নির্বাণ – সদানন্দ সিংহ

নির্বাণ         (ছোটোগল্প)    

সদানন্দ সিংহ

(এক)

জীবনের অর্ধেক পেরিয়ে আসার পর নির্বাণ নামের একজন পুরুষ মানুষ একদিন সন্ধ্যেয় ধুলিধূসরিত পৃথিবীর এক সন্ধিক্ষণে পদ্মাসনে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে সমাধিস্থ হবার চেষ্টা করতে গিয়ে টের পায় আজানুলম্বিত বাহুরই আরেক নাম যৌবন যাকে গৌতম বুদ্ধ অবলীলায় ত্যাগ করে গৃহত্যাগী হয়েছিলেন। নির্বাণ আরো বুঝতে পারে যে সে কোনোদিনই গৌতম বুদ্ধের পথে অনুসরণ করার মতো লোক হবার যোগ্যতা অর্জন করতে পারবে না। সে আসলে একজন অতি সাধারণ এক গৃহাকাঙ্ক্ষী লোক এবং সে নাম-ধাম-কামের মধ্যেই মোক্ষলাভ করতে চায়। এই চাওয়াপাওয়ার দোদুল্যমান কম্পনের মাঝে তাই সে আর স্থির হয়ে বসে থাকতে পারে না। উঠে দাঁড়ায়। তারপর সে সামনের একটা গাছকে প্রদক্ষিণ করতে থাকে। সেটা ভক্তিতে নয়, শ্রদ্ধায় নয়। এক বিশুদ্ধ অক্সিজেনের জন্য।

তবে নির্বাণ লোকটা মোটেই খারাপ নয়। সে ঘুষখোর নয়। বিবেকহীন নয়। নিষ্ঠুর নয়। কিছুটা আবেগপ্রবণ এবং মায়ামমতাবোধ প্রবল। তবে উচ্চাকাঙ্ক্ষী, একটু বেহিসেবী এবং মাঝে মাঝে বেপরোয়া। সৌন্দর্যানুরাগী বলেই বোধহয় পৃথিবীর সমস্ত মহিলাদের নিষ্পাপ মনে হয় তার। এমন কি নিজের স্ত্রী শোভাকেও। শোভাকে সে সত্যিই ভালোবাসে। তাই সে শোভাকে সারাজীবন খুশি রাখার চেষ্টা করে এসেছে। তবে শোভার বৈষয়িক চাহিদাও সামান্য। আর সাংসারিক কাজে শোভার কোনো ঘাটটি নেই বললেই চলে।

তবে নির্বাণ জানে তাদের দুজনের দুটো আলাদা বলয়, যেটা হয়তো সুপ্ত ছিল আগে, এখন একটা আলাদা সত্তা নিয়ে বিরাজমান, যেখানে কেউ কারও বলয়ে প্রবেশ করতে কারুর বিন্দুমাত্র উৎসাহ নেই। ছেলেমেয়ে বড় হওয়ার সাথে সাথে সেই বলয়টা আরো ফুটে উঠেছে।

খুব দ্রুত এক ছেলে এক মেয়ে কী করে যে বড় হয়ে গেল, কী করে চাকুরি পেয়ে বাইরে চলে গেল নির্বাণরা ঠিক ঠিক টেরই পায়নি। সব যেন সেলুলয়েডের রীল, সিনেমার মত, পর্দা দিয়ে যেন হুট করে সরে গেল। ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা, ছেলেমেয়েদের স্কুল, ছেলেমেয়েদের টিউশানি, সংসার সামলানো, বাব-মা’র দেখাশোনা করা, চাকরিতে বসদের চাপ – এইসব কিছুর মাঝে পৃথিবীটা কেমন পালটে গেছে নির্বাণরা ঠিকভাবে বুঝতে পারেনি বা বোঝার চেষ্টা হয়তো করেনি।

শোভার যে বলয় সেটা নির্বাণ বাদে অনেকের কাছেই একটা সাধারণ ব্যাপার। সেটা হচ্ছে কিছু সমমনস্ক বন্ধু-বান্ধবীদের নিয়ে পূজা-পাঠ-ভোজন-ব্রত-উৎসব-ধ্যান-দান-ধর্ম এইসব নিয়ে মত্ত থাকা। শোভা এবং তার বন্ধু-বান্ধবীরা মৃত্যুর পরবর্তী এক স্বর্গসুখ লাভ এবং এক উজ্জ্বল পরজন্মের চিন্তায় ভাবিত হয়ে ভক্তির মাধ্যমে অনুষ্ঠান পালন করে চলে।

সবার কাছে যেটা সাধারণ, নির্বাণের কাছে ওটা অসাধারণ। কারণ নির্বাণ পরজন্মের কথা চিন্তাও করতে চায় না। এ জন্মেই সে মোক্ষলাভ করতে চায়। এই জীবনটাই তার কাছে সবকিছু। এই জীবনেই সে সাধ্যমত সব কিছু উপভোগ করতে চায়। কিন্তু শোভা এখন যেন অন্য জগতে। ছেলেমেয়েরাও এখন দূরে। ফলে নির্বাণও তার নিজস্ব জগতে প্রায়ই ঢুকে পড়ে।

নির্বাণের কাছে তার নিজস্ব জগৎটা একটা খুবই সাধারণ জগৎ। সেই জগতে ঢুকে সে কিছু কবিতা লেখে, কিছু গল্প লেখে। উপন্যাস লেখার চেষ্টা করে। আর নষ্টালজিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ক্ষতবিক্ষত হয়, সেটা অন্য কেউ টের পায় না।

মাঝে মাঝে নির্বাণ ঘর থেকে বের হয়ে উদ্দেশ্যহীনভাবে এদিক সেদিক রাস্তায় হেঁটে যায়।

  

(দুই)

ড্রয়িং রুমে এখন শোভারা এক সমবেত প্রার্থনাসভায় ব্যস্ত। রবিবারে এটা অনেকক্ষণ ধরে চলে। তাই নির্বাণ জামা-প্যান্ট পালটে ঘর থেকে রাস্তায় নেমে আসে।

সূর্যাস্ত হয়ে গেলেও রাস্তায় এখনো পরিষ্কার আলো। রাস্তাঘাটে ব্যস্ততা নেই, কিছুটা খালি খালি। নির্বাণ এয়ারপোর্ট রোড ধরে ইসকন স্কুলের দিকে হাঁটতে থাকে। মনে পড়ে, এই রাস্তায় ত্রিশ বছর আগে ভর দুপুরে সে, মাণিকদা আর দীপঙ্কর কতোবার যে হেঁটে গেছে। তখন ইসকন স্কুলটা ছিল না। ওখানে এক তাড়ির দোকান ছিল। ঐ তাড়ি খাওয়ার জন্যেই তারা এই রাস্তা দিয়ে ভর দুপুরে যাতায়াত করতো। ভর দুপুরে সেখানে লোক খুবই কম থাকতো। তাড়ি খেতে খেতে দীপঙ্কর তার নতুন কবিতা পাঠ করে শোনাতো। শুনে মাণিকদা মন্তব্য করতো, এই শব্দের বদলে অমুক শব্দটা হলে আরো ভালো হত। দীপঙ্কর, মাণিকদা এখন কেউই আর পৃথিবীতে নেই।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে নির্বাণ দেখে যাত্রীবাহী এক অটো রিকশা তাকে পেরিয়ে সামনে দ্রুত ছুটে যাচ্ছে। যাবার সময় অটো রিকশা থেকে কেউ একটা সিগারেটের জ্বলন্ত টুকরো শূন্যে ছুঁড়ে মারে। সেই টুকরোটা শূন্য থেকে হঠাৎ ছুটে নির্বাণের ওপর নেমে এসে অদৃশ্য হয়ে যায়। নির্বাণ ঝটপট জামাকাপড় ঝাড়তে ঝাড়তে অটো রিকশার উদ্দেশ্যে চেঁচায়, এ্যা-ই কুত্তার বাচ্চা। কিন্তূ অটো রিকশাটা ততক্ষণে সামনের মোড়ে হারিয়ে গেছে।

নির্বাণ তার জামাটা তাড়াতাড়ি খুলে নেয়। প্যান্ট, গেঞ্জি ঝাড়ে। কিন্তু না, সিগারেটের টুকরোটা আর খুঁজে পায় না। কোথায় জানি অদৃশ্য হয়ে গেছে। সে আবার জামাটা পরে নেয়। সামনের দিকে হাঁটতে থাকে। কিন্তু হাঁটতে হাঁটতে তার মনে হয় ডান কাঁধের এক জায়গায় যেন চিন চিন করে জ্বলছে। ঘাড় ঘুরিয়ে সে জায়গাটা দেখে, হাত দিয়ে স্পর্শ করে। কিছুই দেখতে পায় না। সে আবার এগোয়। কিন্তু চিন চিন জ্বালা আর থামে না। সে আবার আগের মত সব পরীক্ষা করে। কিছুই দেখতে পায় না। এবার সে তার মনটাকে শান্ত করে। জ্বালাটাকে সহ্য করার চেষ্টা করে। নিজের সহ্যশক্তি দেখে। বাড়ুক, বাড়ুক, জ্বালাটা আরো বাড়ুক। আমি নির্বাণ, সবকিছু সহ্য করার ক্ষমতা ধারণ করবো। তারপর পৃথিবীর ওপর উগড়ে দেবো।   

এইভাবে কিছুক্ষণ চলার পর সে দেখে, তার সহ্যশক্তি ক্রমাগত বাড়ছে আর বাড়ছেই। জ্বালাটাকে আর জ্বালা বলেই মনে হচ্ছে না আর। সে বুক ফুলিয়ে এগোয়। এগোতে এগোতে সে একটু আশ্চর্য হয়ে লক্ষ করে, তার কাছ দিয়ে যারা হেঁটে যাচ্ছে, সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছে, স্কুটার-বাইক-গাড়িতে করে যারা যাচ্ছে – তাদের প্রত্যেকের পিঠে যেন এক ধিকিধিকি লাল আগুন জ্বলছে। কিন্তু তারা যেন এখন কেউই তা টেরই পাচ্ছে না, যে যার মতো ব্যস্ত।
যেতে যেতে নির্বাণ এবার আপন মনে হাসে, পাবেন। পাবেন। সবাই একদিন টেরটা পাবেন।