লক্ষ্মণ বণিকের বৈশ্যবালক – সদানন্দ সিংহ

লক্ষ্মণ বণিকের বৈশ্যবালক

সদানন্দ সিংহ

পৃথিবীতে প্রথম কোথায় কবিতার জন্ম হয়েছিল, সর্বপ্রথম কবিটি কে ছিলেন এর উত্তর আমাদের জানা নেই। তবে পৃথিবীর সমস্ত ভাষায় কবিতা লেখা হয়েছে – এটা স্বীকৃত। সমস্ত জাতিতেই কবিরা আছেন। কোনখানে সংখ্যায় কম, কোনখানে অজস্র। আর বাংলা ভাষার কবিদের সংখ্যা কত তার কোন হিসেব কেউ দিতে পারবেন না। প্রতিদিন নতুন কবি ও কবিতার জন্ম হচ্ছে। স্বভাব কবি ও স্বঘোষিত কবির জন্মও হচ্ছে প্রতিদিন। হয়তো “সকলেই কবি নয়, কেউ কেউ কবি”। কিন্তু সাহিত্য যেহেতু কারুর বাবার সম্পত্তি নয় বা ব্যক্তিগত সম্পত্তি নয় সেহেতু পৃথিবীতে সবাই নিজের স্ব স্ব অনুভূতি কবিতা কিংবা সাহিত্যের মাধ্যমে ব্যক্ত করতে পারেন তাতে কারুর মাথাব্যথার কারণ আছে বলে মনে হয় না। আর যদি এটা কারুর মাথাব্যথার কারণ হয়ে থাকে তাহলে তাকে আমরা মহাপণ্ডিত বা পণ্ডিতম্মন্য ব্যক্তি বলে ধরে নিতে পারি। এটা তো ঠিক যে অস্ত্র হাতে তুলে উন্মত্ত হয়ে যাওয়া থেকে কলম তুলে কবিতা লেখা বা লেখার চেষ্টা করা মানব জাতির পক্ষে মঙ্গল।

লক্ষণ বণিক মুলত স্বভাব কবি এবং কবিতা লিখছেন বহূদিন ধরে। প্রকাশিত কবিতা বইয়ের সংখ্যাও কম নয়। সত্তর দশক থেকে ওঁর কবিতার সাথে আমি পরিচিত। ‘বৈশ্যবালক’ ওঁর সপ্তম একক কাব্যগ্রন্থ। বৈশ্যবালক বইটির পাতা ওলটিয়ে যেতেই কয়েকটি ব্যাপার আমার নজরে পড়ল। একঃ এটি দীর্ঘ এবং একটিমাত্র কবিতার বই এবং লাইন সংখ্যা ১৭০০-এর ওপর। দুইঃ বইটির নাম বৈশ্যবালক এবং এটি উৎস্বর্গ করেছেন “ব্যবসায়ী বন্ধুদের”। সুতরাং পাঠক পড়ার আগেই বইটির সম্বন্ধে একটা ধারণা করে নেবে।

কবিতার ভাষা সরল এবং এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত। পড়ার পর মনে হয়েছে এটা একরকম বৈশ্য চরিত মানস। তাই এখানে কোন প্রতিবাদী লাইনের আশা করা অন্যায়। প্রতিটি লাইনের বিষয়বস্তু নির্বাচনে একটা অভিনবত্ব আছে যেটা হয়ত লক্ষণ বণিক বলেই সম্ভব হয়েছে। স্বীকার করছি, এইরকম কবিতা লেখার কথা আমি কোনদিন ভাবিনি আর ভাবলেও হয়ত কোনদিনই লিখতে পারতাম না। বৈশ্যবালক আসলে একটি কবিতার নাম। বৈশ্যবালক আসলে একটি অর্থনৈতিক দলিল।

কবিতার আরম্ভ হয়েছে এভাবেঃ-

“অর্থের চোখের পাতা একত্রিত হয় না কখনো
কখনো শ্রম নিয়োজনে ক্লান্তও না; ভুল হয় না
অর্থের ছড়িয়ে পড়ার সমুদয় ইতিবৃত্তান্ত
অর্থ আছেই, ছিল, থাকবেও মধ্যমণিস্বরূপা।”

আধুনিক সমাজে কবির কাছে কখনো মনে হয়েছেঃ-

“বৈশ্যভূমি কেড়ে খায় ব্রাহ্মণ-ক্ষত্রিয়-শূদ্র মিলে
বৈশ্যবালক ক্রমশ নিজভূমে পরবাসী হয়
চতুবর্ণ সমাজ সৃষ্টির মূলে আদিকথা পেশা
কালে কালে কতো কী এসেছে মানুষ সুবিধাভোগী”

আবার কখনো কবির মনে হয়েছেঃ-

“পৃথিবী সাতশো কোটি মানুষের একজনও
ব্যবসাহীন নন। বৃথা ধরে রাখা গড়ে ওঠা
বিশ্বাস ও বোধ, সুস্বাগত হোক নতুন সমাজ
সূচিত-অনুসূচিত উচ্চনীচ কেউ ভাবা ভুল”

সবশেষে কবির মনে হয়ঃ-

“সব পেয়েছির দেশে চাওয়ারা ঘোরে হেসেখেলে
নুন আনতে পান্তা ফুরোনো আমাদের সংসারেও
সঠিক দিকচিহ্ন রয়েছে বলেই পূর্বপশ্চিম
দিগন্ত আলোকমালার সাতরঙে সুবর্ণময়”

আজ লক্ষ্মণ বণিক আমাদের সাথে নেই। ভাবতে পারিনি, হঠাৎ করে গতবছর আমাদের ছেড়ে পৃথিবী থেকেই চলে যাবেন অকালে। তাঁর সাথে আমাদের অনেক কথা ছিল, অনেক আলাপ ছিল। সব বাকি রয়ে গেল। আসলে আমাদের জীবনে পূর্ণতা বলে কিছু হয় না। অনেক কিছুই বাকি থেকে যায়।

(বৈশ্যবালক, প্রকাশকঃ ভাষা প্রকাশন। দাম ১১০.০০। প্রকাশকাল জানুয়ারি ২০১৬)