁ সমাজের সম্মান সে চায়, কিন্তু এটাও তো সে চায় কেউ তাকে দেখুক। পুরুষ তাকে দেখুক। ভালোবাসুক। একটু আদর করুক। এখন যেন আরো বেশি করে চায়। অথচ তার মন পাহাড়ের মত একাকী। উদ্দেশ্যহীন ঝরনার মত নিরুপায়।
পাহাড়ের ঢালে পাক খেয়ে খেয়ে টঙে ফিরে আসে সরিতা। সিঁড়ি দিয়ে উঠে মাথার কলসী ও খারাঙ একদিকে নামিয়ে রাখে। তারপর খারাঙ থেকে বের করে সবজিগুলি। ঘরটি নেহাত ছোট নয়। তার বাবার আমলে তৈরি যদিও, তবু সরিতা নিজের হাতে টংয়ের ছাদে ছন লাগিয়েছে দু বার। নিজের হাতে পেছনের বাঁশঝাড় থেকে বাঁশ কেটে বেড়া বদলেছে। তবে নিচে মোটা মোটা গাছের গুঁড়িগুলি অনেক পুরানো ও মজবুত। বাবা ও মায়ের হাতের ছোঁয়া যেন লেগে আছে তাতে। কিছুক্ষণ মেঝেতে চুপ করে বসে রইল সরিতা। কোনোদিকে কোন আওয়াজ নেই। নিঝুম। রণিতার টঙটি পাশের টিলায়। সেখান থেকেও কোনো আওয়াজ নেই। অনেক সময় ভুবন গুনগুন করে গান করে। বিশেষত গলায় একটু ঢাললে ও গান করে বেশ। হঠাৎ করে তার মনে হয়, সে একা। এই ঘরে শুধু নয়, এই পৃথিবীতেই সে একা। তাকে দেখার মত কেউ নেই। বুক ফাটিয়ে চিৎকার করতে চায় সে। পারে না। সম্ভ্রম। টঙের মেঝেতে শুয়ে থাকে সরিতা। ক্লান্তিতে আচ্ছন্নের মত পড়ে থাকে সে অনেকক্ষণ।

আজও তেমন পূর্ণিমা। জোছনার পবিত্রতম রাত। সরিতার খুব একা লাগে। প্রান্তরের নীরবতা তার মনে। পূর্ণিমা এলেই সেদিনের কথা মনে হয় তার। একটি ছেলে ওকে ভালোবাসতে এসেছিল। ওকে জড়িয়ে ধরেছিল। তার এই শরীরটি, যাকে সে দীর্ঘদিন পবিত্র করে রাখতে চেয়েছিল, সেটিই ছুঁয়ে দিয়েছিল জোর করে। ঐ একবারই। আর সারটা জীবনে তার কোনো প্রেমিক জোটেনি। সে যেন এখন পাহাড়ের মতন নির্জন। অনাঘ্রাতা তার শরীরটি কোথাও কাজে লাগেনি। অস্তগামী সূর্যের মত তার যৌবন ব্যর্থ। কেউ আর ভালোবাসেনি ওকে। সে এতদিন ভাবত সবার শ্রদ্ধা আছে তাকে ঘিরে। এখন বুঝতে পারে, এটি শ্রদ্ধা নয়, ভয়। সমীহ। সে শেষ হয়ে গেছে বোধহয়। এতদিন পরে সে বুঝতে পারে আসলে সবার দৃষ্টির মধ্যেই সে নিজেকে খুঁজে পেয়েছিল। যতদিন তার দিকে সবাই তাকায়, ততদিন সে ভেতর থেকে ছিল গর্বিত। হয়তো ছিল তার ছদ্মরাগ। কিন্তু ভেতরে ভেতরে এটিই চাইত! নিজের মনের এই পরিচয়ে সে একদিন নিজেই অবাক হয়ে গিয়েছিল।
এঃ সেই ছেলেটি জানি আজ কোথায়! সে কি বিয়ে করেছে! হয়তো করেছে। হয়তো করেনি। তার কাটা আঙুল যেখানে পড়েছিল সেখানে বহুদিন পরে একদিন গিয়েছিল সরিতা, রক্তের কোনও চিহ্ন নেই কোথাও। মনে হয়েছে সেখানে খুব দীর্ঘ ঘাস উঠেছে। কিন্তু এতদিন পরে আজ কেন মনে হয় তার সেসব। সবাই তাকে ভাবে সে পবিত্র। সে সুশীল। অথচ সে আর পবিত্র থাকতে চায় না। সেও চায় তার শরীরটি কেউ ভালোবাসুক। দিন দিন বয়স বাড়ছে তার। সে জানে আর তাকে বিয়ের জন্য কেউ আসবে না। কেউ এখন আর তার দিকে ফিরেও তাকায় না। সে এখন ট্রেন চলে যাওয়ার মতন নির্জন নীরব। কমলা রঙের শার্ট পরা শ্রমিক যুবকটির কথা মনে হয়। যেদিন সে প্রথম আসে এরপর থেকেই নিজেকে সরিতার প্রয়োজনীয় মনে হতে থাকে। যেন মান ফিরে পায় সে। কমলা রঙের শার্ট প্রতিদিন সময় করে এখানে আসে। ট্রলিটি দূরে দাঁড়িয়ে থাকে। হেলতে দুলতে সে ঝরনার কাছে এসে দাঁড়ায়। জল চায়। সরিতা সরে দাঁড়ায়। যুবকটির গরম নিঃশ্বাস তার বুকে ঢেউ তোলে। আজও এসেছিল সে। ট্রেন চলে যাবার অনেক পরে ট্রলি থেকে নেমে এসে দাঁড়িয়েছিল জল নেবার জন্য। এখন আর সরিতা খারাঙে হাত দেয় না। সে অপেক্ষা করে কিছু একটা বলবে বলে। কিন্তু সেদিনের পর থেকে তৃষ্ণার্ত চাতক পাখির মত যুবকটি তাকালেও মুখে কিছু বলতে সাহস করে না। সরিতা জানে একদিন যদি একটু ইঙ্গিত দেয়, তবে ট্রলি ছাড়াই হয়তো যুবকটি কোনদিন এসে দাঁড়াবে, অথবা এমনও হতে পারে ট্রলি ফিরে গেলেও যুবকটি থেকে যাবে। কিন্তু সরিতা কোনো ইঙ্গিত দেয় না। যদিও তার ভেতরে এতদিনের সম্ভ্রম কাজ করে। অপরাধবোধ মনে আসে। তবু ঐ দৃষ্টির সামনে তার বুকের ঢেউ গোপন করতে ইচ্ছা হয় না। নিজেকে প্রমাণ করতে সে যেন মরীয়া।

জোছনায় কাতরাতে কাতরাতে একটানে খুলে ফেলে সে তার রিগনাই আর রিসা। খোলা টঙ ঘরে সম্পূর্ণ উলঙ্গ হয়ে শুয়ে থাকে। তার শরীর শিরশির করতে থাকে। মনে হয় সমস্ত পাপড়িগুলি কাপছে। আঃ এখনো সে মরে যায়নি। পবিত্র খুমপুইয়ের মত সে বাতাসে দোলে। আজ পূর্ণিমা। বহু যুগ আগের সেই ছেলেটির কথা মনে হয় তার। ছেলেটি কি জোছনা হয়ে গেছে! হাল্কা নীল আলোয় শুয়ে শুয়ে তার মনে হয় তার শরীর এখনো জীর্ণ নয়। এখনো পুষ্ট তার স্তন। লাবণ্যময় দেহ। এখনো সে প্রার্থিত অনেকের। এখনো সে নিভে যায়নি। হয়তো সে বিবাহোত্তীর্ণা। তবু কমলা রঙের শার্টটি প্রতিদিন তাকে দেখতে আসে। আজও এসেছিল। তার চোখের সামনে অনাবৃত শরীর সে ঘষে ঘষে পরিষ্কার করেছে। তার লোলুপ দৃষ্টিতে সে বুঝেছে এখনো তার আগুন নিভে যায়নি। জানে সে নির্জন পাহাড়ের মত একা। তবু বরফাবৃত নয় সে পাহাড়।

টিলা থেকে গান ভেসে আসে।