করোনায় কালো এক মধুর রাত – অন্তিম রায়

করোনায় কালো এক মধুর রাত        (ছোটোগল্প)

অন্তিম রায়

“হাই, টীম, হাউ আর ইউ? আই’ম নট ওয়েল”।
সন্ধ্যার দিকে একটা ম্যাসেজ এল। আমি সাথে সাথে একটু আশ্চর্য হয়ে ওকে রিপ্লাই করলাম, হোয়াই ইউ আর নট ওয়েল, হট হ্যাপেন্ড?
ও উত্তর করল, আমি সাস্পেক্ট করছি, মনে হয় আমি করোনায় আক্রান্ত।

আমি একটু ব্যস্ত হয়ে বললাম, তুমি কেন তা মনে করছ?
⸺ সিম্পটম তো তাই বলে।
⸺ সাধারন ফ্লু’র সিম্পটমও তো সেইম? তোমার কি পরীক্ষা হয়েছে?
⸺ না।
⸺ তাহলে কি করে বলছ?
⸺ আমার সোর থ্রোট, ড্রাই কফ, এবং টেম্পারেচারও হাই। এভাবেই চোলছে সপ্তাহখানেকের উপর। কিছুতেই কিছু হচ্ছে না।
⸺ ডক্টরকে ফোন করেছিলে?
⸺ ইয়া, বাট ডক্টর বলেছে ঘরে থাকতে। ব্রেথিং প্রব্লেম হলে তবেই ইমারজেন্সিতে ফোন করতে।

মনে ভাবি, আজ এই ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র শত্রুর আক্রমণে পরাশক্তির এই দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাও আমার দেশের সমপর্যায়ে চলে গেছে!
আসলে এখন সান্ত্বনার বাণী কি হতে পারে আমি তা জানি না। কি বলব ভেবে পাচ্ছি না। কি বলতে কি বলে হঠাৎ ষ্টুপিডের মত বললাম, খেয়েছ কিছু?
ও এর কোন উত্তর দিল না। কিন্তু যে রিপ্লাই করল তাতে যেন একরাশ আর্তনাদ এসে আমার গায়ে ঢেউ খেলে গেল। বলল, আই ফিল লোনলি, টীম!
আবার আর এক মহা ঝামেলায় পড়লাম, কি করব কি বলব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না।
তারপরো জিজ্ঞেস করলাম, তুমি কি একাই?
উত্তর করল, হুম, আমি আর আমার বেবিটা। বলেই আবার বলল, আচ্ছা ঠিক আছে ভাল থেক।
আমিও বললাম, টেক কেয়ার।
মনের মধ্যে কেমন খচ খচ করতে লাগল। কি এক পরিস্থিতি হয়েছে কিছুই বলার বা করার উপায় নেই।

পুরো যুক্তরাজ্য জুড়ে চলছে লকডাউন। আমারও কাজ নেই সপ্তাহ তিনেক। পুরো ঘরে বসা, প্রধান ফটকের বাইরে যাওয়া  হয়নি পুরো এই একুশ দিনই। কারো সাথে কোন যোগাযোগও নেই। চারদিকে কেমন শুনশান নীরবতা।
আমরা বাসার চারজনই সিটিং রুমে বসে কি একটা হিন্দি মুভি দেখছি। হঠাৎ আমাদের একজন মামুন ভাই আমাকে উদ্দেশ্য করে বলল, আরে কতদিন তো হয়ে গেল, আশপাশের দু-একজনকে ফোন দেন, দেখেন কি হল, তারা বেঁচে আছে না মরে গেছে। যদিও ইয়ার্কির ছলে কথাটি বলেছিল কিন্তু আমার মনে বড় দাগ কাটে। ভাবলাম, আসলেই তো, এতদিন হয়ে গেল কাউকেই এপর্যন্ত ফোন দিলাম না?
সাথে সাথেই নিজের রুমে এসে পরিচিত ও বন্ধুবান্ধবদের সকলকে ফোন দিলাম এবং শুনে আশ্বস্ত হলাম যে, আমার মতই তারা সকলেই ভাল আছেন।
কি মনে করে, সকলেরই খোঁজ নিচ্ছি হয়তো তাই, একটা ইংলিশ মেয়ে; আমার কর্মস্থলের পাশেই ইন্টারসেপ্টর নামক একটা ইংলিশ রেস্তোরায় কাজ করে। তাকে ফোন না দিয়ে একটা টেক্সট করলাম, হাই হলি, কেমন আছ? বাইরে যেও না, ঘরে থেক, নিজের যত্ন নিও।
আমি জানি এর কোন উত্তর আসবে না। কারণ যেদিন ঐ মেয়েটি নম্বর দিয়েছিল, সেদিনই রাত্রে  অন্য আর একটি মেয়ে কল করে জানিয়েছিল, এটা অন্য কারো নম্বর, তোমাকে ও আসলে বোকা বানিয়েছে। তাই উত্তরের জন্য আমি ততোটা উদ্‌গ্রীবও ছিলাম না। তবে খানিকটা অবাক করেই সেই সকালে টেক্সট করলেও তার উত্তরটা এসেছে এই মাত্র।

প্রথম স্টেজের লকডাউন তো দিনের পর দিন কেবল বাড়ছেই। মৃতের সংখ্যাও এক দুই করে দিনে হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে। ঘুম থেকে উঠে প্রতিদিনই ভাবি, আজ হয়তো মৃতের সংখ্যা একটু কম শুনতে পাব, কিন্তু প্রকৃতির খড়্গ দিনে দিনে যেন আরো ধারালো হচ্ছে, গত দিনের তুলনায় আজ আরও শতেকজন বেশি।

দুপুরের দিক একটু বের হয়েছিলাম জরুরি প্রয়োজনে, যা ছিল একান্ত খুবই দরকারি। স্মলহিথের কোভেন্ট্রি রোডের দুধারের সকল দোকানই বন্ধ। ছিটেফোটা দু-একজন আর মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ি ছাড়া কিছুই চোখে পড়েনি। দিনের বেলায়ই কেমন নিশিরাতের ভূতুড়ে পরিবেশ। যেখানে এই কিছুদিন আগেই কিনা ছিল দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা মানুষের আনাগোনা। আমার বাসা থেকে মাইল খানেক দূরে হেঁটে গিয়ে গ্রোসারি কিছু শপিং করে ভিতরের রাস্তা ধরে স্মলহিথ পার্কের মধ্যে দিয়ে হেটে কোণার ফার্মেসিতে গিয়ে দরজায় ধাক্কা দিয়ে দেখি, বন্ধ। কিন্তু ভিতরে লাইট জ্বলছে, লোকও আছে। হঠাৎ চোখে পড়ল দরজার সাথেই সাঁটানো নোটিশটার উপর। লেখা আছে, কিছূ চাইলে, বেল চাপুন। যথারিতি বেল চাপলাম, ভেতর থেকে একটি লোক আমার দিকে এগিয়ে আসল। লোকটি চেঁচিয়ে ওপাশ থেকে বলল, কি চাই?
আমিও চেঁচিয়ে দুটো ওষুধের নাম বললাম। ভাবলাম ওষুধ দেওয়ার সময় বা টাকা নেবার সময় বুঝি দরজা খুলবে হয়তো ভেতরে ঢুকতে দেবে না। কিন্তু না, আরো অবাক হলাম, লেটার বক্সের ভেতর দিয়ে আদান প্রদান হল।
মনে ভাবি হায়রে, মানুষ এতটাই আতঙ্কিত!

যাহোক ঘন্টা দুয়েক পরে কোন ম্যাসেজ নয় সরাসরি ফোন দিলাম। দুটো রিং হতেই, ওপাশ থেকে রিসিভ করল, খুব আতংকিত স্বরে বলল, হাই টীম।
আমি বললাম, আর ইউ ওকে?
শুকনো কাশিতে বলল, নো, নট এট অল।
আমি নিজেও খুব ভয় পেয়ে গেলাম। খুব ব্যস্ত হয়ে বললাম, ডক্টরকে কল করেছিলে?

হলি খুব রেগে বলল, ওহ! ব্লাডি ডক্টর সেইড, যখন তুমি ব্রেথিং প্রব্লেম ফিল করবে তখন ইমার্জেন্সিতে কল কর।
আমি বললাম, আমি কি আসব?
ও কাশতে কাশতে হেসে বলল, তুমি এসে কি করবে তুমি কি ডক্টর?
আমার ভুলের জন্য আমি নিজেই খুব বোকা বনে গেলাম। কিছুক্ষণ চূপ থেকে বললাম, খাবার আছে?
⸺ না, অর্ডার করব।
⸺ ছেলেটা ভাল আছে?
⸺ হুম, ভাল আছে। ওকে টীম, টেক কেয়ার, বাই।
⸺ বাই, বলতেই ওপাশ থেকে ফোনটা কেটে দিল।

ভাবি, এদেশের যে সমাজ ব্যবস্থা তাতে এসময় বয়ফ্রেন্ড বা হাজব্যান্ড ছাড়া কাছে থাকার আর কেউ নেই। হঠাৎ মনে পড়ল, কোন সাহসে আমি বললাম, আমি কি আসব? এই সময় কেউ কারো বাসায় যায়? যে আমি কিনা একটা মুহূর্তের জন্য বাইরে যাই না, যে কিনা ভয়ে সব সময় তটস্থ থাকি, অন্যকে বাইরে না যাওয়ার জন্য শাসাই। সেই কিনা চায় একজন করোনা আক্রান্ত রোগীর ঘরে যেতে! যদি সত্যি সত্যিই যেতে বলত? এখন ওর কাছে স্বেচ্ছায় যাওয়া মানে আত্মহত্যার সামিল।

কিন্তু তারপরও কি যে এক টান পড়ে গেল, বুঝে উঠতে পারি না। প্রতিটা মুহূর্ত যেন আমার মনটা পড়ে থাকল হলির ঘরে। ঘন্টাখানেক পরে আবার ফোন করলাম। ঠিক আগের মতই এক রিঙ্গেই ফোন ধরল, যেন আমার ফোনের অপক্ষায়ই সে ছিল। রিসিভ করেই বলল, ওহ! টিম থ্যাংক ইউ, থ্যাংক ইউ মাই ডিয়ার।
⸺ এখন কেমন বোধ করছ?
⸺ কিছুটা ভাল।
⸺ খাবারের অর্ডার করেছ?
⸺ না এখনো করিনি।
⸺ কেন?
⸺ করব।
⸺ হট ওয়াটার ড্রিংক কর। শরীর গরম থাকলে প্যারাসিটামল খেও।
⸺ ওকে ডিয়ার, থ্যাংক ইউ।
⸺ ও, আর এক কথা, যদি চাও তো আমার এক ফ্রেন্ডের রেস্তোরেন্ত আছে, আমি অর্ডার করতে পারি। যদি চাও, তো তোমার এড্রেস এবং কি খাবে আমাকে টেক্সট কর।
⸺ ওহ! রিয়ালি? ইউ আর সো কাইন্ড। ওকে, আই’ল টেক্সট ইউ ইন আ মিনিট।

ও বেশি দেরি করল না, কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাকে এড্রেসসহ খাবারের অর্ডার টেক্সট করল।
আমিও দেরি না করে রেডি হয়ে বের হলাম রেস্তোরায়। খাবার তৈরি হলে আমার বন্ধুটির সাথে আমিও গেলাম ওর বাসায় ডেলিভারি করতে। এরমধ্যে বার দুয়েক কথাও হয়েছে হলির সাথে মেনু পাল্টাতে ও আর কিছু লাগবে কিনা সেজন্য।

গাড়ি পার্ক করতেই আমি দরজা খুলে বের হলাম, মাসুম ভাই মানে আমার বন্ধুটি বলল, ফোন করে খাবারটা ডোরের সামনা রেখেই চলে আয়।  আসলে করোনার ভয়াবহতায় লকডাউনের পর, টাকা পেমেন্ট হয় কার্ডে আর খাবারটা সরাসরি হাতে না দিয়ে নক করে দরজার সামনে রেখে আসতে হয় আর এটাই এখন নিয়ম।
আমি খাবারের ব্যাগটা হাতে নিয়ে দরজায় নক করে দাঁড়িয়ে আছি। এদিকে মাসুম ভাই ড্রাইভিং সিটে বসেই কাঁচটা একটু নামিয়ে তাড়া দিতে লাগল, কিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেন? দরজার সামনে ঐ তো ওখানেই রেখে চলে আয়।
কিন্তু আমার মন সরছিল না ওর সাথে দেখা না করে যাওয়ার। ও অসুস্থ, কি করে যাই ওর সাথে দেখা না করে? মনের মধ্যে কেমন যেন একটা দায় কাজ করতে লাগল।
দরজা খুলে আমার সামনে ও দাঁড়াল, কিছু বলল না, ছোঁয়াচের শিষ্টাচার না থাকলে হয়তো এতক্ষণ জড়িয়ে ধরে গালে চুমু দিত, যেটা এদেশের সচরাচর নিয়ম আর কি। আমি তাকিয়ে আছি এক ধ্যানে, সাদা হাল্কা প্রিন্টের টিশার্টের সাথে কালো নিলাভ রঙের একটি হাফ প্যান্ট, অগোছালো এলোমেলো নাতিদীর্ঘ হাল্কা কোঁকড়ানো চুলগুলো ঘাড় অব্দি ছড়িয়ে আছে। ছলছলে রক্তরাঙা চোখ, শুকনো মুখে শুষ্ক ঠোট কি যে ক্লান্তিকর হয়ে মায়াবীয়তায় ভরে উঠেছে, আমার ভেতরটা কেমন নাড়া দিয়ে উঠল। আমি কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকলাম। হলিও কিছুটা বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকল আমার দিকে। ও জানে আমি ওকে খুব পছন্দ করি। তাই আমার এমন চাহনিকে ও অসভ্যতা মনে করল না।

দরজায় দাঁড়িয়ে আমার হাত থেকে খাবারের ব্যাগটা নিতে হাত বাড়াতেই, কাশতে শুরু করল।  সে কি কাশি! কাশতে কাশতে যেন প্রাণ যায় যায়, দরজাটা ধরে মাথা নিচু করে যেন নুইয়ে পড়ে যাচ্ছিল, তাই ওকে ধরে তোলার জন্য যেইনা আমি ওর দুপাশের দুই কাঁধ ধরতে যাব, ওমনি ও শাউট করে উঠল, লিভ মি, ডোন্ট টাচ মি, ইউ’ল এফেক্ট।
আমি সাথে সাথে চমকে উঠে দুই পা পিছু হঠলাম। কিন্তু ওর কাশির তীব্রতাটা যেন ধীরে ধীরে আরও বাড়ছিল। কাশতে কাশতে নুইয়ে পড়তে পড়তে যেন পড়েই যাচ্ছিল। দূর থেকে আমি বার বার ডেকেই যাচ্ছি, হলি, ইউ ওকে, ইউ ওকে, হলি?  ও মাথা তুলে তাকাল, রক্তবর্ণ চোখ। হাত ইশারায় বলছে তুমি চলে যাও।
যদিও বা খুব কষ্ট হচ্ছিল তারপরও কিছুই করার নাই ভেবে দরজার সামনে খাবারের ব্যাগটা রেখে চলে আসছি, দুই পা এগিয়ে আবার পেছন ফিরতেই দেখি দরজার সামনে ও পড়ে গেছে। কি মনে হল, কি করা উচিত, আমার হিতাহিত কোন জ্ঞান নেই, দৌড়ে গিয়ে ওর দুই কাঁধ ধরে টেনে তুললাম। ও যতই বলছে আমাকে ছোঁবে না, আমাকে ধরবে না আমি ওর কোন কথাকেই আর গ্রাহ্য না করে, জোর করে ওকে ধরে সামনের সিটিং রুমে সোফায় বসালাম। ও কাশতে কাশতেই, আমার হাত ঝাড়া দিয়ে, বিরক্তির স্বরে বলল, এনাফ ইজ এনাফ। দিস ইজ টু মাচ। তুমি কি আমার সাথেই মরতে চাও? ইটস নট আ জোক।
আমি কোন উত্তর না করে, ওকে শুধু বললাম, রিলাক্স হলি, রিলাক্স ডিয়ার।
ও কাশতে কাশতে সোফার উপর আবার নুইয়ে পড়ে। এবার আর সাহস করে ওর কাছে যাই না। আর এমনিতেও আমি দরজা হতে সোফা পর্যন্ত আনতে হাঁপিয়ে গেছি। মোটা বললে অত্যুক্তির সাথে সুন্দরী রমণীর সৌন্দর্যের ভাটা পড়ে, আবার অপমানিতও হয় বটে, তাই তাকে মোটা না বলে স্বাস্থ্যবতী বললে অতিরঞ্জিত হবে না।

কাশতে কাশতে ও কিছুটা থিতু হলে, আমি দরজার দিকে এগিয়ে যাই। দেখি মাসুম ভাই গাড়ি থেকে নেমে বাড়ির আঙ্গিনার বাইরে ফুটপাতের উপর দাঁড়িয়ে, বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে আছে দরজা ভেদ করে। হয়তো ভাবছে মেয়েমানুষের পাল্লায় পড়লে কারোই কোন জ্ঞান থাকেই না, সেই সাথে মৃত্যুর ডরভয়ও পালায় কোন মেয়ের সামনে ভাব দেখানোর কারণে।
সে রেগে বলতে লাগল, এখন উপায় কি বল, আমি তো তোকে আমার গাড়িতে আর তুলব না, তোকে গাড়িতে তুললে আমি আক্রান্ত হব, ভাইরে আমার বউ আছে ছেলে আছে, আর বাসায়ই বা ঢুকবি কি করে? তোর জন্য বাসায় এখন সবাই আক্রান্ত হবে। বল এখন কি করবি এত মানুষকে বুদ্ধি দিস, এখন নিজে কি নির্বুদ্ধিতার কাজ করলি?
আমি খুব ধীরস্থির ভাবে বললাম, যদিও তা আমার নীতিবিরুদ্ধ, দেখ, আমার যা হবার হয়ে গেছে, তোমার মত তুমি চলে যাও।
মাসুম ভাই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থাকল। ভাবল, হয়তো আমি রাগে দুঃখে কথাটা বলেছি, বন্ধু হয়ে বন্ধুকে ফেলে চলে যাবে বলেছি। সে কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে থেকে গম গম করতে করতে গাড়িতে গিয়ে বসে, ইঞ্জিন স্টার্ট করে, আমার জন্য অপেক্ষা করতে থাকে। আমি আবার বললাম, তুমি চলে যাও।
তখন সে বলল, নে হইছে আয়, তুইও মরবি আমরাও একসঙ্গে মরব কি আর করা।
আমি আবারও বললাম তুমি চলে যাও।
⸺ নে রে ব্যাটা হইছে আয়, ঘরে গিয়া সাবধান মত গোসল করে নিমুনি, তারপর আল্লাহ ভরসা।
আমি তখন বললাম, দেখ, একজন বিদ্যুতায়িতজনকে বাঁচাতে গিয়ে অসাবধানতাবশত সরাসরি হাত লাগিয়ে নিজে বিদ্যুতায়িত হয়ে, ঐ হাতে আর দশজনের সর্বনাশ ডেকে আনার মত বোকামির কোন মানেই হয় না। বলেই আমি দরজাটা লাগিয়ে দিই।

এবার খাবারের ব্যাগ হাতে হলির সামনে গিয়ে দাঁড়াই। ও এবার থিতু হয়ে বসে বেশ অবাক হয়ে বলে, তুমি যাওনি?
⸺ হুম, যাব। তুমি সুস্থ্ হয়ে নাও।
⸺ আর ইউ ক্রেজি? তুমি কি আমার জন্য মরতে চাও?
⸺ না, ডোন্ট ওরি। কিচ্ছু হবে না।
⸺ ব্লাডি ষ্টুপিড থিংকিং, কিচ্ছু হবে না, হাউ ডু ইউ নো?
⸺ আমি কিছুই জানি না, তবে এটুকু জানি, যা হবার তা হয়ে গেছে, আর কিছু করার নেই। তোমাকে হসপিটালাইজ করার পর আমার যা হবার তা হবে।

হঠাৎ তাকিয়ে দেখি ওর দুচোখ দিয়ে পানি ঝরছে। আমি ওর চোখের রেখাটা মুছে দিতেই, আমাকে জড়িয়ে ধরে আরো জোরে কাঁদতে কাঁদতে বলে, তোমার মরণের এতটুকু ভয়ও নেই? ইউ আর সো গ্রেট।
বুঝলাম, মৃত্যুভয়ে কাতর একজন মুখে যেতে বললেও এই মুহূর্তে তার একজন সঙ্গীর বড় প্রয়োজন।

দুজনেই কিছুক্ষণ মৌন থাকার পর আমি বললাম, কিচেনটা কোনদিকে একটু দেখিয়ে দাও, আমি খাবারটা প্লেটে দিই।
হাত ইশারায় দেখালো, ঐতো ঐদিকে।
বললাম, লাঞ্চ করেছ কখন?
⸺ দুটোর দিকে।
⸺ এখন বাজে অল মোস্ট নয়টা। এর মাঝে কিছু খেয়েছ?
⸺ না, খেতে ইচ্ছে করে না।
খুব শিগ্রি তোমার কিছু খাওয়া উচিত বলেই কিচেনে গেলাম। হাতটা ভালমত সাবানে ধুয়ে, প্লেট-কাটলারি ধুয়ে এক গ্লাশ কুসুম গরমজলসহ টেবিলে খাবার লাগালাম। খাবারগুলো এ্যালুমিনিয়াম ফয়েল কন্টেইনার থেকে ঢালতেই দেখলাম, বেশ গরম আর ধোঁয়া বের হচ্ছে।
আমি ডাইনিংরুম থেকে চিৎকার করলাম, হলি, প্লিজ চলে এস, খাবার টেবিলে লাগানো। ও কোন উত্তর করল না, আবার কাশতে শুরু করল।
আমি দৌড়ে ওর কাছে এসে ধরে বললাম, রিলাক্স, রিলাক্স, ডোন্ট ওরি কিচ্ছু হবে না তোমার। দেখলাম গা বেশ গরম। আমি ওকে গা গরমের বিষয়ে কিছু বললাম না।
ও একটু থিতু হলে বললাম, চল খাবে।
ও একটু চড়া সুরে বলল, আঃ খাব না কাশব।
⸺ তোমাকে খেতে হবে, কারণ শরীরে পুষ্টির দরকার, আর পুষ্টিই একমাত্র এর ঔষধ। চল খাবার ঠাণ্ডা হয়ে যাবে।
ও দুলতে দুলতে খাবারের চেয়ারে এসে বসল, বুঝলাম শরীরটা বেশ দুর্বল। খাবার দেখে ও বেশ অবাক হল, মাই গড, এত কিছু এনেছ? –
⸺ কেন, বলেছিলে না এর আগে, লাম কারির সাথে গার্লিক নান আর পিলাও রাইস তোমার পছন্দ।
ও মুচকি হেসে বলল, সেই কবে কখন তোমায় বলেছি আমার তো মনেই নেই।
আমিও মুচকি হাসিতে বললাম, কিছুজনের কিছু কথা মনে রাখার চেষ্টা করতে হয় না স্বয়ংক্রিয়ভাবেই মনে থাকে।

আমি জানি মিক্স কাবাব, মিক্স গ্রিলটা ওরা স্টারটার হিসেবে খুব পছন্দ করে। তাই একটা মিক্স গ্রিল মেইন নিয়ে এসেছি।  প্রথমেই মিক্স গ্রিলটা ওর সামনে দিতে দিতে বললাম, আমি নিজে সাথে থেকে বলে কয়ে তোমার জন্য কিংপ্রন ছাড়া ওনিয়ন পেপার দিয়ে তৈরি করে এনেছি।
এবার ও মুচকি হাসিতে চোখ ঘুরিয়ে এমন ভঙ্গিতে বলল, উপস, আমি তো কিংপ্রন পছন্দ করি। আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছি ওর মুখের দিকে। ওর বলার ভঙ্গিটা আমার এতটাই ভাল লাগল যে, তাতে মনে মনে বলতেই হল, আসলেই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ তুমি।
হয়তো মৃত্যুর আগে মানুষ বেশি সুন্দর হয়, মনে অমর হয়ে থাকার জন্য। ভাবতেই বুকটা আমার কেঁপে ঊঠল, হঠাৎ একি! আবোল তাবোল ভাবছি আমি! মনের অগোচরে নিজের এই ভ্রান্ত ভাবনার জন্য নিজেকে বড় অপরাধী মনে হতেই, নিজেকেই নিজে শাস্তি দেবার জন্য জিহ্বায় জোড়ে কামড় দিলাম।
ও বলল, কি ভাবছ? কথা বলছ না যে?
আমি বললাম, জানি, কিন্তু এমুহূর্তে কিংপ্রনটা তোমার খাওয়া উচিত হবে কিনা, তাই আনিনি।
ও আবারও মুচকি হাসল। মুরগির মত এখান ওখান থেকে ফোর্ক দিয়ে ঠুকরিয়ে খেয়ে বলল আর খাব না।
আমি নানের প্যাকেট খুলে কিছুটা ছিঁড়ে মিট কারি থেকে একটুকরো মিট নানের ছেঁড়া অংশের সাথে জড়িয়ে ওর মুখের সামনে ধরলাম। ও আপত্তি করল না, নিঃশব্দে মুখে পুরে নিল।
আমিও আর জবরদস্তি না করে, ওর খাবারের প্লেটটা সামনে থেকে নিয়ে বেসিনে গেলাম।

জানি, যে কয় আইটেম খাবার এনেছি তা যদি এক দুই পিস বা দু এক চামচ করেও খায় তাতেই ওর পেট ভরে যাবে।

আমি প্লেট ধুচ্ছি হঠাৎ পেছন দিক থেকে কোমল হাতের স্পর্শ। আমি কিছুটা অবাক হতেই ও আমাকে আরো বড় রকমের অবাক করে পেছন দিক থেকে জড়িয়ে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল, সরি টীম আই আম রিয়ালি সরি। আমি তোমাকে চিনতে পারিনি, তোমাদের এশিয়ানদের প্রতি খুব খারাপ ধারণা ছিল। তাই তোমার সাথে ঐদিন ওরকম প্লে করেছিলাম, আমি সরি টীম আমি সরি।
আমি পেছনদিকে মাথা ঘুরিয়ে আমার গালের সাথে ওর কপালের স্পর্শ নিয়ে বললাম, ইটস ওকে, আমি কিছু মনে করিনি।

সেদিন ছিল ১৪ই ফেব্রুয়ারি। সন্ধ্যার প্রাককালে আমার কাস্টমার টয়লেটটা বন্ধ থাকার কারণে আমি হলির রেস্টুরেন্টে যাই। ও তখন কাজ শেষে বারের ফ্রন্টের টেবিলে বসে আছে একটা ভালেন্টাইন্স গিফট বক্স নিয়ে। আমি পাশ দিয়ে যেতেই বলল, হাই টীম, ইটস ভ্যালেন্টাইন্স ডে, তুমি আজ কাজ করছ মানে?
বললাম, মানে আমার তেমন কেউ নেই।
⸺ ওহ! ভেরি স্যাড।
আমি আমার অঙ্গভঙ্গি করে বোঝালাম, নিরুপায়, আমি কি করব বল?
⸺ অহ! ডিয়ার ডোন্ট বি আপসেট, আমিই তোমার গার্লফ্রেন্ড।
আমি হেসে বললাম, সিরিয়াসলি?
⸺ হান্ড্রেট পার্সেন্ট। বিশ্বাস হয় না? বলেই টেবিলের উপরের ফুলের তোড়াটা আমার হাতে ধরিয়ে দিল।
আমি হাতে নিয়ে ফিরিয়ে দিয়ে বললাম, এটা যার জন্য এনেছ তাকে দাও। এইমুহূর্তে শুধু তোমার নম্বরটা দিলেই চলবে।
এবার হাসতে হাসতে সামনের চেয়ারে দুবছরের একটা বাচ্চাকে দেখিয়ে বলল, ঐ দেখ আমার ছেলে।
⸺ নো প্রবলেম।
তখন ও বিনিতভাবে বলল, সরি ডিয়ার আমার তো কোন নম্বর নেই।
আমি তখন মুচকি হাসিতে ইটস ওকে বলে টয়লেটের দিকে পা বাড়ালাম। টয়লেট থেকে ফিরতে ওর সামনে দিয়ে যেতেই আবার ডাকল, বলল, আমার নম্বর নিয়ে যাও। আমিও নাছোড়বান্দা, ওকে ঠিক আছে দাও। ওর কলিগ, একটা ছেলে বলল, আবার আমার নম্বর দিও না। ওরা সবাই তখন মুখ টিপে হাসছে।
আমি ব্যাপারটা বুঝতে পেরে বললাম, ডোন্ট প্লে উইথ মি।
ও হাসি থামিয়ে বলল, ওহ, নো টীম, এটা আমার নম্বর। তোমার ফোন দাও আমি সেভ করে দিচ্চি।
⸺ ওহ! সরি আমার ফোন তো আমার স্টলে রেখে এসেছি।
তোমার হাতটা দাও বলেই, আমার হাত টেনে ওর নামসহ নম্বরটা লিখে দিয়ে বলল, এবার আমার গিফট কই?
আমি বললাম, জাস্ট ওয়েট ফর এ মোমেণ্ট বলেই আমার স্টলে এসে ওকে কল দিয়ে শিওর হলাম যে, এটা ওরই নম্বর।  তারপর কার্ড ফ্যাক্টরি থেকে একটা কার্ড ও গিফট কিনে ১৫ মিনিটের মধ্যে আমি ওর সামনে হাজির। ও খুশিতে জড়িয়ে ধরে, চুমু খেয়ে বলল, আই’ম সো ইম্প্রেসড। তারপর টেক্সট চলতে থাকল। হঠাৎ মাঝ রাতে আমাকে কল করে বলল, এটা হলির নম্বর না, আমি হলির ফ্রেন্ড। আরেকটা নম্বর যে দিয়েছে সেটাও ওর না। এই আলাপচারিতার মাঝে পাশেই একটা পুরুষ কণ্ঠও শোনা যাচ্ছিল। তাতে বুঝতে আর বাকি থাকল না যে, এটা ওর নম্বর হলেও ও অন্তত সিঙ্গল না। আমার ভাষা হারিয়ে গেল। ফোনটা পাশে ফেলে ভগ্ন হৃদয়ে শুয়ে পড়লাম। নিজেকে খুব অপমানিত বোধ করায়, এরপর আর ওর সাথে চোখাচোখি হলে, শুকনো হাসি বিনিময় ছাড়া আর কোন কথা হয়নি।

আগে মাঝে মাঝে আমার কাছে আসত, কথা বলত। আমরা কি ধরনের খাবার পছন্দ করি বা ওরা কি ধরনের খাবার পছন্দ করে এসব নিয়ে আলাপ চলত। যখন প্রথমবার ওর সাথে আমার দেখা হয়, আমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি ওর দিকে। ও আমাকে বলেছিল, কি হল অমন করে তাকিয়ে আছ কেন? আমি উত্তরে বললাম, তুমি আসলেই খুব সুন্দর। ও মুচকি হাসিতে বলল, আমাকে ওরকম সবাই বলে। আমিও হেসে বললাম, সবারই যে চোখের সাথে মেধাও আছে সুন্দর অসুন্দর পরিমাপের।
⸺ তাই? বা! সুন্দর বলেছ তো?

এভাবে প্রায়ই ওর সাথে কথা হয়। হয়তো খাবারের জন্য আসে, নতুবা মোবাইল চার্জের জন্য। একদিন ও আমাকে জিজ্ঞেস করে, হেলো কর্ন ম্যান তোমার নাম কি?
বললাম, রক্তিম।
ও অবাক হয়ে বলল, কী, টীম?
আমিও আর কথা না বাড়িয়ে বললাম, হুম টীম।
এরপর থেকে ও আমাকে টীম বলে ডাকে। আর আমিও খুশি হই নিজের নামের সাথে ইংলিশ একটা ফ্লেভার পেয়ে। আমাদের বাঙালিদের অনেককেই পেয়েছি, কালাম কে ক্যাম, সামাদ কে স্যাম, জাকির জ্যাক নাম পড়তে। এটা যে স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতি আনুগত্যের হীনমন্যতা আমি তা মনে করি না, এটা অনেকটা ওদের উচ্চারণের অপারগতার সাথে তাল মিলিয়ে চলার অভিনয় মাত্র।

ও আমাকে ছেড়ে বলল, আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না বলেই টলতে টলতে ডাইনিংয়ের একটা চেয়ারে গিয়ে বসল। আমি তাড়াতাড়ি ওর পাশে এসে বললাম, চল, শোবে,  তুমি এতটা দুর্বল হয়ে পড়েছ?
ওকে ধরে বিছানায় নিয়ে বসালাম। ভারি পা দুটো বিছানার উপর তোলার শক্তিও যেন হারিয়ে ফেলেছে। আমি ওর নাঙ্গা পা দুটো ধরে বিছানার উপর তুলে দিতেই নজর পড়ল পায়ের উপর, কারো পা এত সুন্দর হতে পারে? শুভ্র পায়ে লাল রঙের নেইলপলিশে যেন মনে হচ্ছে স্বচ্ছ সরোবরে ফোটা লাল এক পদ্ম। বড় লোভ লাগে একটু চুমু খেতে কিন্তু এই পরিস্থিতিতে এ খুবই অশোভনীয় ভেবে কম্বল দিয়ে পা দুটো ঢেকে দেওয়ার ছলে আলতো করে ঠোটের স্পর্শ নিয়ে ভয়ার্ত চোখে ওর দিকে তাকাই। বুঝতে পেরে ও মুচকি হাসল। আমিও বেশ লজ্জা পেলাম, মনে চাপা ভয়, ও কি ভাবল, আমি সুযোগ নিচ্ছি?
এরমধ্যে আমার ফোনটা বেজে ঊঠল। রিসিভ করতেই ও পাশ থেকে মাসুম ভাই বলল, কিরে তুই কি ওখানেই থাকবি না বাসায় আসবি?
⸺ না, আমি আর আসছি না।
⸺ তো খাবার দাবার?
⸺ খাবার যা আছে তা দিয়ে আমার চলে যাবে। কিন্তু—
⸺ কিন্তু কি বল?
⸺ আরে বল না, সাদাদের কিচেনে লেমন জিঞ্জার কিছু থাকে না। এই সময় এসব দিয়ে চা খাওয়াটা খুব জরুরি। কি করি বল তো।
⸺ আচ্ছা অসুবিধা নেই, আমি নিয়ে আসছি।
⸺ আনবা? আরে না থাক।
⸺ আমি নিয়ে আসছি। আর কি লাগবে বল। বার বার তো যাওয়া সম্ভব না।
⸺ যদি পার গাভিস্কন নিয়ে এস।
⸺ প্যারাসিটামোল লাগবে?
⸺ না, আছে হলির কাছে।
⸺ ও, তোর হলির কি খবর? এখন কি অবস্থা?
⸺ ভাল। বলেই ফোন রেখে দিলাম।

মনে ভাবি আমার হলি! কি যে ভাব তোমরা? যাকে আজকের টেক্সটটা দিতেই সাতবার ভেবেছি।
হলির কাছে যেতেই বলল, টেম্পারেচার মনে হয় খুব গ্রো করেছে। আমি কপালে হাত দিয়ে দেখলাম আসলেই বেশ বেড়েছে। জিজ্ঞেস করলাম থার্মোমিটার কোথায়?
হাত ইশারায় দেখিয়ে বলল, ঐ তো ওই ডেস্কের উপর ঝুরির মধ্যে।
ঝুরির মধ্যে থার্মোমিটার নিতে গিয়ে দেখলাম কয়েক বক্স প্যারাসিটামলও আছে। জ্বর মেপে দেখলাম, ১০৩। কোন কথা না বলে এক গ্লাশ জল এনে দুটো প্যারাসিটামল খেতে বললাম। ও বাধ্যের ন্যায় খেয়ে নিল। আমি ছোট একটা তোয়ালে ভিজিয়ে ভাল করে চিপে ওড় মুখটা মুছে দিলাম। এরপর ঘাড়, গলা, দুই হাত-পা, এমনকি বুকের খোলা অংশটুকুও মুছে দিলাম। ও যেন আরামে চোখ বুজে পড়ে আছে।
বললাম, বেবিটাকে দেখছি না ও কোথায়? ও খাবে না।
ও একটু ব্যস্ত হয়ে বলল, সাবধান ওর কাছে যাওয়ার দরকার নেই, ওর খাওয়া শেষ, ওকে পাশের রুমেই বেডে দিয়েছি, ঘুমিয়ে পড়েছে।

এরমধ্যেই দরজায় কে যেন নক করল। দরজা খুলে মাথাটা বের করে দেখলাম, দরজার একদম কাছেই সে চলে এসেছে।
আমি ব্যস্ত হয়ে বললাম, আহা হা কি করছ, মাসুম ভাই? দূরে যাও। সে দরজার সামনে ব্যাগটা রেখে কিছু দূরে গিয়ে বলল, তোর ওষুধ, জিঞ্জার লেমন, লবঙ্গ সবই আনছি, সাথে তোর খাবারো আনছি।
⸺ ধন্যবাদ ভাই।
⸺ তাইলে কি তুই এখানেই থাকবি?
⸺ হুম, কিছুই আর করার নেই। ১৪ দিন পরে যদি অসুস্থ না হয়ে ফিরতে পারি তবেই বাসায় ঢুকব নইলে যা হবার হবে।
সে খুব মর্মাহত হল, ছল ছল চোখে বলল, ভাবিস না কিচ্ছু হবে না আল্লাহ ভরসা বলে যেতে নিয়েই পেছন ফিরে আবার বলল, তাইলে তুই যাবিই না? সেই আবার একই কথা, অন্যকে জ্ঞান দিয়ে বেড়াস, নিজে কি করলি এটা। শালার গরু, মর এখানে। বলেই চোখ মুছতে মুছতে চলে গেল।
তার এই আবেগঘনতায় যেন আমারও চোখ দিয়ে জল পড়তে লাগল। যে লোকটাকে মাত্র সপ্তাহ খানেক আগে আমি আমাদের ঘর থেকে একপ্রকার ঘাড় ধরেই বের করে দিয়েছি।
সেদিন মাসুম ভাই রাতে এসেছে, আমি বললাম, তুমি এসেছ কেন? এখন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবে। কাজ বাদ দিয়ে ঘরে পড়ে আছি, লাভটা কি হল? তুমি নানান জায়গায় যাও, তোমার দ্বারা আমি আক্রান্ত হতে পারি, আমার দ্বারা তুমি আক্রান্ত হতে পার। সে তখন বলেছিল, ঠিক আছে যা কাল থেকে আর আসব না। হায় পরিণতি! যাকে আমার বাসায়, ঢুকতে নিষেধ করলাম, সে নিজে সাথে বউ সন্তানসহ আক্রান্ত হওয়ার সমুহসম্ভবনা থাকা সত্ত্বেও সেইই কিনা, এই আক্রান্ত আমাকে তার গাড়িতে করে নিয়ে  যেতে এতটূকূ কার্পণ্যবোধ করল না! আর এটা যে তার কেবল কথার কথা নয়, এটা অন্তত আমি জানি আর পাঠকরাও জানবেন তার চোখের জল মোছা দেখে।

জানি আমি, সেদিনের সেই কথাগুলো সে সহজভাবে নেয়নি, কেঊ নিতে পারেও না। এটাও জানি এত সহজভাবে এই গুরুবাক্য বলাও যার তার পক্ষে সম্ভব না। তবে বাস্তবতা হল এই, এই কথাগুলো যতটা না রুড তার চেয়েও ঢের বেশি প্র্যাক্টিকাল ও সময়োপযোগী।

রুমে ঢুকতেই, হলি জিজ্ঞেস করল, কে এসেছিল।
⸺ আমার ফ্রেন্ড, আমার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে।
⸺ ওহো তো তুমি খেয়ে নাও।
⸺ হুম, খাব এখনি।
⸺ আমাকে ছেড়ে গেলে না?
⸺ দেখ, আমি এখন গেলে তো আমার বাসার সবাই আক্রান্ত হবে, ওর চাইতে তোমাকে ডক্টরের কাছে রেখে পরে আমিও ডক্টরের নির্দেশ মত চলতে পারব।
⸺ এটাই আসল কারণ নাকি আমাকে তুমি একা ছাড়তে চাও না?
এর কোন উত্তর না দিয়ে, বললাম, জিঞ্জার লেমন দিয়ে তোমার জন্য চা নিয়ে আসি।
একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, লেমন জিঞ্জার কোথায় পেলে?
⸺ আমার ফ্রেন্ডকে আনতে বলেছিলাম।

চা নিয়ে আসলে, ও অনেকটা অনুযোগ করে বলল, তুমি আমার পাশে একটু বসতে পার না? শুধু বিজি থাক। শুনে আমার কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। তার মানে ও আমার সান্নিধ্য চায়? আমি অবাক হয়ে তাকিয়ে আছি, ও মুচকি হাসল।

আমি চায়ের কাপটা পাশে্র ডেস্কের উপর রেখে  ওকে উঠিয়ে মাথার নিচ থেকে বালিশটা তুলে খাড়া করে খাটের সাথে হেলান দিয়ে বসানোর ব্যবস্থা করে চায়ের কাপটা হাতে ধরিয়ে দিলাম। চুমুক দিয়েই বলল, সো ডিলিসিয়াস। আমি ওর পাশে বসে ওর মাথা ম্যাসাজ করে দিচ্ছি।
হঠাৎ রেগে গেল কি করছ তুমি? আমি একটু থতমত খেয়ে নড়েচড়ে বসলাম। কিছু বুঝে উঠতে না পেরে ওর দিকে তাকিয়ে থাকলাম। বলল, তুমি খাবে না?
আমি ভাবলাম ভুল করে কি জানি কি স্পর্শ করেছি। একটু আশ্বস্ত হয়ে বললাম, হুম, খাব এইত এক্ষণি। তুমিই তো বললে তোমার পাশে বসতে।
বাচ্চা মেয়ের মত স্যরি বলে, এমন করে তাকাল যেন, সেই চোখের মধ্যে কি যে আকুতি আর কত যে মায়া ঢেলে রেখেছে, তা বুঝতে রসিকজন হতে হয় না বড়।

চা খাওয়া শেষে, চায়ের কাপ ওর হাত থেকে নিতেই দেখি ওর গা ঘামছে, কাপটা বেসিনে রেখে সেই ভেজা তোয়ালে দিয়ে গাটা আবার মুছে যেই না খেতে বসেছি, ওমনি দেখি, আবার কাশি উঠেছে। দৌড়ে আসলাম ওর পাশে। ও আমাকে দেখে কাশতে কাশতেই হাত ইশারায় যেতে বলল যাতে আমি খাওয়াটা শেষ করে আসি। তারপরও দাঁড়িয়ে থাকি, কাশি কিছুটা কমলে আমি আবার খাবার উদ্দেশ্যে পা বাড়াই। দরজা গলিয়ে বের হতে না হতেই, দেখি আবার কাশি শুরু হয়েছে। বুঝলাম আমাকে তাড়ানোর জন্যই অনেক কষ্টে কাশি কিছুটা সময় দমিয়ে রেখেছিল।

খাওয়া আর হল না। আমি হাতটা ধুয়েই গরম জলে কিছু লবণ মিশিয়ে একটা প্লাস্টিক বাউল ওর মুখের সামনে ধরে গারগিল করতে বললাম। ও মুখে নিয়ে যেই না গারগিল করতে যাবে, অমনি কাশি উঠে নাক মুখ দিয়ে ছড়িয়ে ফেলল। আমার সারা শরীর ভরিয়ে দিল। ওর দিকে তাকাতেই আমার ভেতরটা যেন দুমড়েমুচড়ে ভেঙে গেল। চোখ ফেটে জল পড়তে লাগল। ওর রক্তবর্ণ চোখ দিয়ে যেন রক্ত আর জল এক সঙ্গে গলে পড়ছে, নাক দিয়ে জল ঝরছে, মুখ দিয়ে জল ঝরছে, কি যে করুণ আর কি যে অসহ্য যন্ত্রণা সইছে। লবণ জলের গ্লাস আর বাউল মেঝেতে রেখে তোয়ালে দিয়ে ওর চোখ মুখ মুছে দিই। ও আমাকে জড়িয়ে যেন বাঁচার আকুতি জানায়। আমি আর পারি না ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠি। অস্ফুট স্বরে বলি, হাই ঈশ্বর আমার ফুসফুসটা যদি ওকে দিতে পার তো দিয়ে দাও।

একটু থিতু হলে লবণ জলের গ্লাসটা ওর মুখের কাছে আবার এগিয়ে ধরি। এবার ও ঠিকমতই গারগিল করে। এভাবে বার কয়েক নেওয়ার পর, একটু দম নিয়ে বসে।
এর মধ্যে আমি ওকে না জানিয়েই ৯৯৯ ফোন দিলাম। সমস্ত পরিস্থিতি বর্ণনা করার পর, ওরা বলল, যত তাড়াতাড়ি পারে ওরা আসছে, তারপরো ঘণ্টা খানেকের মত লাগবে। দেয়াল ঘড়ির কা্টায় তখন বারটা ছুই ছুই।
আমি দুকাপ চা করে একটা ওকে দিলাম একটাতে আমি চুমুক দিলাম। ও ডান হাতে চা নিয়ে বাম হাতে আমার বাম হাতটি ধরে ওর বুকের উপর রাখল। এতটাই নিবিড়ভাবে ও আমার কাছ ঘেঁষে বসতে চাইছে যেন এই পৃথিবীর আমিই যেন তার একমাত্র আপনজন। আসলেও তাই, পৃথিবীর সেইজনই একান্ত আপন যে ‘এইমুহূর্তে’ একান্ত কাছে থাকে। সে করবে কি করবে না কিন্তু তার কাছেই যা কিছু ভরসা।

ডাইনিং টেবিলের উপর রাখা ফলের ঝুরি থেকে একটা কমলা এনে ছুলে ওর পাশে ওর মতই খাটের বাতায় হেলান দিয়ে বসে ওর মুখের সামনে ধরে বলি, হলি খাও। ও গুটিশুটি মেরে আমার কাঁধের উপর মাথা রেখে হা করে, আর আমি যেন কমলার কোয়ার মতই দুই ঠোঁটের ফাঁকে আরেকটা কমলার কোয়া তুলে দিই।
কমলা খাওয়া শেষে বললাম, একটু ঘুমানোর চেষ্টা কর। আমি উঠতে যাচ্ছি, আমার হাত ধরে টান মেরে বলল, কোথায় যাচ্ছ তুমি? যেও না আমার কাছে বস।
বললাম, আমি যাচ্ছি না, জাস্ট টয়লেট থেকে আসছি।

টয়লেট থেকে এসে দেখি কেমন নিস্তব্ধ। একদম কাছে গেলাম, মনের মধ্যে ভয় আবার আরো খারাপ কিছু নয় তো। ভাবলাম হয়তো ঘুমিয়ে পরেছে। আমি একটু স্বস্তির শ্বাস ফেলে কেবল একটু সোফায় গিয়ে পা ছড়িয়ে বসেছি। ভাবছি চারদিকে কেমন শুনশান নীরবতা। আর কিছুক্ষণ পর পর নিল আলোর ঝলকানি যেন থেমে থেমে এম্বুলেন্স যাচ্ছে আর আসছে। মুহূর্তে বুকের মধ্যে কেমন ধক ধক করে ওঠে। সারা বিশ্বজুড়ে যেন অসংখ্য যমের তাণ্ডব নৃত্য খেলা। মুহূর্তে আমার কেমন যেন, বুক ভারি হতে লাগল, মাথা ধরেছে মনে হল, গলায় ব্যথা করতে আরম্ভ করল। ভয়ে যেন কুঁকড়ে যেতে লাগলাম। মনে ভাবি কোন দুঃসাহসে এভাবে নিজ হাতে মৃত্যুকে বরণ করে নিলাম। বাইরে যেন অসংখ্য নব্যমৃতের প্রেতাত্মাগুলো দৌড়াদৌড়ি করছে। আর ঘরের ভিতরে যেন যমদূত আমার আর হলির সামনে, আশপাশে ছায়ার মত ঘোরাফেরা করছে। মৃত্যু ভয় যেন আমার ভিতরেও তাড়া করল। ভয়ে দম বন্ধ হয়ে আসতে লাগল। আমি চোখ বন্ধ করে পড়ে আছি। কি মৃত্যু বিভীষিকা! ঘরে একজন মৃত্যুপথযাত্রী আর বাইরে অসংখ্য মৃতের ছড়াছড়ি।

এই তদ্রাচ্ছন্নের মধ্যেই আবার কাশির শব্দ। আমি দৌড়ে গিয়ে দেখি, কাশির মাত্রা যেন, আগের তুলনায় এখন অনেক বেশি। কাশতে কাশতে যেন ভেতর থেকে সব বেরিয়ে আসছে। উপুড় হয়ে বিছানা খামচে ধরেছে যেন সর্বস্ব দিয়ে চেষ্টা করছে নিজের জানটা কোনরকমে জিইয়ে রাখার।
হলি, হলি প্লিজ হলি রিলাক্স হলি বলে ওর মাথাটা তূলেই দেখি, কি ভয়ংকর যন্ত্রণায় বিকট বিকৃত মুখ। আমিও মুহূর্তে সমপরিমান কাতর হয়ে পড়লাম। ওকে চিৎ করে শুইয়ে দিতেই দেখি বার বার মুখ হা করে প্রাণপণে চেষ্টা করছে শ্বাস নিতে।  কিন্তু কিছুতেই যেন শ্বাস নিতে পারছে না। যেন এই বুঝি মরে যায়! যেন এখুনি সব শেষ হয়ে যায়। আমি এতটাই অসহায়! কোন একজনই শুধু নয় আমার সবচেয়ে প্রিয়জন আমারই সামনে এক শ্বাস অক্সিজেন নেবার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে অথচ আমি কিছুই করতে পারছি না। চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলাম। কি করতে হবে কি করব কিছুই বুঝে উঠতে পারছি না। কি করি কি করি ভেবে আমি ওর মুখের সাথে মুখ লাগিয়ে বার বার শ্বাস দিতে লাগলাম। কতক্ষণ দিয়েছি জানি না তবে মনে হল কিছুক্ষণের মধ্যেই শ্বাসটান ভাবটা কমে গেল। ও অনেকটাই সহজভাবে এখন শ্বাস নিতে পারছে। আমি ওকে অক্সিজেন দিতে দিতে নিজেই অক্সিজেনের ঘাটতিতে পড়ে গেছি। তাই ওর বুকের উপর উপুড় হয়ে পরে হাঁপাতে থাকি। আমি জানি বেশ করেই জানি করোনা আক্রান্ত রোগীর হাত স্পর্শ করা মানেই নিজে আক্রান্ত হওয়া; সেখানে মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দেওয়া মানে প্রতি শ্বাসে আমি নিজে গ্রহণ করছি মিলিয়ন খানেক জীবাণু। তারপরও সেদিকে আমার কোন হুঁশ নেই।

 ও ওর দুহাত দিয়ে আমার মাথা হাতড়িয়ে আমায় আদর করছিল। একটু থিতু হলে মাথাটা টেনে আমার ঠোঁটে ঠোট লাগিয়ে চুমু দিতে দিতে বলল, তুমি না হলে সত্যিই আজ মরে যেতাম। প্রাণের ভয় নেই অনেকেরই কিন্তু একটা মানুষ এতটা নির্ভয় হয় কি করে! বলেই হাউ মাউ করে কাঁদতে কাঁদতে বলে, আমি মরতে চাই না টীম, আমাকে বাঁচা, আমি বাঁচতে চাই। আমিও কাঁদতে কাঁদতে বলি, তুমি মরতে পার না হলি, আমি তোমাকে মরতে দেব না। বলেই, ওর বুকের উপর থেকে মাথা তুলে আবার ৯৯৯-এ কল দিই, শাউটিং করে খুব রুড হয়ে বলি, তোমরা আর কত দেরি করবে, মারা যাওয়ার পর আসবে?

লবণ গরম জল আনতে কিচেনের দিকে যেতেই হলি, চিৎকার করতে থাকে, তুমি যেও না, তুমি দূরে গেলেই আমি মরে যাব। মনে ভাবি আজ আমি যেন ওর দেবদূত হয়ে ধরা দিয়েছি। আমার ভিতরে আর কোনরূপ কোন ভয় ডর কাজ করছিল না। যেন আমি এক লড়াকু, অপরাজেয়, দিগ্‌বিজয়ী সৈনিক। যেন মহেশমতির বাহুবলী কি ট্রয় নগরীর হেক্টর অ্যাকিলিসও কোন ছার।

ওকে লবণ জলে আবার গারগিল করালাম। কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না, ক্রমেই খারাপের দিকে যাচ্ছে। আগের চাইতে আরও অনেক বেশি ঘন ঘন কাশি আর শ্বাসকষ্ট হতে লাগল। এদিকে ঘন্টা গিয়ে আরেক ঘণ্টা পার হয়ে রাত দুইটা গড়াল কিন্তু এ্যাম্বুলেন্সের কোন খবর নেই। আমি বার বার মুখে মুখ লাগিয়ে অক্সিজেন দিয়েই যাচ্ছি। মাঝে মাঝে এমন অবস্থা হল যেন, সংজ্ঞা হারিয়ে ফেলল, কোন সাড়া নেই একদম নিস্তব্ধ। ওর হাতের নাড়ি দেখতে নিয়ে নিছক সময় নষ্ট ভেবে আবার মুখে মুখ লাগিয়ে শ্বাস দিতে থাকি। আবার যেন নিস্তব্ধতা ভেঙে নিজেই শ্বাস নিতে শুরু করে। এরকম চড়াই উৎরাই করতে করতে এরই মধ্যে নীল রঙের লাইট জ্বালিয়ে হুইসেল বাজিয়ে দরজায় এসে এ্যাম্বুলেন্স দাঁড়ায় ততক্ষণে রাত প্রায় তিনটা ।

ওরা এসে চেক করে মুখের মধ্যে ঠোঁটের ভাজ এমন করল, তাতে তার ভাষাটা এমন যে জীবনমরণ সন্ধিক্ষণে। আমার ভেতরটা তখন হু হু করে উঠল। তার মানে আমি কি পরাজিত? এত চেষ্টা করেও শেষ পর্যন্ত আমি ব্যর্থ? আমার ভেতরটা চিৎকার করে হাউ মাউ করে কেঁদে উঠল। সব চিৎকারেই শব্দ হয় না, কিছু আছে ভেতরে বিকট শব্দে গুমরে মরে।

এরপর ওকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে অক্সিজেন মাস্ক লাগিয়ে ওকে হাসপাতালে নিয়ে যায়। আমি নিশ্চুপ, নীরব হয়ে অসহায়ের মত দাঁড়িয়ে থাকি।

যাওয়ার সময় ডক্টর অ্যাডভাইস করে, পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত তুমি এখানেই থাক। আর তোমার যা যা দরকার আমরা তোমাকে সবই দিয়ে যাব।

ওকে নিয়ে যাওয়ার পর দরজা বন্ধ করে দুহাতে চোখ ঢেকে আমি সোফায় বসে পড়ি। আমার গাটাতেও বেশ গরম অনুভূত হচ্ছে, সাথে কাশিও চলে এসেছে। মনে হচ্ছে আমার চতুর্দিকে কেবল এ্যাম্বুলেন্সের হুইসেল বাজছে। নিজেকে বড় একা খুব অসহায় বোধ হচ্ছে। ঠিক এভাবেই কখন যে সোফার উপরেই অচেতন হয়ে পড়ি তার কিছুই বলতে পারি না।