কালিবাউস – সদানন্দ সিংহ

কালিবাউস – সদানন্দ সিংহ

কালিবাউস     (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

সকালবেলায় বর্ষার গুরু গুরু মেঘ ডেকে উঠলে বজেনের শরীরেও ভেতরেও গুরু গুরু করে কে যেন ডেকে ওঠে। তারপর বৃষ্টি নেমে এসে তা হাওয়ার তালে তালে নাচতে শুরু করলে বজেনের আর ঘরে থাকতে মন চায় না। চা-রুটির এক প্রাতরাশ সেরে এক ছাতি নিয়ে কোমরে বাঁশের তৈরি এক খালুই ঝুলিয়ে সে জাল কাঁধে বেরিয়ে পড়ে, হাওড়া নদীর বাঁকে। যাবার আগে চানমালাকে শুধু বলে যায়, যাইতাছি গো। চানমালা সাধারণত উত্তর দেয়, আইছা, সন্ধের আগেই ফিইরা আইসো। তবে আজ চানমালা এইসব কথার সঙ্গে আরো বেশ কিছু শব্দ জুড়ে দেয়, পাঁচ বছর আগে কালিবাউস খাইছিলাম, অখন হেই মাছের সোয়াদ যেন এক্কেবারে ভুইলা গেছি।
বজেন তার বৌয়ের ইঙ্গিতটা বেশ বুঝতে পারে। বলে, কালিবাউস ত অখন নদীতে আর উঠে না। হেই মাছ কি আইজ নদীতে উঠব ? আইছা দেখি। না পাইলে একদিন কিন্যা খাওয়াইমু।

বজেনের মনে পড়ে, পাঁচ বছর আগে তারই জালে এক বড় কালিবাউস ধরা পড়েছিল। সে মাছ বাড়িতে নিয়ে আসার পর যেন এক উৎসব লেগে গেল। তখনো বজেনদের ছিল একান্নবর্তী পরিবার। মা-বাবা, দাদা-বৌদি এবং তাদের পাঁচ ছেলে-মেয়ে মিলিয়ে মোট এগার জনের পরিবার। হৈ-হুল্লোড় করে রান্না হল। খুশিতে সবাই তারিয়ে তারিয়ে খেল। সেসব এখন বজেনদের ইতিহাস।

বজেনের ভালো নাম ব্রজেন্দ্র। সবাই তাকে বজেন বলেই ডাকে। চানমালা ভালো করেই জানে — বজেন সাধারণত কোথায় কোথায় যায়, কোন্ চা-নাস্তার দোকানে গিয়ে প্রায়দিনই গ্রামীণ রাজনীতির আলাপ-সালাপ তর্ক-বিতর্ক করতে করতে দু-এক কাপ চা কিনে খায়। তারপর তো বাড়ি। আর বর্ষায় এই জাল নিয়ে বেরিয়ে পড়া। শখ বলতে তো ওইটুকুই। আরেকটা শখ আছে অবশ্য — শহরে গিয়ে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখা।

একান্নবর্তী পরিবারের সমাপ্তির পর বাবার সম্পত্তি থেকে ভাগবাঁটোয়ারা করে প্রাপ্ত আড়াই কানি দু ফসলা জমিচাষ আর শীতকালীন কিছু শাকসবজি চাষ করে তেমন কোনো আয়ের পথ দেখেনি বজেন। তবু সে চাষবাস করে যায়। সে জানে না কতদিন ধরে সে চাষবাস চালিয়ে যেতে পারবে। বারবার লোকেরা এসে তাকে বলে যাচ্ছে, ধানী জমিগুলি বিক্রি করে দাও, ভাল দাম দেব। সে দেখেছে তার আশপাশের ধানক্ষেতগুলি বিক্রি হয়ে যাচ্ছে, আর সেখানে বাড়ির পর বাড়ি মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে।

নদীতে জাল ছুঁড়ে মাছ ধরা বজেনের প্রিয় শখ। এটাকে শুধু শখ বললে ঠিক হবে না। আসলে জাল ছুঁড়ে সে আনন্দ পায়। জাল ছুঁড়ে মাছ ধরতে সে ভালোবাসে। আরো সঠিক ভাবে বলতে গেলে বলা যায় — মাছ শিকার করতে সে ভালোবাসে। নদীতে মাছের উপস্থিতি টের পেলেই সে নদীর তীর থেকে জাল ছুঁড়ে দেয়। জালটা তার হাত থেকে বেরিয়ে গোল হয়ে ভাসতে ভাসতে জলে ঝপাং করে পড়ে নিচে চলে যায়। তবে নদীতে তার একারই জাল পড়ে না, মাছের দেখা পেলেই আরো অনেকের জাল একই সাথে নিক্ষিপ্ত হয় এবং ঝপাং ঝপাং করে সেগুলি জলে পড়ে। মাছ যে কার জালে আটকে যাবে কেউ বলতে পারে না। যার জালে মাছ উঠে তার দখলেই মাছটা চলে যায়।

নদীর কিনারে এসে সে দেখে আরো কয়েকজন মৎস্য শিকারি জাল নিয়ে অপেক্ষা করছে। টিপ টিপ এখনো বৃষ্টি চলছে। এর মধ্যে একজনের মাথায় ছাতাও নেই, ভিজে শরীরে জাল নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। সবাই অক্লান্ত চোখে একদৃষ্টে নদীর জলের দিকে তাকিয়ে আছে। দক্ষ শিকারির শ্যেনদৃষ্টি এড়িয়ে যাওয়ার সাধ্যি সবার নেই। আবার সবসময় শিকার জানেও না শিকারিরা অপেক্ষায় আছে।
বজেন নিরিবিলি দেখে এক জায়গায় পজিশন নেয়। হাওড়া নদীর জল ধীরে ধীরে বেড়ে চলেছে। সারারাত বৃষ্টি হলে নদীর জল কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যাবে। স্রোত বেশি হলে বড় বড় মাছরা লাফ দিয়ে কোনো বাধা পেরিয়ে যাবার চেষ্টা করে। বজেন তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে মাছের চিহ্ন খোঁজে, মাছের বুদবুদ খোঁজে। ভাবে, আজ যদি একটা কালিবাউস পায় তাহলে চানমালা খুব খুশিতে ফেটে পড়বে।
তবে হাওড়া নদীতে আজকাল আগের মত আর মাছের দেখা মেলে না। তবু বজেনদের মত কিছু লোক মাছের অপেক্ষায় দিন কাটায়। সকাল গড়িয়ে দুপুর হয়, দুপুর পেরিয়ে সন্ধের দিকে এগোয়।
সন্ধের ঠিক একটু আগে বজেন হঠাৎ দেখে একটা মাছ স্রোতের বিপরীত দিকে এগোচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে সে মাছটার দিকে তাক করে জাল ছুঁড়ে মারে। শূন্যে ভাসতে ভাসতে জালটা যখন নদীর জলে পড়ছে তখনই সে টের পায় তার পাশ দিয়ে আরেকটা জাল মাছ লক্ষ্য করে ওড়ে যাচ্ছে। ঝপাং ঝপাং করে দু’টো জালই নদীর জলে ঝাঁপায় আর ডুব দেয়। এতক্ষণ এখানে সে একাই ছিল, এখন আবার কে এখানে এল ! বজেন ফিরে তাকায়। জগাইকে দেখে। জগাইয়ের বাড়ি পাশের গ্রামে। বজেনের বাড়ি থেকে জগাইয়ের বাড়ি খুব একটা দূরেও নয়। বজেন স্থানীয় বাজারের সাপ্তাহিক হাটবারে জগাই আর জগাইয়ের বৌ দু’জনকে একসঙ্গে পরোটা-তরকারি আর চা বিক্রি করতে দেখেছে অনেকবার। দু-তিনদিন ওদের পরোটা-তরকারি কিনে চানমালার জন্যে বাড়িতেও নিয়ে এসেছে সে।
জগাই জাল টেনে গুটিয়ে আনতে শুরু করেছে। তাই বজেনও জাল টেনে উঠাতে থা্কে। সম্পূর্ণভাবে ডাঙায় জাল তোলার পর বজেন দেখে তার জালে কিছুই নেই। তবে জগাইয়ের জালে কিছু একটা লাফাচ্ছে। শেষে দেখা যায় জগাইয়ের জালে ধরা পড়েছে এক-দেড় কেজি ওজনের এক সত্যিকারের কালিবাউস মাছ। বজেনের শরীরটা উশখুশ করে, ইস এই মাছটা তারই পাওয়ার কথা, কোত্থেকে একজন এসে দান মেরে দিল শেষে ! তার শরীরটা রাগে জ্বলে। সে ভেবেই নেয় এই মাছটা চানমালার জন্যেই এসেছিল। কিন্তু কিছুই করার নেই এখন, তাই কোমরে হাত দিয়ে সে জগাইকে দেখতে থাকে।
জগাই তো কালিবাউস মাছটাকে দেখে মহাখুশি। ভাবে, বাড়িতে আজ একটা দারুণ খাওয়া হবে। সে মাছটাকে হাতে নিয়ে মোলায়েম ভাবে মাছটার শরীরে হাত বুলোতে থাকে। এইসময়ই কাণ্ডটা ঘটে যায়। মাছটা হঠাৎ লাফ দিয়ে জগাইয়ের হাত থেকে ছিটকে এসে বজেনের কাছেই নদীর জলে পড়ে গভীর জলের দিকে সাঁতার কেটে এগোতে থাকে। তা দেখেই বজেন জাল ফেলে মাছটাকে লক্ষ্য করে নদীতে ঝাঁপ দেয় এবং মাছটাকে ধরে ফেলে। বজেন মাছটাকে দু’হাতে চেপে জল থেকে উঠে আসে। ডাঙায় এসে বজেন মাছটাকে তার নিজের খালুইয়ের ভেতর ঢুকিয়ে দেয়। ব্যাপার দেখে জগাই অবাক হয়ে বলে, কিতা করতাছ ? অই মাছটা আমার। জাল দিয়া আমিই ধরছিলাম।
বজেন তাছিল্যের হাসি হাসে, বলে, হ্যাঁ হ্যাঁ ধরছিলা, অইটা অতীত। অখন আমি ইটা নদীর জল থেকে ধরছি। ইটা আমার।
জগাই ছেড়ে দেবার পাত্র নয়, তাই রুখে দাঁড়ায়, কইলেই হইল ইটা তোমার ? আমিই আগে ধরছিলাম, ইটা আমার। দাও আমারে।
বেশি রেগে গেলেই সবসময় বজেনের তোতলামি বেরিয়ে আসে। আজও তাই। সে বলতে থাকে, কী ক-ক-কইলা ? ইটা তো-তো-তোমার ? জো-জোর ক-ক-কইরা নিবা ? আ-আয় দ্যাখা, ক্যা-ক্যা-ক্যামন বুকের পা-পাটা।
রণংদেহি ভাবে বজেন আর জগাই এখন মুখোমুখি দাঁড়িয়ে। কোনো খাবারের জন্যে দুর্বলদের মধ্যেই বোধহয় এভাবে লড়াই শুরু হয়। দূরে কোথাও সন্ধ্যারতির শঙ্খঘন্টা বেজে ওঠে।