ইমোজি চর্চা
সদানন্দ সিংহ
ভারতবর্ষে জি শব্দের একটা সম্মানজনক অবস্থান আছে। যেমন নেহেরুজি, শাস্ত্রীজি, নেতাজি, আরো অনেক। এঁদের সবারই চাক্ষুষ অস্তিত্ব ছিল একসময়। ইমোজিও এখন সম্মানজনক অবস্থান নিয়ে গেঁড়ে বসেছে আমাদের কাছে। তবে ইমোজি ব্যাপারটা অন্যরকম, যার অস্তিত্ব কেবল ডিজিটাল জগতে এবং একে ধরাছোঁয়া যায় না। নেট নিয়ে যাঁরা ঘাঁটাঘাঁটি করেন তাঁরা কেউ এই ইমোজিকে চেনেন না এখন – এমন কেউ আছেন কিনা সন্দেহ। ভাবতে পারেন, প্রতিদিন এখন ৯০০ মিলিয়নেরও বেশি ই্মোজির চলাচল হয় আন্তর্জালে। ৯০০ মিলিয়ন মানে ৯০ কোটি।
অবশ্য ইমোজি শব্দের একটা জাপানি অর্থ আছে। আসলে ইমোজি হল দুটি জাপানি শব্দের মিশ্রণঃ- ছবি এবং চিঠি। এটি একটি নিছক কাকতালীয় যে “ইমোজি”-র জি যেমন ভারতীয়দের কাছে এক সম্মানজনক শব্দ তেমনি কেউ যদি মনে করেন শব্দটি ইংরেজি Imotion থেকে উদ্ভূত হয়েছে । জাপানি ডিজাইনার শিগেতাকা কুরিতাকে আজকের ইমোজির প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। প্রথম ১৯৯৯ সালে NTT DOCOMO নামে একটি জাপানি সেল কোম্পানি মোবাইল ফোন এবং পেজারের জন্য ১৭৬টি ইমোজির একটি সেট প্রকাশ করে। কুরিটা প্রথম ইমোজি লাইব্রেরি তৈরি করতে জাপানি গ্রাফিক উপন্যাস এবং Zapf Dingbats টাইপফেসের পাশাপাশি চিত্র এবং চিত্রগ্রাম ব্যবহার করেছিল। আজকের বিস্তৃত ইমোজি ডাটাবেসে যে পিক্সেলেড ডিজাইনগুলি শেষ পর্যন্ত তৈরি হয়েছে তা মিউজিয়াম অফ মডার্ন আর্ট-এ প্রদর্শন করা আছে। আর প্রথমবারের মতো অক্সফোর্ড অভিধান ২০১৫ সালে একটি ইমোজিকে “বছরের সেরা শব্দ” হিসেবে গণ্য করেছিল। ১৯৯৯ সাল থেকে ইমোজির যে জনপ্রিয়তা এবং জয়যাত্রা শুরু হয়েছিল তা দিনে দিনে আরো বৃদ্ধি পেয়েই চলেছে।
এদিকে লণ্ডনের স্মাইলি কোম্পানি নামক সংস্থাটি একটি স্মাইলি ডিকশনারি তৈরি করে ২০০১ সালে প্রকাশ করে। এই স্মাইলিগুলি ডেক্সটপে ইমেল এবং ম্যাসেঞ্জারে ম্যাসেজ বা চ্যাট করার সময় ব্যবহৃত হত। ডিজিটাল স্মাইলি আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন দ্য স্মাইলি কোম্পানির সিইও নিকোলাস লুফ্রানি। এই স্মাইলি নামের মধ্যেই যে অর্থ আছে সেভাবেই এগুলি দেখা যেত। এছাড়া ছিল বিভিন্ন ধরনের চিহ্ন। যার জন্য এর জনপ্রিয়তা বাড়েনি। কিন্তু ইমোজি যেন মানুষের ইমোশান দিয়েই তৈরি। তার সঙ্গে যুক্ত ছবির মাধ্যমে টেক্সট। ফলে এখন তিন হাজারের ওপর ইমোজি তৈরি হয়ে গেছে। আরো নতুন ইমোজি তৈরি হয়েই চলেছে। একজন অ্যান্ড্রয়েড বা আই ফোন ইউজার সহজেই অ্যাপের মাধ্যমে নিজের কাস্টমাইজড ইমোজি তৈরি করে শেয়ার করতে পারেন। ইমোজি এখন আমদের পরিবারের সদস্য হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সত্যি বলতে কি, বর্তমান ভার্চুয়াল ওয়ার্ল্ডে মুখোমুখি ইন্টারঅ্যাকশনের অনুপস্থিতিতে, ইমোজিগুলি স্ল্যাকের মতো ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে কথোপকথনকে হালকা করতে সাহায্য করেছে। এটা কোভিড-১৯ পরবর্তী কালে আরো বড় করে দেখা গেছে। ইমোজি ব্যবহারের মাধ্যমে যে কেউ তাদের ব্যক্তিত্ব এবং হাস্যরস খুব সহজে এবং তৎক্ষণাৎ প্রকাশ করতে পারে। একবার ভাবুন তো, আপনি যখন কারুর কাছ থেকে একটি স্মাইলি ইমোটিকন পান তখন কি আপনার কান্না পায় ? একদম না। আপনার মনেও তখন এক হাসির ছবি ফুটে ওঠে যা দেখে সত্যিই আপনি আনন্দ বা মজা পান। গবেষণায় নাকি দেখা গেছে যে ইমোজি বন্ধুত্ব গড়ে তুলতে সাহায্য করতে পারে। ২০১৯ সালে Adobe ইমোজি নিয়ে ১০ জন লোকের ওপর এক সমীক্ষা চালায় তাতে দেখা যায় ১০ জনের মধ্যে ৮ জন বিশ্বাস করেন যে ইমোজি ব্যবহারকারীরা বেশি বন্ধুত্বপূর্ণ এবং যোগাযোগ রক্ষাকারী হন।
ইমোজির এমনই রমরমা যে বিশ্ব ইমজি দিবস প্রতি বছর ১৭ জুলাই পালন করা হচ্ছে ২০১৪ সাল থেকে। প্রেম থেকে ব্রেক আপ – কী নেই ইমোজিতে? বর্তমান কর্পোরেট সংস্থাগুলি কর্মচারীদের ইমেল বা টাইপ করা চিঠি লেখার সময় বেশি করে ইমোজি ব্যবহার করতে শুরু করেছেন। ফলে ইমোজি এখন কাগজেও এসে গেছে। শুধু তাই নয়, এখন অনেক গানের ভিডিও, টিকটকের মতো ভিডিওতে অহরহ ইমোজি এসে উপস্থিত হচ্ছে। ভারতবর্ষের মতো দেশে কি জানি, অমিতাভ বচ্চনের মূর্তি বসিয়ে পুজোর মতো একদিন হয়তো ইমোজির মূর্তি বসিয়ে পুজো শুরু হবে।