প্রবুদ্ধসুন্দর কর ৬৫২এ
সদানন্দ সিংহ
আমার বাড়ি আগরতলার অভয়নগরে। আমি পড়তাম অভয়নগর হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলে। আমাদের স্কুলের Z প্যাটার্নের ক্লাসরুমগুলির টিনের ছানি দেওয়া যে লম্বা ছাদ ছিল তা লাল রঙের। ফলে লোকমুখে আমাদের স্কুলের প্রচলিত নাম ছিল লালি স্কুল। আগরতলার অনেকেই অভয়নগর হাইয়ার সেকেন্ডারি স্কুলের নাম জানতো না, তবে সবাই লালি স্কুলের নাম জানতো। অবশ্য কেউ লালি স্কুল বললে আমার বেশ রাগ হতো। সেই স্কুলের নাম এখন নেই। প্রায় কুড়ি বছর পর হঠাৎ একদিন আমার স্কুলটাকে দেখতে গিয়েছিলাম। গিয়ে দেখি স্কুলের নাম পরিবর্তন করে রাখা হয়েছে অভয়নগর নজরুল স্মৃতি বিদ্যালয়। দেখে আমার বেশ কষ্ট হয়েছিল।
যাক যে কথা বলছিলাম সেটা বলি। আমি তখন ক্লাস নাইন কি টেন-এ পড়ি। সেই সময় হরিস্যার (হরিপদ কর) আমাদের স্কুলে বদলি হয়ে এলেন। উনি আমাদের ক্লাসের টিচার ছিলেন না। তবে একদিন হরিস্যার আমাদের ক্লাস নিয়েছিলেন আমাদের এক স্যারের অনুপস্থিতির কারণে। হরিস্যার ছিলেন প্রবুদ্ধসুন্দরের পিতা।
বাড়ি থেকে আমার স্কুলের দূরত্ব প্রায় ১ কিলোমিটার। স্কুলে হেঁটেই আসাযাওয়া করতাম। এই আসাযাওয়া পথের ধারে এক বাসায় হরিস্যার পরিবারসহ ভাড়া করে থাকতেন। আমি দেখতাম হরিস্যার মুদির দোকানে জিনিস কিনছেন বা ব্যাগ হাতে বাজারে যাচ্ছেন। তখনই আমি হরিস্যারের সঙ্গে প্রবুদ্ধুকে দেখেছি হাফপ্যান্ট পরা অবস্থায়। না, তখন প্রবুদ্ধের সঙ্গে আমার কথা হয়নি। আর ঐ বাড়িতে প্রবুদ্ধরা অনেকদিন ছিল।
প্রবুদ্ধের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল অনেক পরে, তখন আমি একটা পরীক্ষা দিয়ে চাকরি পেয়ে গেছি এবং চাকুরির পোস্টিং পেয়ে আগরতলার বাইরে থাকি আর শনি-রবিবারে বা বন্ধের দিনে আগরতলায় চলে আসি। এইরকম এক বন্ধের দিনে ঠিক কোথায় মনে নেই হয়তো এক চায়ের দোকানের আড্ডায় বা বিমল চৌধুরীর ওষুধালয়ে প্রবুদ্ধের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। তারপর দেখাসাক্ষাৎ হলেই কথা হত। মনে আছে, প্রবুদ্ধ একদিন দেখা হতেই হঠাৎ বললো, সদানন্দদা আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে। জিজ্ঞেস করলাম, কি কথা। প্রবুদ্ধ বলল, বলব, আমাদের আড্ডায় আসুন। আড্ডার ঠিকানা দিল, জিবি বাজারের এক চা-মিষ্টির দোকান। রবিবার সকালে অনেকেই নাকি ঐ দোকানে আসে আড্ডা দিতে। এক রবিবার সকালে গেলাম জিবি বাজারের আড্ডায়। প্রবুদ্ধ দোকানের সামনেই ছিল। আমরা দোকানের ভেতরে গিয়ে বসলাম। কিছুক্ষণ পরে আরেকজন কে এলো সঠিক মনে নেই, খুব সম্ভবত পল্লব ভট্টাচার্য। এক মুহূর্তের জন্যে দুলাল ঘোষ আর অনুপ ভট্টাচার্য বাজারের থলি হাতে এসে চলে গেলেন। জানালেন, বাজারের থলি রেখে ঘন্টাখানেক পরে আসবেন। সেদিন প্রবুদ্ধ আমাকে অনেক কথাই জিজ্ঞেস করেছিল – কেন লিখি, কী লিখি, কাদের নিয়ে লিখি, কী ইজম ফলো করি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কথা। চা খেতে খেতে আমি আমার মত করে উত্তর দিয়েছিলাম।
ঈশানকোণ যখন প্রথম প্রকাশ করি তখন প্রথম সংখ্যাটা দেখে প্রবুদ্ধ বলেছিল, সব ঠিক আছে, তবে কালারিং বেশি হয়ে গেছে। দেখলাম সত্যিই, তাছাড়া প্রথম সংখ্যাটা HTML4 দিয়ে করা ছিল। দ্বিতীয় সংখ্যা থেকে আমি HTML5 দিয়ে শুরু করেছিলাম, কালারিং একটু কমিয়েও দিয়েছিলাম।
তারপরেও অনেকবার ওর সঙ্গে আমার কথাবার্তা হয়েছে। ওকে আমি সবসময় হাসিখুশি দেখেছি। শেষ দেখা হয়েছিল চিলড্রেন পার্কের এক বইমেলায় বছর তিনেক আগে। দেখা হতেই প্রবুদ্ধ আমাকে একটু দূর থেকে চেঁচিয়ে বলল, সদানন্দদা আপনার তো একটা বই বেরিয়েছে এবার, তাই না? আমি বললাম, কই না তো। আমার কথা শুনে প্রবুদ্ধ হাসতে হাসতে রসিকতা করে বলল, কেন, সদাপুরাণ বেরিয়েছে না?
২০১১-১২ সালের কথা। আমার পোস্টিং তখন কোলকাতায়। এইসময় একদিন হঠাৎ প্রবুদ্ধের ফোন পেলাম। ফোনটা রিসিভ করতেই অপরপ্রান্ত থেকে প্রবুদ্ধ গড় গড় করে একনাগাড়ে কীসব বলে গেল আমি তার কিছুই বুঝলাম না। প্রবুদ্ধ বলে চলছিল, সদানন্দ তুমি আমার ক্লাসমেট, তোমার সঙ্গে একসঙ্গে পড়াশুনা করেছি। কিন্তু তুমি আমাদের বন্ধুত্ব সব ভুলে গেলে? তুমি আমার বেতন আটকে রেখেছ। আমি আমার বেতন পাচ্ছি না। তুমি জান না আমি কী অসুবিধের মধ্যে আছি। তুমি যে এমন করবে আমি ভাবতেই পারিনি। তোমাকে আমার কথাগুলি জানালাম, আর কিছু না। কথাগুলো বলেই ফোনের লাইন কেটে দিল। ভাবলাম হয়তো ভুল করে আমাকে ফোনটা করেছে। ভেবেছিলাম দেখা হলে ওকে জিজ্ঞেস করব, সদানন্দ বলে ওর কোনো ক্লাসমেট আছে কিনা। না, জিজ্ঞেস করা আর হয়ে ওঠেনি। তবে আমি পরে শুনেছি ওই সময়ে সে বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে ছিল।
প্রবুদ্ধ বাংলা ভাষার একজন বলিষ্ঠ এবং অন্যতম কবি, নব্বই দশকের কবিদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে আছে – ইন্দ্রজাল কমিকস, নৈশ্যশিস, আত্মবিষ, আঁতাতের নারী আঁতাতের পুরুষ, যক্ষের প্রতিভূমিকা, ডার্করুম মঘানক্ষত্র। গদ্যগ্রন্থ হল – আমার অ্যাম্বুশ, নীল উপত্যকার রাখাল, আমার লিখনভঙ্গিমা। এছাড়া যৌথভাবে সম্পাদিত “বাংলা কবিতা” ম্যাগ, “ত্রিপুরার বাংলা কবিতা”, “উত্তর-পূর্বের বাংলা কবিতা” ইত্যাদি গ্রন্থ। সুকান্ত পুরস্কার এবং জয়দেব বসু পুরস্কার সম্মানে ভূষিত হয়েছেন।
প্রবুদ্ধকে দেখেছি যা বলার তা সরাসরি সামনেই বলেছে, পিছনে বলেনি। হোক সেটা অপ্রিয় সত্য কথা। তথাকথিত সুবিধাবাদী এবং মতলববাজদের মতো “মুখে হাসি পিছে ছুরি” নিয়ে কোনোদিন চলাফেরা করেনি। এই কারণে অনেক বিতর্ক ওর পিছু নিয়েছে। অবশেষে দুরারোগ্য কর্কট রোগ প্রবুদ্ধের প্রাণটাকে ছিনিয়ে নিল ৫৩ বৎসর বয়েসে। মৃত্যুর দুদিন আগেও হাসপাতালের বেড নাম্বার নিয়েও রসিকতা করে গেছে, “আমি প্রবুদ্ধসুন্দর কর নই। আমি গত শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে ৬৫২ এ।“ শেষে তাই সত্যি হয়ে দাঁড়াল। তাঁর এই অকাল মৃত্যুতে সকল সাহিত্যপ্রেমীরা সত্যিই ব্যথিত।