অ্যাংগার বা রাগ – সদানন্দ সিংহ

অ্যাংগার বা রাগ

সদানন্দ সিংহ

রাগ হচ্ছে আমাদেরই এক ইমোশন বা আবেগ যা ফুটে উঠে অন্যের প্রতি বৈরিতার মনোভাব নিয়ে বা নিজের কৃতকর্মের জন্যে নিজেরই ওপর এক অনাস্থা নিয়ে।

পৃথিবীতে রাগ নেই এমন মানুষের দেখা পাওয়া খুব দুর্লভ। আর দুঃখ-হাসি-কান্না-রাগ সবই তো আমাদের ইমোশন থেকে উৎপত্তি। একমাত্র মৃত মানুষেরই ইমোশন থাকে না। কিন্তু একজন জীবন্ত মানুষের কি রাগের সত্যিই প্রয়োজন আছে? মানুষটা জীবন্ত বলে তাকে কি রাগ দেখাতেই হবে?

সচরাচর আমরা কয়েক ধরনের রাগ দেখি। ক্রনিক রাগ, পরোক্ষ রাগ, নিজের ভুল কাজের জন্যে রাগ, অতৃপ্তির রাগ, তীব্র হঠাৎ রাগ, আদেশজনিত রাগ, মগজধোলাই জনিত রাগ ইত্যাদি। ক্রনিক রাগকে একপ্রকার মানসিক রোগ বললে বোধহয় ভুল বলা হবেনা। এইধরনের লোক সবসময় রেগেই থাকেন। পান থেকে চুন খসলেই এনারা মহা ক্ষেপে উঠেন। আমার দাদুও এমন ছিলেন। এঁদের মানসিক চিকিৎসা দরকার। কিন্তু এঁদেরকে চিকিৎসা করানো এক দুঃসাধ্য ব্যাপার, কারণ এঁরা মনোবিদ বা চিকিৎসকের কাছে সাধারণত যেতে চান না। পরোক্ষ রাগ বিভিন্ন কারণে হয়। কিন্তু সেই রাগের সঠিক কারণ খুঁজে বের করা এক দুঃসাধ্য ব্যাপার। নিজের ভুল কাজের জন্যে রাগের সম্মুখীন অনেকেই হয়েছেন। ভুল সবাই করেন। একমাত্র শয়তানেরই নাকি ভুল হয় না। অতৃপ্তির রাগ তো পৃথিবীর দিকে দিকে। মানুষের চাহিদার অন্ত নেই। কিন্তু চাহিদাপূরণ সবসময় হয়ও না। আদেশজনিত রাগ সাধারণত যাঁরা অফিসিয়াল কাজ করেন তাঁদের ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়। অফিসের বস্‌ হয়তো এমন একটা আদেশ করে গেল যেটা অপমানজনক। বা আপনি অধস্তন কর্মীকে একটা আদেশ করলেন যেটা পাত্তাই দেয়া হলনা। মগজধোলাই জনিত রাগটা একটু অন্য রকমের। এই রাগের প্রতিফলন ঘটে অন্যের ওপর ধ্বংসলীলায়। তীব্র হঠাৎ রাগ যখন তখন হতে পারে। হয়তো আপনি এমন কিছু একটা দেখলেন যে আপনার মূল্যবোধের একেবারে বিপরীত প্রান্তে, এক্ষেত্রে আপনার তীব্র হঠাৎ রাগ হতে পারে। যদিও কেউ কেউ বলেন, রাগের সমাধান যদি সঙ্গে সঙ্গে করা যায় তবে নাকি যে প্রশান্তি মেলে তা স্বাস্থ্যের পক্ষে ভাল। রাগের সমাধান সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে হবে সেটাই লাখ টাকার প্রশ্ন।

আপনারা জানেন যে আমরা সমাজে বাস করি বলে সমাজেরও একটা মন আছে। আর সমাজের মন আছে বলে সমাজের রাগও আছে এবং তা বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। গোষ্ঠীগত, সম্প্রদায়গত, আদর্শগত এবং রাজনৈতিক ইত্যাদি বিভিন্ন কারণে উদ্ভূত সামাজিক রাগের পরিণতি ভয়ংকর। বিভিন্ন ধ্বংসাত্মক আজ এবং হত্যালীলার মাধ্যমে তা দ্রুত একস্থান থেকে অন্যস্থানে ছড়িয়ে পড়ে।     

যেকোনো প্রকার রাগই হোক, লাভের ডালি একপ্রকার শূন্য। কি পারিবারিক, কি সামাজিক — রাগ নিজের পরিবেশকে ক্ষতবিক্ষত করে তোলে। স্ট্রেস বাড়িয়ে দেয়, এমন কি আর্থিক ক্ষতি থেকে শুরু করে নিজেদের অমূল্য সম্পদ এবং সময়গুলি হারিয়ে যেতে পারে যা কিছুতেই আর ফিরে পাওয়া যায় না। রাগের মাথায় নেয়া সিদ্ধান্তগুলি বেশির ভাগই ভুল সিদ্ধান্ত হয়। তা থেকে আবার হতাশায় নেশাগ্রস্ত হওয়া অসম্ভব নয়। সবচেয়ে বড় ভয়, অনেকক্ষেত্রে ব্লাডপ্রেশার ও মাথার যন্ত্রণা বেড়ে সেটা স্ট্রোক বা হার্ট এ্যাটাকে পরিণত হতে পারে।

ব্যক্তিগত ভাবে রাগ থেকে মুক্তির শ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে রাগকে কন্ট্রোল। আপনিই আপনার অধীশ্বর। আপনিই একমাত্র পারেন আপনার রাগকে আটকাতে। রাগ বাড়তে থাকলে যদি সমাধানের উপায় না থাকে তাহলে চুপ করে স্থির হয়ে বসুন। চোখ বন্ধ করে ভাবুন, যে কারণে রাগ হচ্ছে সেটা পৃথিবীর একটা তুচ্ছ ব্যাপার। তাকে ধরে ফেলুন। আরো ভাবুন, এই বিশাল মহাবিশ্বের আপনি একটা ক্ষুদ্রতম পার্টিকাল ছাড়া কিছুই নন। স্বাভাবিক শ্বাসপ্রশ্বাস নিন। শান্ত হোন। যদি সম্ভব হয় পাঁচ-দশ মিনিট ঘুমোবার চেষ্টা করুন। যদি দেখেন যে এমন এক পরিস্থিতির তৈরি হয়েছে আপনি ছটফট, অস্থির এবং রাতেও ঘুমোতে পারছেন না। তাহলে আর রিস্ক নেবেন না, কাছাকাছি চিকিৎসকের কাছে গিয়ে Anti-anger জাতীয় ওষুধ খান। তবে বেশিদিন এরকম ওষুধ খাবেন না যেন। এক্ষেত্রে ডাক্তারই যা বলবার বলে দেবেন।

তবে রাগেরও নাকি একটু পজেটিভ দিক আছে। এটা আপনার নেগেটিভ ফিলিংকে দাবিয়ে বা চাপিয়ে রাখে না। ফলস্বরূপ কোনো সমস্যার সমাধান খুঁজতে আপনাকে অনুপ্রাণিত করতে পারে।

শিউরে ওঠার মতো ব্যাপার হলো যুদ্ধের ঘটনা বাদ দিলে পৃথিবীতে প্রতিবছর যত হত্যাকাণ্ড সংগঠিত হয়, তার মধ্যে খুব কম সংখ্যক Planned Murder-এর ফলে সংগঠিত হয়। বেশির ভাগই হয় অতিরিক্ত রাগের মাথায়। যেহেতু অতিরিক্ত রাগের মাথায় কোনো হিতাহিত জ্ঞান থাকে না, নিজের শরীরের ওপর কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তাই রাগকে কন্ট্রোল করার সর্বশ্রেষ্ঠ উপায় হচ্ছে, রাগ আপনাকে কন্ট্রোল করার আগেই আপনি রাগকে কন্ট্রোল করে ফেলুন তাড়াতাড়ি যেভাবেই হোক।