নিশীথ অভিযান (ছোটদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
জগা চেঁচিয়ে বলছিল, প্রতিশোধ! প্রতিশোধ! আমাদের প্রতিশোধ নিতেই হবে। যেভাবেই হোক। আমরা কিছুতেই ছাড়বো না। জংলিটাকে বুঝিয়ে দিতে হবে, আমাদের সঙ্গে যা তা করলে বিপরীত ফল পাবে।
হারু ঠাকুরের বাগানে আমরা গোল হয়ে বসে রয়েছি। আমরা মানে আমি, জগা, গোবরা, ফটকে আর সুদেব। জংলিমামাকে কী উপায়ে জব্দ করা যায় তাই নিয়ে আলোচনা করছিলাম। কয়েকদিন আগে এই হারু ঠাকুরের বাগানেই জংলিমামা গাড়ির নিচে পড়া একটা মরা ছাগলের মাংস জোগাড় করে আমাদের অজান্তে আমাদেরকে দিয়ে রান্না করিয়ে আমাদেরকেই পেট ভরে খাইয়েছিল। অথচ খাবার আগে পর্যন্ত আমরা কিছুই টের পাইনি কী খাচ্ছি না খাচ্ছি। বাজার থেকে কেনা টাটকা মাংস ভেবে আমরা দুর্ভিক্ষে খাওয়ার মতো খেয়েছিলাম। খাওয়ার পর জংলিমামাই ফাঁস করে দিয়েছিল আমরা নাকি মরা ছাগলের মাংস খেয়েছি। আর মাংসগুলি নাকি গাড়ি চাপা পড়ে নিহত এক ছাগলের শরীর থেকে নেয়া। শুনে আমাদের সবার গা-টা অসম্ভব রকমের ঘিনঘিন করে উঠেছিল। বুঝতে পেরেছিলাম জংলিমামা কেন পেট খারাপের নাম করে আমাদের সঙ্গে খেতে বসেনি। বাড়ি ফিরে সেদিন আমি গলায় আঙুল ঢুকিয়ে গড়গড় করে বমি করেছিলাম। সেই ঘটনার জের ধরেই আজকের আমাদের এই বৈঠক।
সবাই মিলে আমরা ঠিক করলাম জংলিমামাকে একটা শিক্ষা দিতেই হবে। জংলিমামাকে বুঝিয়ে দিতে হবে আমাদের সঙ্গে চালাকি করলে হাতেনাতে খারাপ ফলই পাবে। কিন্ত কী উপায়ে ?
একে একে আমরা সবাই জংলিমামাকে টাইট করার উপায় বাতলে যাচ্ছিলাম। তবে কারুর উপায়গুলি কারুরই মনঃপূত হচ্ছিল না। গোবরা বলছিল, ঢিল মেরে জংলিমামার কেল্লা ফাটানো হোক। ফটকে বলছিল, জংলিমামার জামায় কালি ছিটানো হোক। আর আমি বলেছিলাম, মিলিদের ব্লাডহাউন্ড কুকুরটাকে জংলিমামার ওপর লেলিয়ে দেওয়া হোক। আসলে এই কুকুরটার সঙ্গে আমার খুব ভাব কিনা। এই সময় সুদেব প্রস্তাব করল, রাতে জংলিমামা ঘুমিয়ে গেলে কয়েক গোছা জংলিমামার চুল কেটে আনা হোক। শুনে জগা তো লাফিয়ে উঠল, দারুণ আইডিয়া! জংলিমামার মাথায় একটা ভয়ংকর চিহ্ন আমরা তাহলে রেখে যেতে পারবো।
সুতরাং এই আইডিয়াটা সবারই পছন্দ হয়ে গেল। আমাদের পরিকল্পনা চলতে লাগল কীভাবে জংলিমামার মাথার কয়েক গোছা চুল কেটে নেয়া যায়। শেষে প্ল্যানও তৈরি হয়ে গেল। তারপর আমরা সবাই যে যার বাড়ি চলে এলাম।
দিনটা ছিল শনিবার। সন্ধ্যে গড়িয়ে রাত হল। ক্রমে ক্রমে রাত বাড়তে লাগল। একসময় শুনলাম আমাদের দেয়াল ঘড়িতে ঢং ঢং করে রাত বারোটা বাজল। বাড়ির সবাই ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি একা জেগে জগা-ফটকেদের অপেক্ষা করছি। আমার বিছানায় আধ শুয়ে আমি টেবিল ঘড়ির দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছি। মাথার ওপর ফ্যান চলছে। ঘড়ির কাঁটা আস্তে আস্তে রাত সাড়ে বারোটার ওপর চলে গেল। একটু অধৈর্য হয়ে উঠলাম। ঠিক তখনই দরজায় টুক টুক আওয়াজ পেলাম। সঙ্গে সঙ্গে আমি দরজার দিকে একটা লাফ দিলাম। বিছানাটা ক্যাঁচ করে একটা শব্দ করে উঠল। নিজের ভুলের জন্যে নিজের ওপরই বিরক্তি হল। বাবা-মা শুনতে পায়নি তো শব্দটা ? কেন যে লাফিয়ে উঠতে গেলাম। কিছুক্ষণ অপেক্ষা করলাম, কেউ উঠে পড়েছে কিনা জানার জন্যে। না, কেউ ওঠেনি। পা টিপে টিপে এগিয়ে আমি দরজা খুললাম। আমি বেরিয়ে বাইরে থেকে দরজাটা টেনে দিলাম। বাইরে তখন হাওয়ার লেশমাত্র নেই। অতিরিক্ত গরমে অসহ্য লাগছিল।
বাইরে বেরিয়ে দেখি জগা একাই দাঁড়িয়ে আছে। ফিসফিস করে বললাম, আর সব কই?
জগা ফিসফিস করে জবাব দিল, বলছি। রাস্তায় নেমে আয়।
রাস্তায় নেমে জিজ্ঞেস করলাম, কাঁচি এনেছিস তো ?
— এনেছি।
রাস্তা থেকে আমাদের বাড়িটাকে লক্ষ করলাম। নিস্তব্ধ ভূতুড়ে ভূতুড়ে লাগছে। না, কেউ জেগে উঠেনি। তাহলে আমার লাফানোর শব্দটা কেউ শুনতে পায়নি। যাক নিশ্চিন্ত হওয়া গেল।
ঠিক এইসময় রাস্তার আলোগুলি হঠাৎ দপ করে নিভে গেল। চারিদিকে এখন আবছা অন্ধকার। আমি জগার হাত ধরে জিজ্ঞেস করলাম, বাকিরা সব কোথায় ?
জগা উত্তর দিল, আমি তো গেছিলাম সবার বাড়িতে। কিন্তু শেষপর্যন্ত তুমি-আমি ছাড়া কোন শালাই বেরিয়ে এলো না। সবাই এক-একটা গাধা, ভীতু সব। ফটকেটা বেরিয়ে এসে বলেছিল ওর পেটে নাকি খুব ব্যথা হচ্ছে। গোবরা আর সুদেব তো বেরিয়েই আসেনি। এখন তুই বল, কী করব?
আমি রেগে উঠলাম, কী করব মানে ? যা করার আমরাই করব, আর কারুর দরকার নেই। ভীতুদের দিয়ে পৃথিবীর কোন ভাল কাজই হয় না। চল এখন।
জংলিমামাদের বাড়িটা পাড়ার শেষপ্রান্তে। সেদিকে এগোচ্ছিলাম আমরা। জগা বেশ তাড়াতাড়ি এগিয়ে যাচ্ছিল। ওর সঙ্গে পা মেলাতে আমার একটু কষ্ট হচ্ছিল। এছাড়া অন্ধকারকে আমার বড় ভয় হয়। অন্ধকারে চোখ বুজলেই আমি লাল লাল চোখ, লম্বা লম্বা নখ, ভোজালি, রামদা – আরো কত কি দেখি। হঠাৎ আমার রামখুড়োর কথা মনে পড়ল। গতকালই তো রামখুড়ো সন্ন্যাস রোগে মারা গেলেন না ? এখন যদি রামখুড়োকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে দেখি তাহলে ? ভাবতেই আমার বুকটা ধক্ধক্ করে উঠল। আমি একটু পিছিয়ে পড়েছিলাম। প্রাণপণে দৌড়ে আমি জগার কাছে গিয়ে বললাম, কাঁচিটা আমার কাছে দে তো।
জগা কাঁচিটা বাড়িয়ে দিল। আমি কাঁচিটাকে নিয়ে জোরে চেপে ধরলাম, কাঁচিটা বেশ বড়। দিদিমা একদিন বলেছিল, ধাতু সঙ্গে থাকলে নাকি অপদেবতারা কাছে আসে না।
হঠাৎ একটা গাড়ির হেডলাইটের আলো দেখে জগা বলে উঠল, পুলিশের গাড়ি হতে পারে, ড্রেনে লুকিয়ে পড়। বলেই জগা ড্রেনের পচা জলের মাঝে নেমে পড়ল। আমিও নামতে যাচ্ছিলাম, কিন্তু প্রয়োজন হল না। গাড়িটা অন্য রাস্তা দিয়ে চলে গেছে। ড্রেন থেকে উঠে জগা বলল, শালা আমাকে শুধুশুধি ড্রেনে নামালো। পা-টা ময়লায় ভরে গেছে, এখন কোথায় জল পাই।
শেষে আমরা জংলিমামার টিনের চাল দেওয়া বাড়িতে গিয়ে পৌঁছলাম। তখন ঘামে আমার জামা ভিজে গেছে একদম।
পা টিপে টিপে আমরা জংলিমামার ঘরের দিকে এগিয়ে গেলাম। আমাদের জানাই ছিল জংলিমামার ঘর কোন্টা। ভেতরে ঘ-র-র আওয়াজ করে বোধহয় একটা টেবিল ফ্যান চলছিল। জানালা খোলাই ছিল। জানালায় লোহার শিক দেওয়া, আর ভেতরে ঢোকার উপায় নেই। আবছা অন্ধকারে আমরা ভেতরে জংলিমামাকে খুঁজতে লাগলাম। মনে হল জানালার পাশেই খাটে কেউ একজন শুয়ে আছে। মনে হল লোকটা জংলিমামাই। এমন সময় একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলার আওয়াজ পেলাম। আওয়াজটা শুনে আমরা বুঝে গেলাম মাথা কোন্দিকে আছে। জগা আমার কানেকানে বলল, আওয়াজটা ডানদিক থেকে এসেছে, মানে জংলিমামার মাথা ডানদিকে আছে। শুভকাজটা আমিই করি। কাঁচিটা আমাকে দে। আমি জগার হাতে কাঁচিটা তুলে দিলাম।
তারপর জগা জানালা দিয়ে অন্ধকারে হাত ঢুকিয়ে প্রথমে বাঁহাতে চুলের গোছা ধরে ডানহাত দিয়ে কাঁচি চালিয়ে ক্যাঁচ ক্যাঁচ করে কাটতে শুরু করল। ঠিক তখনই ভেতর থেকে একটা আওয়াজ ভেসে এলো, শিবশংকর শিবশংকর, কে আবার দাড়ির ওপর কাঁচি চালাচ্ছে রে বাবা!
আওয়াজটা শুনেই আমি ভীষণ চমকে উঠলাম। একি, এ যে গুরুদেবের গলা! আমার মায়ের গুরুদেব! গুরুদেব যে কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের বাড়ি আসবেন জানতাম। আর আমার মায়ের গুরুদেব এবং জংলিমামার মায়ের গুরুদেব যে একই – সেটাও আমি জানতাম। তাহলে তো সব্বোনাশ! জংলিমামার চুল কাটতে এসে আমরা কি গুরুদেবের দাড়ি কেটে ফেলেছি ? জগাও ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। আমি হঠাৎ জগাটাকে ফেলে ধূপধাপ করে দৌড়ে পালাতে লাগলাম। পেছন থেকে জগার কণ্ঠস্বর শুনতে পেলাম, ভাই আমাকে ফেলে পালিয়ে যাস নে।
আমি থামলাম না। জগার জন্যে থামবার কোন প্রয়োজনই মনে করলাম না।