বজ্রপাত ও স্মৃতি – সুদীপ ঘোষাল

বজ্রপাত ও স্মৃতি  (অনুগল্প)

সুদীপ ঘোষাল

সংশোধনাগারের ভিতরে কয়েকজন মহিলা কয়েদী স্মৃতিমন্থনে ব্যস্ত। বিজুলি বলে চলেছে, আজও বাহান্ন বসন্তের পরে আমি ভুলতে পারিনি অতৃপ্ত প্রথম রোদবেলার কথা। ষোল বছর বয়সে আমার প্রথম প্রেমিকের কাছে জেনেছি, প্রথম প্রেম পরিণতি পায় না কখনও। মাঝ রাস্তায় থমকে পড়ে, তারপর আজীবন পুড়িয়ে মারে। আমি বুঝতে পেরেছি এখন চালাক প্রেমিকের এটা প্রথম প্রেম ছিল না। তার ছিল বিবেকহীন আঙুলের কারসাজি। পশুর মত কামপ্রবৃত্তি পূরণের ফলে আমার শরীরের ভিতর একদিন পাপ ঢুকিয়ে গা ঢাকা দিল চোরের মত। তারপর আচমকা আপনজন মরার মত, ব্যাথায় কাতর হয়ে জন্ম দিয়েছিলাম বজ্রের। ভেতরে একটা মিশ্র অনুভূতি আমাকে পথ চিনিয়েছিল। আমার বান্ধবী শিউলি দেখত, আমার ল্যাদ খাওয়া, পাগলা হাওয়া আর আপনমনে কথা বলা। আমার মনে মলমের মত প্রলেপ দিত শিউলির গান। আমার বিয়ে হল না।  নালিশ করলাম না। কুমারী মা হওয়ার ফলে একা সন্তানসহ থাকতাম, নিভৃতে, নিরালায়। শিউলিও বিধবা হয়ে আমার পাশের বাড়িতে বেশ মানিয়ে গেছিল। সন্তানকে বুকে নিয়ে বেরিয়ে যেতাম সকালে। সারাদিন ঘুরে ঘুরে পিতৃমাতৃহীন আমি মুখ গুঁজে আশ্রয় খুঁজে নিতাম সন্তানের ঘ্রাণে।
আমার সন্তান বজ্র বড় হল। আমার বাবার একবিঘে জমিতে ফসল ফলায় বজ্র। ঘাম ঝরে। বৃষ্টি হয়। ফসলের আশায় দিন গোনে কৃষক। আমার প্রথম কদমের মৌমাছি, ধর্ষকের বেশে প্রবেশ করে একদিন শিউলির নিকানো, আলপনা দেওয়া উপোসি মাটির বারান্দায়। কয়েকদিন ধরেই সে আলপনার ছবি দেখে আর আশেপাশে ঘুরঘুর করে ভাদুরে কুকুরের  মত। দিনদুপুরে সাদা আলপনা আঁকা পবিত্র বারান্দায় কুকুরটি মাটির বুকে যোনিচিহ্ন আঁকে। ভিজিয়ে দেয় আলপনার নক্সা। নরম মাটি শুষে নেয় রক্ত, বীর্য। বজ্র নিস্পলক দৃষ্টিতে দেখে মায়ের ভেঙে পড়া মন। সে বলে, এবার মরণ ঘনিয়ে আসছে তোর। একটু একটু করে আঁধারে পথ হারাচ্ছে ধর্ষকের  চালাকি। পরের দিন আমি দেখি গলায় দড়ি বেঁধে ঝুলে আছে শিউলির শরীর। পুলিশ আসে। খোঁজে খুনের কারণ। অবশেষে ধর্ষকই, খুনী হয়। কিন্তু ততক্ষণে সে গা ঢাকা দেয় চালাক শিয়ালের চাতুর্যে।
কয়েকদিন পরে অন্ধকারে পশুর মত আমার প্রথম ভুল আবার ধর্ষণে প্রবৃত্ত হয় পশুর মত, আমার উপোসি ঘরে। আচমকা বজ্র, কাটারি হাতে ঢোকে ঘরে। তার মনে পড়ে বোধহয় শিউলির ঝুলন্ত দেহ। আচমকা বজ্রপাতে আমার প্রথম ও শেষ ভুল নিহত হয় নিমেষে।
বজ্রপাতের পরে আমি বিজুলি, খুনের সমস্ত দায়িত্ব নিজের কাঁধে নিয়ে বন্দি হলাম খাঁচায়। আঘাতে আঘাতে আমার মনে বিজুলির চমক স্তব্ধ। বজ্রপাতের পরে আমি এখন শুধু অপেক্ষায় বসে থাকি আর দিন গুনি, আমার সোহাগী বজ্রের সুখের আশায়।

বিজলির জীবনের গল্প শেষ হতেই সকলের রাতের খাবারের জন্য ডাক এল। জেলার হাঁক দিলেন, খাবার খেয়ে নাও সকলে।