রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার সাম্রাজ্য
সদানন্দ সিংহ
রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে কে না চেনেন এখন? ভাবা যায় পাঁচহাজার টাকা-কে থেকে মাত্র কয়েক বছরে কোটি কোটি টাকায় পরিণত করা যায়? ১৯৮৫ সালে মাত্র ৫০০০ টাকা দিয়ে বিনিয়োগ শুরু করে তিনি ২০২২ সালের মধ্যে ৪৬০০০ কোটি টাকার ওপরে সম্পত্তি বানিয়েছিলেন। রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালাকে বলা হয় ভারতের ওয়ারেন বাফেট। ২০২২ সালের ফোর্বস বিলিয়নারিস তালিকায় ওয়ারেন বাফেট বিশ্বের পাঁচ নাম্বারে, তাঁর সম্পত্তির পরিমান ১০৬.৬ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার যা ভারতীয় টাকায় ৮৪৭২১৭ কোটি টাকার মত। আর ফোর্বস বিলিয়নারিস তালিকায় রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা বিশ্বের ৪৩৮ নাম্বারে যার সম্পত্তির পরিমান ৫.৮ বিলিয়ন আমেরিকান ডলার যা ভারতীয় টাকায় ৪৬০৯৬ কোটি টাকার মত। দু’জনের মধ্যে এক জায়গায় মিল যে এই দু’জন এই বিরাট সম্পত্তি বানিয়েছেন শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করে।
রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা ১৯৬০ সালের ৫ জুলাই মুম্বাইতে একটি রাজস্থানী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন, তার বাবা রাধেশ্যামজি ঝুনঝুনওয়ালা ছিলেন একজন ইনকাম ট্যাক্স অফিসার। মায়ের নাম ছিল উর্মিলা ঝুনঝুনওয়ালা। রাকেশের বাবা তাঁর বন্ধুর সঙ্গে শেয়ার নিয়ে চর্চা করতেন। তা দেখে রাকেশ বাবার কাছ থেকে শেয়ার সম্বন্ধে জানতে চেয়েছিলেন। বাবা উত্তর দিয়েছিলেন পত্রপত্রিকা পড়ে স্টাডি করে বুঝতে। বাবার কথামত রাকেশ পত্রপত্রিকা পড়ে কোম্পানির প্রোফাইল চর্চা করে শেয়ার বাজারের জ্ঞান সংগ্রহ করার পর বাবার কাছে গিয়ে শেয়ারবাজারে ক্যারিয়ার গড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন তিনি। তার বাবা তাকে প্রথমে পড়াশুনা শেষ করার পরামর্শ দেন, তারপর নিজের ইচ্ছেমত ক্যারিয়ার গড়ার কথা বলেন।
রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা ১৯৮৫ সালে সিডেনহাম কলেজ থেকে চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট হিসাবে স্নাতক হন এবং তারপরে তিনি যখন তার ডিগ্রি অর্জন করছিলেন তখন তিনি স্টক মার্কেটে বিনিয়োগ শুরু করেন ঐ ১৯৮৫ সালেই। তিনি ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৭ সালে রেখা ঝুনঝুনওয়ালার সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং উভয়ের একটি কন্যা এবং দুটি যমজ পুত্র রয়েছে।
বিয়ের ১৭ বছর পর কন্যা নিষ্ঠ ৩০ জুন ২০০৪ সালে জন্মগ্রহণ করেন এবং তারপরে রাকেশ এবং রেখার যমজ পুত্র আর্যমান এবং আর্যবীর ২০০৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার বড় ভাই রাজেশ একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট। এ ছাড়া রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালার দুই বোনও আছে। তিনিও পেশায় একজন চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ছিলেন এবং শেয়ার মার্কেট সম্পর্কে তার ব্যাপক জ্ঞান ছিল।
স্টক মার্কেটের প্রতি ঝুনঝুনওয়ালার প্রথম আগ্রহ দেখা দেয় যখন তিনি তার বাবাকে তার বন্ধুদের সাথে শেয়ার বাজার নিয়ে আলোচনা করতে দেখেন। তাঁর বাবা তাকে শেয়ার বাজারের পথ দেখাতেন, কিন্তু তিনি তাকে কখনোই বিনিয়োগের জন্য টাকা দেননি, বরং তিনি শেয়ারে বিনিয়োগ করার জন্য বন্ধুদের কাছে টাকা চাইতে নিষেধ করেন। হাতে সঞ্চয় নিয়ে, রাকেশ কলেজে পড়ার সময়ই বিনিয়োগ শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে নিজের জমানো ₹৫০০০ টাকা মূলধন দিয়ে প্রথম বিনিয়োগ শুরু করেন। কিন্তু ঐ টাকা পর্যাপ্ত ছিল না। তখনকার সময়ে ব্যাঙ্কের ফিক্সড ডিপোজিট জমা রাখার সুদ ছিল ১০%। সেই সময় রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা দুজন চেনা লোকের কাছ থেকে যথাক্রমে আড়াই লাখ এবং পাঁচ লাখ টাকা নেন ব্যাঙ্কের ১০% এর বদলে ১৮% টাকা পাইয়ে দেবে বলে। শুরুর দিকে তেমন সাফল্য না এলেও ১৯৮৬ সালে তিনি টাটা চায়ের ৫০০০ শেয়ার কিনেন যার দাম পড়েছিল শেয়ার প্রতি ৪৩.০০ টাকা এবং ঐ শেয়ার তিন মাস পরে বেড়ে দাঁড়ায় ১৪৩.০০ টাকায়। আর ঐ শেয়ার বিক্রি করে ঝুনঝুনওয়ালার প্রথম বড় লাভ ১৯৮৬ সালে ₹৫ লক্ষ আকারে আসে। তারপর ১৯৮৬ সাল থেকে ১৯৮৯ সালের মধ্যে তিনি প্রায় ২০-২৫ লক্ষ টাকা লাভ করেছিলেন। তারপর তাঁর শুধু এগিয়ে চলার পালা। বিভিন্ন কোম্পানির শেয়ার ক্রয়ের মাধ্যমে তিনি কোটি কোটি টাকা আয় করতে থাকেন। মূলত তিনি টিটান লিমিটেডের শেয়ার থেকেই বেশি আয় করেন। তিনি ২০০২-২০০৩ সালে টাটার টিটান লিমিটেডের ৬ কোটি শেয়ার কিনেন শেয়ার প্রতি ৩.০০ টাকা করে। পরে আরো কোটি কোটি এই শেয়ার কিনে শেয়ারের সংখ্যা বাড়িয়ে নেন যা ২০২০ সালে দাম বেড়ে এই শেয়ারের দাম বেড়ে শেয়ার প্রতি হয় ১৫০০.০০ টাকা। সেই সঙ্গে তিনি লুপিন লিমিটেডের শেয়ার কিনেন যার দাম পড়েছিল শেয়ার প্রতি ১৫০.০০ টাকা যেটা ২০২০ সালে সেই শেয়ারের দাম বেড়ে হয় ৯৭৫.০০ টাকা।
তিনি তার নিজস্ব সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান রেয়ার এন্টারপ্রাইজের অংশীদার ছিলেন। একজন সক্রিয় বিনিয়োগকারী হওয়ার পাশাপাশি তিনি বিভিন্ন কোম্পানির চেয়ারম্যান ও পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি অ্যাপটেক লিমিটেড এবং হাঙ্গামা ডিজিটাল মিডিয়া এন্টারটেইনমেন্ট প্রাইভেট লিমিটেডের চেয়ারম্যান ছিলেন। এছাড়া ভাইসরয় হোটেলস লিমিটেড, টপস সিকিউরিটি লিমিটেড, প্রাইম ফোকাস লিমিটেড, জিওজিৎ ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, বিলকেয়ার লিমিটেড, প্রজ ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড, প্রভোগ ইন্ডিয়া লিমিটেড, কনকর্ড বায়োটেক লিমিটেড, ইনোভাসিন্থ টেকনোলজিস (আই) লিমিটেড, মিড ডে মাল্টিমিডিয়া লিমিটেড, নাগার্জুন কনস্ট্রাকশন লিমিটেডের বোর্ড অফ ডিরেক্টরস ছিলেন।
তিনি আকসা এয়ারের প্রতিষ্ঠাতাও ছিলেন। ২০২১ সালে তিনি জেট এয়ারওয়েজের প্রাক্তন সিইও বিনয় দুবের সাথে মিলে ভারতের একটি কম খরচের বিমান সংস্থা Akasa Air-এর প্রতিষ্ঠা করেন। নতুন এই এয়ারলাইন্সটির ২টি বিমান দেশের ৩টি শহরে চলাচল করছে। ৭০টি আরো বিমানের জন্য নাকি অর্ডার করা আছে।
ভারতের ঐতিহাসিক বিনিয়োগকারী রাকেশ ঝুনঝুনওয়ালা ১৪ আগস্ট ২০২২ সকালে হৃদরোগে আক্রান্ত হন যার পরে তাকে অবিলম্বে ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার কিডনির সমস্যাও দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসা চলছিল। আজ সকালে তিনি মুম্বাইয়ের ব্রীচ ক্যান্ডি হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৬২ বছর।
তাঁর পোর্টফোলিওতে যে কোম্পানির শেয়ারগুলি আছে সেগুলি হল Titan Company Ltd, Star Health and Allied Insurance Company Ltd, Metro Brands Ltd, Tata Motors Ltd, Crisil Ltd, Fortis Healthcare Ltd, Federal Bank Ltd, Canara Bank, Indian Hotels Company Ltd, NCC Ltd, Jubilant Pharmova Ltd, Rallis India Ltd, Nazara Technologies Ltd, Jubilant Ingrevia Ltd, Tata Communications Ltd, Aptech Ltd, Agro Tech Foods Ltd, Karur Vysya Bank Ltd, Va Tech Wabag Ltd, Geojit Financial Services Ltd, Edelweiss Financial Services Ltd, Wockhardt Ltd, Indiabulls Housing Finance Ltd, Dishman Carbogen Amcis Ltd, Anant Raj Ltd, Man Infraconstruction Ltd, D B Realty Ltd, Orient Cement Ltd, Bilcare Ltd, Prozone Intu Properties Ltd, Escorts Kubota Ltd, Autoline Industries Ltd ইত্যাদি। তাঁর স্ত্রীর নামেও রয়েছে কোটি কোটি টাকার শেয়ার। শেয়ারে বিনিয়োগ করে তিনি যে সবসময় লাভ করে গেছেন তা নয়, কিছু জায়গায় তাঁর ক্ষতি হয়েছে। আর সেখান থেকে শিক্ষা নিয়ে তিনি ধৈর্য ধরে আবার অন্য জায়গায় বিনিয়োগ করেছেন।
শেয়ারে বিনিয়োগের ব্যাপারে তিনি পাঁচটি উপদেশ দিয়ে গেছেন। সেগুলি হচ্ছেঃ ১) সঠিক শেয়ার দেখে কিনুন, আর শক্ত করে ধরে বসুন, ২) আপনার স্টক নিয়ে আবেগপ্রবণ হবেন না, ৩) ধৈর্যই সাফল্যের মাপকাঠি, ৪) অন্যরা যখন বিক্রি করছে তখন কিনুন এবং অন্যরা যখন কিনবে তখন বিক্রি করুন, ৫) কখনোই অযৌক্তিক মূল্যায়ন করে বিনিয়োগ করবেন না।