শোভনানন্দ – সুদীপ ঘোষাল

শোভনানন্দ        (অনুগল্প)

সুদীপ ঘোষাল

শোভনকাকা ফাল্গুনে হোলিকার কুশপুত্তলিকায় আগুন ধরিয়ে কি নাচ নাচতেন। নাচতে নাচতেই আমরাও সমস্বরে বলতাম, ধূ ধূ নেড়া পোড়া, হোলিকার দেহ পোড়া।
শোভনকাকা বলতেন, অশুভ শক্তিকে পুড়িয়ে শুভ শক্তির উন্মেষ। পরের দিনে রং আর আবিরে ভরিয়ে দিতেন আকাশের নরম গা। বাতাসের অদৃশ্য গায়ে আবিরের আনাগোনা। সে এক অনির্বচনীয় আনন্দের প্রকাশে রাধাকৃষ্ণের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশের আকুতি ছিল তাঁর মনে।
আশ্বিনের আকাশে বাতাসে বেলুন গ্রামের শোভনকাকা অর্থাৎ শোভন পাঠকের রঙের খেলা দেখতাম। শিল্পী একমাটি, দু’মাটি করে শেষে চোখ আঁকতেন পর্দার আড়ালে। আগে থেকে চোখ দেখতে নেই। আর আমাদের চোখ দেখার জন্য চাতুর্যের সীমা থাকতো না। পাঠক মশাইয়ের ফাই ফরমাশ খেটে সবার অলক্ষ্যে চোখ দেখে নিতাম।
তিনি বলতেন, এই চোখ আজও আমার মনে এঁকে যায় জলছবি। কি যেন বলেছিলো সেই চোখ। আশ্বিন এলেই আমি প্যান্ডেলে প্রতিমা তৈরি করে বেড়াই মায়ের চোখ দেখার বাসনায়। ছোটোবেলার দেখা চোখ কোথায় কোন গভীর জলে ডুব দিয়েছে কে জানে। দরজা পুকুরের সবুজ সর সরিয়ে পানকৌড়ি ডুব দিয়ে খুঁজে চলে আজও আমার মায়ের চোখ। হাঁসগুলিও আমাকে সান্ত্বনা জুগিয়ে চলে জলে ডুবে ডুবে। হয়তো আমার জন্যই ওরা অভয় নাচ দেখিয়ে চলে মনদেবতার ঈশারায়। আমরা তার কাব্যকথা শুনতাম মন দিয়ে। তিনি মধুর স্বরে বলতেন, কাশের কুঁড়ি রসদ মজুদ করছে ফোটা ফুলের সৌরভ বিতরণের। এরপরেই শুরু আনন্দে মাথা দোলানোর উৎসব। মননদীর গভীরে প্রোথিত তার আগমনী সংগীত। হাত নেড়ে বলছে, আসছে আসছে। দেবী কাশ রঙের সংকেতে তাঁর আগমনী বার্তা পাঠান যুগ যুগ ধরে।
আমাদের শোভনকাকা কাশ ফুল দেখলেই কারণে অকারণে গলা ছেড়ে গান গাইতেন। সেই মধুর সুরেই শোভনকাকা কাশ ফুলের শোভা বাড়িয়ে সকলের মনের সংকীর্ণ বেড়া ভেঙে দিতেন।
আমরা সকলেই প্রিয়জন মরে গেলে দুঃখ পাই। কিন্তু নিজের মরণ বুঝতে পারলেও দুঃখ প্রকাশের সুযোগ পাই কি? সেই শোভনকাকা গানে গানে কিন্তু নিজের মরণের আগেই পরিণতির কথা শোনাতেন। অঘোষিত উঁচু পর্বে নাম খোদাই হয়ে গিয়েছিলো তার। মৃৎশিল্পেও তার দক্ষতা ছিলো দেখার মতো। প্রতিমা তৈরির দায়িত্ব তার উপরেই দিয়ে নিশ্চিন্ত হতো পূজা কমিটি।
শোভনকাকা এলেই আমাদের পুজোর গন্ধ গ্রাম জুড়ে গানের সুরের সঙ্গে ভেসে বেড়াতো। তিনি ছিলেন প্রাণজুড়ানো শান্ত পালক নরম আনন্দের ফেরিওয়ালা। তিনি মাটি হাতে মায়ের সঙ্গে মন মাতানো মন্দাক্রান্তা গাইতেন।
তার চলন বলন দেখে ভালোবেসে তাকে শোভনানন্দ বলতেন তথাকথিত গুরুবৃন্দ…