কোয়ারেন্টাইন কিংবা কোয়ান্টাম
সদানন্দ সিংহ
সকালে টুংটাং আওয়াজে কলিং বেলটা বাজল। আমি এই আওয়াজেরই অপেক্ষা করছিলাম। প্রথম লকডাউন। হোম কোয়ারেন্টাইনের আজ পনেরতম দিন। তড়াক করে উঠে নিজের অর্ধাঙ্গিনীকে বলল, মনে হচ্ছে ময়লা নেবার লোকটা এসেছে। দরজা খুলে দেখলাম, যা ভেবেছি তাই। বন্ধ কলাপ্সেবল গেটের ওপারে ময়লা নেবার ড্রামটা নিয়ে লোকটা দাঁড়িয়ে আছে। সেই মুহূর্তে লোকটাকে আমার একজন অবতার বলেই মনে হল।
অবশ্য তার কারণও আছে। আজ প্রায় সাতদিন হল, এই লোকটা ময়লা নিতে আসেনি। এটাও নিশ্চিত যে লোকটা ফ্ল্যাটের অন্যান্যদের কাছ থেকে নিয়মিত ময়লা নিয়ে গেছে আমাকে বাদ দিয়ে। নিয়মিত মানে দু’দিন পরপর। কোরোনার লকডাউন হবার পর থেকেই সে নিজেই এভাবে আসছিল। শুধু তাই নয়, সে আরো বলেছিল যে সে নিচে কলাপ্সেবল গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকবে আর সবাইকে তার ড্রামে নিজে এসে ময়লা ফেলতে হবে। ফ্ল্যাটের সবাই তা মেনেও নিয়েছিল, কারণ আর উপায় ছিলনা। অথচ আশ্চর্য, এই লকডাউনের আগে কোনো কারণে একদিন না এলেই তাকে কৈফিয়তের ওপর কৈফিয়ত দিতে হত। আমার মনে আছে, গত দু’বছর আগে লোকটা তার বেতন দুশো টাকা বাড়িয়ে দেবার জন্য মিনতি করেছিল। আমি তো তাতে সায়ও দিয়েছিলাম। কিন্তু ফ্ল্যাটের অন্যরা বিশেষ করে পল্টুবাবু ভীষণ আপত্তি জানিয়ে বলেছিলেন এক টাকাও বাড়ানো হবে না; দরকারে তাকে ছাঁটাই করে আরেকজনকে নাকি রাখা হবে। পল্টুবাবু যেহেতু এই ফ্ল্যাটের পরিচালন কমিটির সেক্রেটারি তাই ফ্ল্যাটের অন্যরাও পল্টুবাবুর কথা মেনে নিয়েছিল। আজ, এই মুহূর্তে, আমার মনে হল লোকটা যদি এখন পাঁচশো টাকাও বাড়াবার কথা বলে তাহলে পল্টুবাবুর সাধ্য নেই ছাটাই কথাটি বলার। বড়জোর হয়তো টাকার অঙ্কটা পাঁচশোর নিচে নামাবার চেষ্টা করবেন।
আমার ঘরের ময়লাগুলি একটা ব্যাগে ঢোকাবার চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু কিছুতেই পারছিলাম না। গত সাতদিনের ময়লা জমে জমে তিনটে প্লাস্টিকের ঝুড়ি উপচে পড়ছিল। আর যেটার মধ্যে খাবার-দাবারের উচ্ছিষ্ট-এঁটোগুলি ছিল সেগুলি পচে এতো দুর্গন্ধ বেরুচ্ছিল যে ওটার কাছাকাছি যাওয়া যাচ্ছিলনা। অনেক কষ্টে তিনটে ডিসপোজেবল প্লাস্টিকের ব্যাগে ময়লাগুলি ভরে ঘরের বাইরে বেরুতে যেতেই দেখলাম পল্টুবাবু সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠছেন। বোধহয় নিচে এসে ঘরের ময়লা দিয়ে গেছেন। পল্টুবাবুকে দেখে আমি কিন্তু মোটেই খুশি হলাম না। এই পল্টুবাবুর জন্যেই ন’দিন আগে আমার ফ্ল্যাটে কোলকাতা পুলিশের সাত-আটজন পুলিশ কলিংবেল বাজিয়েছিল।
হঠাৎ পুলিশ দেখে আমি তো একটু ঘাবড়েও গিয়েছিলাম। পুলিশদের সঙ্গে ছিল পাড়ার ক্লাবের একজন চেনা লোক।
ক্লাবের চেনালোকটি বলেছিল, দাদা, “গেইটের তালাটা একটু খুলুন। এনারা আপনাকে কিছু জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্যে এসেছেন।” তালাটা খুলতেই পুলিশের একজন সাব-ইন্সপেক্টর এক মিটার দূরত্ব থেকে বললেন, “আপনাদের কিছু অসুবিধে হচ্ছে? বেলেঘাটা আই ডি-তে কোরোনা টেস্টে যেতে চান? ” আমি আশ্চর্য হয়ে বলেছিলাম, “আমাদের তো কিছুই হয়নি। হলে তো যাবো নিশ্চয়ই।” সাব-ইন্সপেক্টর আবার জিজ্ঞেস করেছিলেন, “এই ধরুন একটু কাশি, জ্বর বা গলাব্যথা এইসব। আমি বলেছিলাম, “না না, কিছুই হয়নি, ঘরের কারুর কিছুই হয়নি।” সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, “আপনার নাম নিয়ে একজন কমপ্লেন করেছেন আপনার ঘরে লোক এসেছে অন্য রাজ্য থেকে আর কিছুদিন আগে আপনারা উড়িষ্যা ঘুরে এসেছেন।” ক্লাবের চেনালোকটি বললেন, “আপনাদেরর ফ্ল্যাট থেকেই কমপ্লেন এসেছে।” ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন পল্টুবাবুই কমপ্লেন করেছেন। এসব দেখে আমার বেশ রাগ ধরে গিয়েছিল পল্টুবাবুর ওপর, আরে উনি তো নিজে থেকেই আমাকে ফোন করে জানাতে পারতেন সরকারি নিয়মানুযায়ী চৌদ্দদিন যেন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকি। তাছাড়া সরকারি ঘোষণা জানার সঙ্গে সঙ্গেই আমি ইতিমধ্যেই স্বেচ্ছায় হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে শুরু করেছিলাম। সাব-ইন্সপেক্টর বললেন, “আচ্ছা আপনার যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমি একটু ভিডিও রেকর্ড করতে চাই, সেখানে আপনি শুধু বলবেন আপনাদের কারুর জ্বর-কাশি-গলাব্যথা হয়নি এবং আপনারা বেলেঘাটা আই ডি-তে এখন যেতে চান না।” অগত্যা আমি এসব ঝামেলা থেকে মুক্তি পেতে লুঙ্গি-গেঞ্জি পরা অবস্থায় নিজের ভিডিও রেকর্ড করিয়ে নিলাম। যাবার সময় সাব-ইন্সপেক্টর বলে গেলেন, “চৌদ্দদিন হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকবেন। বাড়ি থেকে দয়া করে বেরুবেন না।”
এতোদিন তাই ঘরের মধ্যেই আবদ্ধ ছিলাম। আজ ঘর থেকে বাইরে বেরুতেই পল্টুবাবু হঠাৎ পেছনে ফিরে জিজ্ঞেস করলেন, ভালো আছেন তো? কিছু হয়নি তো?
এসব কথা শুনে আমার বুঝতে অসুবিধে হল না যে পল্টুবাবু ধরেই নিয়েছেন আমাদের কিছু একটা হবেই। এবার আমিও ট্যারা কথা বলতে শুরু করলাম, আরে আমার কথা বাদ দিন। আপনি ঠিক আছে কিনা বলুন। জ্বর-টর হয়নি তো? কাশি কিংবা গলাব্যথা?
— না না। ঠিক আছি। বলেই পল্টুবাবু তাড়াতাড়ি সিঁড়ি বেয়ে উঠে গেলেন। আর দাঁড়ালেন না।
আমি কলাপ্সেবল গেট পেরিয়ে ড্রামের ভেতর ময়লাগুলি ফেললাম। লোকটা হেসে বলল, আপনার জন্যেই অপেক্ষা করছি। এতোদিন তো আপনারা হোম কোয়ান্টামে ছিলেন, তাই ময়লা নিইনি।
আমি লোকটাকে ভালো করে নিরীক্ষণ করতে লাগলাম। অমলিন হাসি তার, কিন্তু সে হাসির মধ্যেও লুকিয়ে আছে কোথাও যেন একটু ভয় যা অদৃশ্য হয়ে সারা পৃথিবীকে গ্রাস করে চলেছে ক্রমাগত যেখানে জাত-পাত-লিঙ্গ-ধর্মের কোনো সীমারেখা নেই। এইরকম একজন লোক যার কাছে কোয়ারান্টাইন যা কোয়ান্টামও তা। হয়তো সে পেট ভরে ভালো কিছু খেতে পায় না। ভালো পোশাক-আশাক পরতে পারে না। কিন্তু নিজের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন।
আমি দেখলাম, একজন দায়িত্ববান গরীব মানুষ ধীরে ধীরে ড্রামহাতে ফিরে যাচ্ছে এক কোয়ান্টামের ছায়াপথ ধরে। আমি এখন ঠিক জানি লোকটার নাম – মৈনুদ্দীন কিংবা চরণদাস।