লিলিপুটদের গ্রাম মাখুনিক
সদানন্দ সিংহ
লিলিপুট এবং গালিভারের গল্প কে না জানে? ছোটবেলায় ভাবতাম লিলিপুটদের সত্যিই একটা দ্বীপ আছে। সেই লিলিপুটদের উচ্চতা ছিল ১৫ সেন্টিমিটারের একটু বেশি। সেগুলি ছিল জোনাথন সুইফটের লেখা কাল্পনিক কাহিনি।
তবে আজ আমি যাদের কথা বলতে যাচ্ছি সেটা সত্যি এবং এই গ্রাম এখন একটা ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই গ্রামের লোকদের গড় উচ্চতা একসময় ছিল ৫০ সেন্টিমিটার।
এই গ্রামের নাম মাখুনিক। আফগানিস্থানের সীমান্তে ইরানে এই গ্রাম অবস্থিত। আফগানিস্থান সীমান্ত থেকে এই গ্রামের দূরত্ব ৭৫ কিলোমিটার। এই গ্রামের সবচেয়ে কাছের শহর হচ্ছে বিরজান্দ। তেহেরান থেকে বিরজান্দ যাওয়ার প্রতিদিন ফ্লাইট আছে। বিরজান্দ থেকে প্রাইভেট কারে এই গ্রামে যেতে প্রায় দুই ঘন্টা লাগে।
এই গ্রামের বাসিন্দারা একসময় আফগানিস্থান থেকে এখানে এসে বসতি গড়েছিল। রুক্ষ্ম পরিবেশে একদিন এদের জীবনযাপন ছিল দুর্বিষহ। গ্রামের বাসিন্দারা প্রধানত তাদের গবাদি পশুচারণ করে জীবিকা নির্বাহ করে। তারাও কিছুটা কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাদের বেশিরভাগ কৃষিপণ্যের মধ্যে রয়েছে গম, রসুন, শালগম, বিটরুট, গাজর, টমেটো, পেঁয়াজ এবং জাফরান। মাখুনিকের বাসিন্দারা সাধারণ নিরামিষ খাবার যেমন কাশক-বেনেহ (পাহাড়ে জন্মানো এক ধরনের পেস্তা থেকে তৈরি) এবং পোখতেক (শুকনো ঘোল এবং শালগমের মিশ্রণ) এর মতো খাবারের উপর নির্ভর করে। কিন্তু খাবার জোগাড় করাই ছিল সবচেয়ে কঠিন কাজ। ফলে প্রায় অভুক্ত অবস্থায় এদের দিনগুলি কেটে যেত।
বিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি রাস্তা নির্মাণ এবং যানবাহনের বিস্তারের ফলে মাখুনিকের বাসিন্দাদের ইরানের অন্যান্য অংশে পাওয়া উপাদান যেমন চাল এবং মুরগির মধ্যে আদানপ্রদান করার সুবিধা পায়।
এরা চা খাওয়াকে আগে ঘৃণ্য দৃষ্টিতে দেখত। কেউ চা খেলে লোকে ভেবে নিত সে আফিমে আসক্ত।
মাখুনিকের বাসিন্দাদের উচ্চতার ঘাটতিতে অপুষ্টি উল্লেখযোগ্যভাবে অবদান রেখেছে। এর জন্য আরো কিছু কারণ উদ্ধৃত করা হয়েছে। নিজেদের গোষ্ঠীর মধ্যে বিবাহের জনপ্রিয়তা যা বাসিন্দাদের মধ্যে ব্যক্তির উচ্চতা নির্ধারণের জন্য দায়ী জিনগুলি পরিবর্তন ঘটিয়েছে। প্রতিদিনের খাবারে প্রোটিন এবং ভিটামিনের অভাব তো আছেই, এছাড়া পানীয় জলে পারদের অবশিষ্টাংশ – এইসব কারণে বাসিন্দাদের শারীরিক পরিবর্তন হয়েছে বলে মনে করা হয়।
এই অঞ্চলের বামন বাসিন্দাদের দেখতে পর্যটকরা গ্রামে যান। তবে এটি পর্যটকদের আকর্ষণ করার একমাত্র বৈশিষ্ট্য নয়। গ্রামটি তার প্রাচীন শৈলীর স্থাপত্যের পাশাপাশি তার অনন্য রীতিনীতি এবং সংস্কৃতির জন্যও বিখ্যাত। মাখুনিক ১৫০০ বছর আগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। মজার বিষয় হল মাখুনিকের বাসিন্দারা নিওলিথিক যুগে প্রচলিত স্থাপত্য শৈলীর উপর ভিত্তি করে তাদের বাড়ি তৈরি করেছিল। স্থানীয়দের বিশ্বাস যে ইরানের এই প্রত্যন্ত কোণে, মাখুনিক সহ ১৩টি গ্রাম নিয়ে গঠিত একসময় এখানে একটি প্রাচীন ‘বামনের শহর’-এর অস্তিত্ব ছিল।
২০০৫ সালে, এই অঞ্চলে ২৫ সেমি দৈর্ঘ্যের একটি মমি করা দেহ পাওয়া গিয়েছিল। মমিটি আসলে একটি অকাল শিশু যেটি প্রায় ৪০০ বছর আগে মারা গিয়েছিল। এতে প্রমাণিত যে মাখুনিক বাসিন্দাদের পূর্ববর্তী প্রজন্মগুলি প্রকৃতপক্ষে স্বাভাবিকের চেয়ে আরো অনেক ছোট ছিল।
এদের প্রাচীন ঘরগুলি পাথর ও মাটি দিয়ে তৈরি কর, অনেকগুলি আবার ব্যতিক্রমীভাবে নিচু। ঘরগুলির উচ্চতা ১.৪ মিটার থেকে ২ মিটারের মধ্যে। বাড়িগুলো পাহাড়ের ওপর মাটির স্তর থেকে নিচু জায়গায় তৈরি করা হয়েছে। এর মেঝে প্রায় এক মিটার নিচু। প্রতিটি বাড়িতে মানুষের হাতের তালুর মতো বড় একটি জানালা রয়েছে। প্রতিটি বাড়ির দরজা খুব ছোট এবং একজন সাধারণ উচ্চতার মানুষ মাথা নিচু করেও ঢুকতে হয়তো পারবে না। পাথর, কাঠ এবং কাদামাটি দিয়ে তৈরি, বাড়িগুলি মোটামুটি ১০ থেকে ১৪ বর্গমিটার এবং এতে শস্য এবং গম রাখার পাত্র, একটি রান্নার জন্য একটি মাটির চুলা এবং একটি ঘুমানোর জায়গা থাকে।
প্রতিটি বাড়িতে দুই বা তিনজন স্ত্রী এবং তিন থেকে আটটি সন্তান সহ একজন পুরুষের থাকার ব্যবস্থা থাকে। আর সঙ্গে থাকে সাধারণত অতিথিদের জন্যে ছোট্ট বসবার ঘর।
গ্রামবাসীদের ছোট ছোট বাড়ি তৈরি করার সিদ্ধান্তের পিছনে একটি প্রধান কারণ ছিল ঠান্ডা আবহাওয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করা। এই অঞ্চলে জ্বালানী কাঠের অভাব ছিল এবং শীতে ঘর গরম করার এক গুরুতর সমস্যা ছিল। এই কারণেই তাদের যতটা সম্ভব ছোট বাড়ি তৈরি করতে হয়েছিল যাতে তারা তাদের কম জ্বালানী কাঠ দিয়ে ঘর গরম করতে পারে। অন্যদিকে, তারা খুব ছোট জানালা তৈরি করেছিল যাতে শীতের আবহাওয়া ঘরে প্রবেশ করতে না পারে। ছোট জানালাগুলোও দিনের আলো ঘরে ঢুকতে দেয়। বেশির ভাগ দরজাই বাড়ির দক্ষিণ দিকে অবস্থিত ছিল যাতে ঘরে পর্যাপ্ত পরিমাণে সূর্যের আলো আসে এবং ঘরকে উত্তরের প্রবল বাতাস থেকে রক্ষা করা যায়।
এখন গ্রামে যাওয়ার রাস্তা তৈরি হওয়ার ফলে কিছু আধুনিকতার স্পর্শ এই গ্রামে এসে লেগেছে। বিদ্যুৎ এসেছে। বাচ্চাদের স্কুল হয়েছে। কিছু কিছু ইটের ঘরবাড়ি তৈরি হচ্ছে।
গ্রামের বয়স্ক লোকেরা সরকারি ভাতাও পায়। গ্রামের কিছু লোক মাখুনিকের কাছে একটি খনিতে কাজ করে যদিও ছোট বলে তাদের মজুরী সাধারণ লোকের মজুরীর প্রায় অর্ধেক। এখন খাওয়াদাওয়ায় কিছু পুষ্টি পাচ্ছে গ্রামের বাসিন্দারা। ফলে এখন এদের গড় উচ্চতা নাকি কিছুটা বেড়েছে। হয়তো দু’শ বছর পর এদের গড় উচ্চতা একদিন এক মিটারের কাছাকাছি আসবে।