সহাবস্থান (ছোটোগল্প)
সদানন্দ সিংহ
শালবনের এক মাদকতা আছে। আর হিজলবনের এক ব্যাকুলতা। বাতাস এলে কেবল শিস দিয়ে যায়। বনে-বাদাড়ে ঘুরে বেড়ালে আর একটু মন দিয়ে কান পাতলে সেটা শোনা যায়। বাবুস্না সেটা ভালো জানে।
বর্ষাকাল শুরুই হয়নি। অথচ আজ সকাল থেকেই মেঘলা। কিছুক্ষণ আগে একটা ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টি হয়ে গেছে। দিনকাল সব কেমন পালটে যাচ্ছে। ঋতুগুলিও সব ওলটপালট হয়ে যাচ্ছে।
সকালের ব্রেকফাস্টটা বেশ একটু হেভি করে সেরে নিল বাবুস্না। তারপর টমির জন্যেও সে একটা ডগফুডের ডালি সাজিয়ে হেভি ব্রেকফাস্টের ব্যবস্থা করে দিল। একবার বেরুলে ফিরতে ক’টা বেজে যাবে কে জানে! হয়তো বিকেলও হয়ে যেতে পারে। বনবিভাগের চাকুরি। আগেও এমনটা অনেকবার হয়েছে। আজও হতে পারে। তাছাড়া তার ওপর দায়িত্বও অনেক।
এ অঞ্চলে বাবুস্না নতুন দায়িত্ব পেয়ে বদলি হয়ে এসেছে। আর টমি হচ্ছে গোল্ডেন রিট্রিভার প্রজাতির এক কুকুর। আসলে শুধু কুকুর বললে ভুল বলা হবে। টমি আসলে বাবুস্নার বন্ধুই। প্রায় দু’বছর যাবৎ টমি তার সঙ্গী।
এদিকের জঙ্গলে অনেক হরিণ আর বেশ কিছু বুনো শুয়োর এবং বাইসন আছে। বছরে দু-একবার হাতির পাল আসে। আবার চলে যায়। চোরাকারবারিরা বনের কাঠ পাচারের সাথে সাথে ফাঁদ পেতে হরিণ, শুয়োর, বাইসন ধরে মাংস আর চামড়া পাচার করে। বেশ কিছুদিন ধরে খবর পাওয়া যাচ্ছিল যে কিছু লোক বুনো জন্তুগুলিকে ধরার জন্যে জঙ্গলে ফাঁদ পেতে চলেছে। আজ তারই অনুসন্ধানে যাবার জন্যে সে আর টমি সকাল থেকেই প্রস্তুতি নিচ্ছিল।
সকালের সেই ইলশেগুঁড়ি বৃষ্টির পর আর বৃষ্টি হয়নি। ঘড়িতে এখন প্রায় সাড়ে নয়টা। আর দেরি করা উচিত নয়। বেরুবার আগে ফরেস্টার গোবিন্দকে সে ডেকে পাঠাল। ফরেস্টার এসেই একটা স্যালুট দিয়ে স্ট্যান্ড পজিশনে দাঁড়িয়ে থাকে। বাবুস্না জানাল যে সে একটু বেরুচ্ছে, অফিসটা যেন লক্ষ রাখে। ফরেস্টার কিছু ফরেস্ট গার্ড নিয়ে বেরুবার জন্য অনুরোধ করল। বাবুস্না জানাল তার দরকার নেই। সে বেশি একটা দূরে যাবে না। অতঃপর বাবুস্না টমিকে নিয়ে বেরিয়ে পড়ল।
বনজঙ্গলের পথ। সোজা সামনের দিকে এগিয়ে গেছে। আর আশ্চর্য, পৃথিবীর সব বনজঙ্গলের পথগুলি যেন একই রকম। আবহাওয়া অনুযায়ী শুধু গাছগুলির রকমফের হয়। আর বনজঙ্গলে বাস করা মানুষগুলির হালও একইরকম। বিশেষ করে এই ভারতীয় উপমহাদেশের এক জায়গায় খুব মিল যে এই লোকদের পর্যাপ্ত আহার আজো জোটে না।
পায়ে চলা পথের চিহ্ন ধরে বাবুস্না আর টমি এগোতে থাকে। এগোতে এগোতে এক গানের সুর ভাজে — ঝুম বরাবর ঝুম বরাবর ঝুম বরাবর ঝু-ও-ম।
বাবুস্নার হাতে একটা বেতের লাঠি, পুলিশের লাঠির মতো। পিঠের ব্যাগের ভেতর আছে জলের বোতল, বিস্কুটের প্যাকেট, একটা টর্চ, নাইলনের দড়ি, আর একটা ভোজালি। আর হ্যাঁ, তার মোবাইল ফোনটাও সে এই ব্যাগেই রাখে। যদিও জঙ্গলের ভেতর মোবাইলের সিগনাল পাওয়া খুব কঠিন। ভোজালিটা সে অনেকদিন আগে অ্যামাজন থেকে কিনেছিল। জঙ্গলে ঘুরলে ভোজালি খুব কাজে লাগে ঘাস-ডালাপালা কেটে কেটে এগোবার জন্যে। বিশেষ করে বর্ষার সিজনে বৃষ্টি পড়লে ঘাসগুলি বেড়ে লম্বা হয়ে যায়। লতা-পাতা ডালা-পালা সব বেড়ে এগোবার পথ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া থাকে লতায় পাতায় ঘাসে গাছে অসংখ্য জোঁক। মানুষের রক্তের গন্ধ পেলে এরা লাফ দিয়ে মানুষের গায়ের ওপর বসে যায়।
আরো বেশ কিছুদূর এগোবার পর একসময় পথের চিহ্ন হারিয়ে যায়। এবার একটু দাঁড়িয়ে কোন্দিকে এগোবে ভাবে বাবুস্না। এইসময় টমি হঠাৎ ঘেঊ ঘেউ করে ডেকে জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে যায়। পিছু পিছু দৌড়োয় বাবুস্না। টমি এবার একটা ঝোপের সামনে দাঁড়িয়ে ঘেউ ঘেউ করতে থাকে। বাবুস্না ব্যাপারটা বুঝতে পারে। হয়তো ঝোপের ভেতরে কোনো খরগোশ লুকিয়ে পড়েছে। টমি ঝোপের চারিদিকে ঘিরে কেবল এদিকওদিক দৌড়োচ্ছে। বাবুস্না ডাকে, টমি, Come টমি। টমি আসতেই চাইছে না। এই খেলায় যেন খুব আনন্দ পাচ্ছিল ও। শেষে বাবুস্না টমির কলার ধরে টেনে আনে।
এবার ওরা ফিরতে থাকে। কিন্তু একটু না একটু যেতেই টমি সেই আগের মতোই ঘেউ ঘেউ করতে করতে জঙ্গলের একপাশে ঢুকে গেল। পিছু পিছু বাবুস্না। একটু যেতেই চমকে গেল সে। এবার টমির সামনে ঘাসের মাঝে তিন ফুটের মত মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে এক সাক্ষাৎ যমদূত গোখরা সাপ। টমি ঝাঁপিয়ে পড়ার চেষ্টা চালাতেই সাপটা ছোবল মারছিল। সঙ্গে সঙ্গে টমি পিছিয়ে যাচ্ছিল। বাবুস্না তাড়াতাড়ি চেঁচাল, No টমি, No।
কিন্তু টমিকে যেন রোখা যাচ্ছিল না। সাপটা প্রায় সাত-আট ফুট লম্বা। টমির নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে সে লাঠি উঁচিয়ে এগিয়ে গেল। লাঠি দিয়ে একটা ব্যারিকেড করে সে টমির কলার ধরে টেনে আনার জন্যে একটু সামনে যেইমাত্র এগোতে গেল অমনি হুড়মুড় করে সামনের ঘাসবন ধসে পড়ল। পরক্ষণেই সে বুঝে গেল চোরাকারবারিদের পাতা ফাঁদের এক কুয়োয় ওরা বন্দি হয়ে পড়েছে এক আতঙ্কজনক অবস্থানের মধ্য দিয়ে যেখানে এক বিষাক্ত সাপ, একজন মানুষ এবং তার কুকুর সামনাসামনি হয়ে আছে যেখানে সাপটি মানুষ এবং কুকুরটাকে যে-কোনো মুহূর্তে মৃত্যুর বিষ ঢেলে দেবে বা মানুষটির লাঠির আঘাতে সাপটার মাথা চূর্ণবিচূর্ণ হতে পারে বা কুকুরটি হয়তো সাপটিকে এক মুহূর্তেই কামড়ে টুকরো টুকরো করে দিতে পারে। পতনের মুহূর্তের মধ্যেই বাবুস্না টের পায় তার এক হাতে এখনো লাঠি আকড়ে আছে, অন্য হাতে টমির কলার। বাবুস্না সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়েও দাঁড়ায় না, নড়াচড়া করলে হয়তো সাপটা ছোবল দিতে পারে। আর তাদের সামনেই গোখরা সাপটা প্রায় তিন ফুট উঁচু ফণা তুলে দাঁড়িয়ে একবার তার দিকে আরেকবার টমির দিকে অনবরত মুখ ঘুরিয়ে যাচ্ছে। কাউকেই সাপটি বিশ্বাস করছে না, ছোবল দেবার জন্যে সে পুরোপুরি প্রস্তুত। দিনের আলোতে বাবুস্না দেখে কুয়োটা প্রায় দশ-এগার ফুট গভীর। চওড়ায় ছ’ ফুটের কাছাকাছি।
টমি তখনো ঘেউ ঘেউ করেই যাচ্ছিল। বাবুস্না এবার ধমকের সুরে বলে, টমি সীট, সীট। টমি এবার চুপ করে বসে যায়, কিন্তু মুখে একটা কু কু জাতীয় শব্দ করতে থাকে যেন সে খুশি হয়নি। তারপর তারা হাড়হিম পরিবেশে্র এই অবস্থায় মিনিটের পর মিনিট কাটিয়ে দিতে থাকে। তাদের কাছে প্রতিটি মুহূর্ত যেন এক অনন্তকাল বলে মনে হতে থাকে। সহাবস্থানের এই আতঙ্কজনক ত্রিভুজের মাঝে বাবুস্নার মস্তিষ্কে এই সহাবস্থানের রীল রেকর্ড হতে থাকে।
একসময় সাপটার ফনা তোলা মাথাটি তিন ফুট থেকে এক ফুটে নেমে আসে। হয়তো সাপটা বুঝতে পেরেছিল যে অপরদিক থেকে তেমন আক্রমণ আসবে না। বাবুস্নাও একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে।
তারপর ?
তারপরের ঘটনা সংক্ষেপে এইরকমঃ-
বাবুস্না টমিকে নিচে রেখে খুব সাবধানে ওপরে উঠে আসে। সেজন্য তাকে খুব একটা কষ্ট করতে হয়নি। ওপরে উঠার জন্য চোরাকারবারিরা আগেই পা রাখার গর্ত কেটে রেখেছিল। ঐ গর্তে পা রেখে সে ধীরে ধীরে উঠে আসে। ওপরে আসার পর মোবাইল ফোনটা বের করে দেখে নেটওয়ার্কের কোনো সিগনাল নেই। তখন সে কাছাকাছি জঙ্গল থেকেই একটা পনের ফুটের মতো লম্বা মূলি বাঁশ ভোজালি দিয়ে কেটে এনে সাবধানে আস্তে আস্তে নিচে নামিয়ে দেয় সাপটার গা ঘেষে। কিছুক্ষণ পরে সাপটা বাঁশ বেয়ে ওপরে উঠে আসে এবং জঙ্গলের ভেতর চলে যায়। এইসব ব্যাপারগুলি সে মোবাইল ফোনে ভিডিও করে রাখে। সাপটা চলে গেলে সে গাছের কিছু শক্ত ডাল কেটে এনে কুয়োর নিচে নামায়। ওদিকে টমি তাকে উঠানোর জন্যে কিছুক্ষণ পরপর আওয়াজ দিচ্ছিল। বাবুস্না নিচে নেমে টমিকে কাঁধের ওপর নেয়। বেশ ভারী টমি। খুব কষ্ট হচ্ছিল বাবুস্নার। সে ডালপালায় পা রেখে রেখে পাঁচ ফুটের মতো উঠে টমিকে দু’হাত দিয়ে ওপরে ঠেলে উঠিয়ে দেয়। এইভাবে উঠে আসার পর সে আর টমি ফেরার পথ ধরে। তখন বিকেল প্রায় চারটা।
গল্পটার শেষ কিন্তু এখানেই হয়নি।
সহাবস্থানের যে আতঙ্কজনক ত্রিভুজের রীল বাবুস্নার মস্তিষ্কে রেকর্ড হয়েছিল সেটা কিন্তু চালু হতে থাকল যখনই বাবুস্না বনজঙ্গলে পা রাখে তখনই – এক ত্রিভুজের অবস্থান এবং বিশ্বাস-অবিশ্বাসের এক দ্বন্দ্ব নিয়ে। সঙ্গে ব্যাকগ্রাউন্ডে এক গান, যেন অনেক অনেক দূর থেকে ভেসে আসছে — ঝুম বরাবর ঝুম বরাবর ঝুম বরাবর ঝু-ও-ম।