![শতায়ু ভব – সদানন্দ সিংহ শতায়ু ভব – সদানন্দ সিংহ](https://cdn.pixabay.com/photo/2017/07/21/23/22/figure-2527372_960_720.png)
শতায়ু ভব
সদানন্দ সিংহ
আজকাল ভেজাল যে কোথায় নেই তা খুঁজে পাওয়া খুব শক্ত ব্যাপার। বিষাক্ত ফরমালিন মাছকে টাটকা রাখে। মাঝে মাঝে সরকারিভাবে সেম্পল চেকিং-এর ফলে মাছে ফরমালিন রাসায়নিক পাওয়া গেছে বলে একটা হৈচৈ হয়। তখন আমদানি করা মাছ খাওয়া কিছুদিনের জন্যে কমে যায়। কিন্তু ভুলে যাওয়া মানুষের ধর্ম। তাই আস্তে আস্তে ফরমালিনের ক্ষতিকর দিকটির কথা লোকে ভুলে যায়। আবার হু হু করে মাছ বিক্রি হয়। হর্ষবর্ধনদা সবসময় আমাকে পই পই করে বলেন, “যে মাছে মাছিরা ভনভন করে ওড়ে বসছে, সেই মাছটা কিনবেন ভাই। ঐ মাছ ফরমালিন মুক্ত।” মাঝে মাঝে মাছ কিনতে গিয়ে হর্ষবর্ধনদার কথাই ভুলে যাই। টাটকা ভেবে মাছ কিনি। আর তাই হয়তো মাছের তরকারি খাবার দুই-তিনঘন্টা পর কখনো কখনো অনুভব করি শরীরে একরাশ ক্লান্তি। হাঁটতেই ইচ্ছে করে না। আমার গিন্নিরও সেই একই অবস্থা হয়। পুরোপুরি ঠিক হতে একদিন লেগে যায়। তারপর ধরুন কলার কথা। কলা কে না খায়। ঠাকুরঘরের লোকটাই শুধু বলে, আমি কলা খাই না। কলাতে নাকি ইউরিয়া মেখে রাখলে তাড়াতাড়ি পাকে। হর্ষবর্ধনদা তো আরো বলেছিলেন, “নাদুস-নুদুস বেগুন কক্ষনো কিনবেন না। হাড় জিরজিরে বা পোকায় খাওয়া বেগুন সবসময় কিনবেন। বাসায় এনে যে-কোনো শাকসব্জি বালতি বালতি জলে ভালো করে বারবার পরিষ্কার করবেন।”
চাকুরিসূত্রে জীবনের অনেক বছর আমাকে মফস্সল এলাকায় কাটাতে হয়েছে। আমি নিজে দেখেছি, গ্রামের চাষিরা ক্ষেতে কীটনাশক ওষুধ স্প্রে করার পর হয়তো পনেরদিন অপেক্ষা করার কথা, কিন্তু তা না করে কেউ কেউ সেই ক্ষেতের ফসল বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। চারিদিকে শুধু ভেজাল আর ভেজাল। বিলাতি মদ তৈরির দুনম্বরি কারখানা, জীবনদায়ী ওষুধ তৈরির দুনম্বরি কারখানা তো অনেকবারই পুলিশের হাতে ধরা পড়েছে। সাবানে ভেজাল, চিপ্সে ভেজাল। কি ইলেকট্রনিক, কি পোশাক-আশাক, সমস্ত জিনিষের বিভিন্ন নকল ব্র্যাণ্ডে বাজার ছয়লাপ।
ঘিয়ের ভেজাল নিয়ে একটা সত্যি ঘটনা মনে আছ। প্রায় কুড়ি বছর আগের কথা। আমার আপিসে একজন লোক নিজের তৈরি করা ঘি নিয়ে প্রায়সময়েই বিক্রি করতে আসতো। আমাদের আপিসে তখন একজন কলিগ নতুন ট্র্যান্সফার হয়ে এসেছিলেন। সেই কলিগ ঘিওয়ালাকে প্রথম সাক্ষাতেই বললেন, ঘিয়ের এতো দাম কখনো হয়? এর অর্ধেক দামে ঘি পাওয়া যায়। তা শুনে ঘিওয়ালা বলল, হ্যাঁ পাবেন। আপনার যদি লাগে, আগামীকাল এনে দেবো। যথারীতি পরদিন অর্ধেক দামে ঘি এনে দিল এবং দাম নিয়ে চলে গেল। তার পরদিন দেখলাম সেই কলিগ আপিসে এসেই ঘিওয়ালাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। আমি জিজ্ঞেস করলাম, ঘি কেমন হল? কলিগ মহাশয় তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলেন, শালা ঠকবাজ, ও আমাকে ঘি নয়, ডালডা দিয়েছে। এরপর ঘিওয়ালাকে অনেকদিন দেখিনি। বেশ কিছুদিন পর আমি ওকে রাস্তায় দেখে ডালডার ব্যাপারটা জিজ্ঞেস করলাম। ঘিওয়ালা আমাকে পাল্টা জিজ্ঞেস করলো, ওই দামে ডালডা মেশানো ঘি ছাড়া শুদ্ধ ঘি কী করে দেবো? তাও আমি আপনাদের লোক বলে পঞ্চাশ-পঞ্চাশ করেছিলাম।
আমার আরেকজন প্রয়াত পড়ার দাদা দোকানে জিনিস কিনতে গেলেই বলতেন, আমাকে অমুক দুনম্বরি জিনিসটা দিন তো। দোকানদার বলতো, মানে ঠিক বুঝলাম না। সেই দাদা বলতেন, আরে চারনম্বরি থেকে দুনম্বরি অনেক ভাল কিনা, একনম্বরি থাকলে তো কথাই নেই।।
আর এখন তো এমনই যুগ, পত্রিকায় দেখেছিলাম প্লাস্টিক চাল, কৃত্তিম মাংস, কৃত্তিম ডিম সবই নাকি আসলের সাথে মিশিয়ে বিক্রি হচ্ছে। মনে হয়, ভেজাল খেতে খেতে আমাদের শরীরে ভেজাল প্রতিরোধ ক্ষমতাও যেন দিনে দিনে ক্রমেই বেড়েই যাচ্ছে। হতায়ু ভব!