
নৌকোদেবতা
বিজয়া দেব
সব পাপ, সব পাপ, এত পাপ কি সয় ? তাই তুমি রুষ্ট হয়েচ। তাই তোমার ক্রোধ হয়্যেছে। কি করলে এত সব পাপ যাবে বলো দিনি। এই জন্মে বুঝি এই পাপ ঘুচবার নয় ? এত বড় শাস্তি কেন দিলে প্রভু ?
হাঁটু গেড়ে ঘাটে বাঁধা নৌকোর কাছে হাতজোড় করে বসে আছে রুইদাস ও মিলা। হাউহাউ করে কাঁদছে। বয়েস তাদের দেহে কামড় বসিয়েছে খুব, শিরাগুলো কুঁচকে যাওয়া চামড়ার ভেতর থেকে উঁকি মারছে। ঘাটের পাশে অনেক লোক জড়ো হয়েছে। সবাই দেখছে। পরস্পর কথা হচ্ছে, আহা, ছেলের পাপে মা বাপের পাপ, ঠিক ঠিক। কত কী করল, তাতে পাপ আর ঘুচল না। হা ভগবান, কত শাস্তি আর দেবে!
কেউ একজন রাগ করে বলে — কী জানি বাপু, কবেকার কথা, পাপ ধুয়ে নিতে বড় ছেল্যাটা এই সুন্দরবন মুলুক ছেড়ে পলাই গেল। বেঁচে আছে কি মরে গেছে কে জানে। পাপ পাপ! কীসের পাপ রে! ঐ নৌকো ভগমান লয় লিজ্যস। সব ভুল কথা। আমি মানি নে।
বলতেই রে রে করে কিছু লোক তার মুখ চেপে ধরল। মেঘন চোখ লাল করে বলল — বিদুর, আরেকবার ওই কথা মুখে আনবি তো দেখে লিব। পাপিষ্ঠ! তোরও হবে।
বিদুর ঘাড় বাঁকিয়ে বলে — কি আর হবে! বাঘে লিবে? সে তো লিতেই পারে। বাঘের সঙ্গে বাস কইরতেছি, এ হতেই পারে। সেখেনে পাপ আসে কুত্থিকে? যত্তসব। আর দেরি করলে কিন্তু মড়া থেকে গন্ধ ছাড়বে। যে গেছে সে তো আর পাপ কইর্যে নি। শুধু শুধু দেহটাকে পচানো কেন? কাইল দুপুরের ঘটনা, আজ তিনটে বেজে গেল, কাউর কুনো হুঁশ দেখিনে।
এইবার মিলা হঠাৎ কান্না থামিয়ে চেঁচিয়ে উঠল — লে লিয়ে যা, লিয়ে যা, এখুনি লিয়ে যা। এইখানে ফেইল্যে রেকে মজা দেইখছে।
শুকিয়ার রক্তাক্ত দেহ নৌকোয় শুইয়ে রাখা। ঘাড় ভাঙা। ঘাড় খুবলে মাংস বেরিয়ে গেছে।
শুকিয়া কাজের খোঁজে গিয়েছিল দিল্লিতে। সুবিধে করতে না পারায় দুদিন আগে ফিরেছিল। ঘরে এই নিয়ে অশান্তি। শুকিয়ার বউ এখন ভিড়ের ভেতর পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। ঘরের ভেতর দু’মাসের বাচ্ছাটাকে পাহারা দিচ্ছে ছ’ বছরের ছেলে। গতকাল সে-ই বড্ড গালাগালি করছিল। দিল্লি যেতে কত টাকা গেল। কিচু করতে পারলেনি। এমন হা-ঘরে অপদার্থ স্বামী আর হয়! ইত্যাদি। সে এমন অশান্তি না করলে শুকিয়া ঐ দূর জঙ্গলে যেত না মোটেই। গতকাল শুকিয়া নৌকো নিয়ে বেরিয়েছিল কাঁকড়া ধরতে। তারপর নৌকো থেকে প্রকৃতির ডাকে গিয়েছিল জঙ্গলে। একটা বীভৎস আর্তচিৎকার। এই চিৎকারের সাথে পরিচিত আছে সবাই যারা গহন সুন্দরবনে যায় কাঁকড়া ধরতে কিম্বা মধু আনতে। বর্শা বল্লম তাদের হাতেই থাকে সবসময়। হলুদে কালোয় ডোরাকাটা বাঘটা তাদের হৈ হৈ চিৎকার আর তাক করা বল্লম দেখেই একছুটে শিকার ফেলে পালিয়ে গেল। ততক্ষণে শুকিয়া শেষ নি:শ্বাস ফেলে নিয়েছে। ঘাড় ভাঙা, খুবলানো মাংস বেরিয়ে গেছে। তারপর টেনে হিঁচড়ে নৌকোয় তুলে আনা হয়েছে। এমন তাক তারা আগেও করেছে। সেইবার হামিদুর আলি এভাবেই গেল মাছ ধরতে গিয়ে। হ্যাঁ হামিদুর মিঞা তো নৌকোদেবতা বললে হাসতো। বলতো বনবিবি ছাড়া কাউকে জানি না। তিনিই দ্যাবোতা, আল্লা, পিরানি। সবাই ধরে নিয়েছিল সেজন্যেই বাঘে খেল লোকটাকে।
কেউ একজন বলল — আর দেরি করা ঠিক হবে না। ততক্ষণে বিদুর মড়া পোড়ানোর জোগাড়ে লেগে গেছে।
রুইদাসের বড় ছেলে কুটুস শিকারি ছিল। মাংস খেত দেদার। রান্না করে নয়, আগুনে ঝলসে একটু নুন মরিচ ছড়িয়ে দিয়ে। এখানে পশুপাখি শিকারে মানা আছে। শুধু সরকারের নয়, বনবিবির, দক্ষিণরায়ের, আর অবশ্যই নৌকোদেবতার। যে নৌকো এখানের লোকজনদের প্রাণে বাঁচিয়ে রেখেছে, মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, সে কি আর এমনি এমনি হয়! দ্যাবতা ছাড়া গরিবের জন্যে কে এমন করে? এই যে কাঁকড়া, মাছ, মধু আনতে নিয়ে যায় সে তরতর করে চলে, স্রোতের টানেই চলে, আবার ফিরিয়েও আনে। তবে নৌকো দেবতার একটা শর্ত আছে, বনজঙ্গলের কোনও প্রাণী, গাছপালা কারো অনিষ্ট করতে পারবে না। এই নিষিদ্ধ কাজ করলেই তোমাকে শাস্তি পেতে হবে। কুটুসকে সবাই নিষেধ করত। কিন্তু কথা শুনলে তো। সেবার ফাঁদ পেতে দুটো বাচ্ছাসহ চারটে হরিণ ধরে ফেলল কুটুস। সাথীরা বলল ছেড়ে দে। ফরেস্ট অফিসারের কাছে যদি খবর যায় তাহলে তোকে জেলে পুরে দেবে। কুটুস শোনার পাত্র নয়। সে জালশুদ্ধ হরিণগুলোকে বেঁধে ফেলল। হরিণগুলো ছটফট করছে। একটা পাখিমারা বন্দুক তার সাথেই থাকত সবসময়। যখন সে জালসহ হরিণগুলো টানছে দেখতে পেল নৌকোয় দুটো চোখ জ্বলছে। ওটা ছিল রুইদাসের নিজের নৌকো। কুটুসের মনে হলো বাঘ। সে পাখি মারা বন্দুক দিল চালিয়ে। চোখদুটোর আলো গেল নিভে। কাছে এসে দেখা গেল নৌকোতে কিছুই নেই। আলো ছিল জ্বালানো। এরপর চারটে হরিণকে ফাঁদসুদ্ধু যখন তোলা হলো নৌকোয় তখন নৌকো আর চলছে না। আলো জ্বালালে আলো যাচ্ছে নিভে। নৌকো হয়ে গেছে ভারী। খুব বিপদ, এই রাতের বেলায় কোনও নৌকো দেখা যাচ্ছে না। এখন কী করে কী করা। কুটুসের সঙ্গে যারা গিয়েছিল তারা বারবার করে বলছিল তুই হরিণগুলোকে জঙ্গলে ছেড়ে আয়। কিন্তু কে শোনে কার কথা! আশ্চর্যজনক ভাবে নৌকোটা দুলে উঠল। অত:পর নির্বিঘ্নে ফেরা হলো কিন্তু গন্ডগোল হলো ঘরে ফেরার পর। একসাথে চারটে হরিণ, মা শিশু সহ, সঙ্গীরা সবকথা রুইদাসকে খুলে বলার পর রুইদাস রেগে উঠল, ভয়ে কেঁপে উঠল, নৌকোদেবতার গায়ে পেন্নাম ঠুকতে লাগলো। মিলা তো হাতজোড় করে বারবার ছেলের হয়ে ক্ষমা চাইছে। কেউ বলল — তোমাদের পুণ্যিতে নৌকো নড়ল কাকা। নাহলে আমরা আজ বাঘের পেটে যেতাম। জঙ্গলে বাঘের চলাফেরা চলছিল। ওর পায়ের শব্দ পেয়েছি। কাকা, এবার হরিণগুলোকে ছেড়ে দিতে বলো। কুটুস কিছুতেই রাজি নয়।
রুইদাস দারুণ রেগে গিয়ে চ্যালাকাঠ তুলে কুটুসের পিঠে এক ঘা লাগিয়ে বলল — হরিণগুলো জঙ্গলে ছেড়ে আয় যা। কুতা থিক্যে আমার ঘরে মাংসখেকো রাক্ষস ঢুইকেছে। আজ তোর একদিন কি আমার একদিন।
চন্ডাল রাগে রুইদাস আবার এক ঘা দিল। ফাঁদের ভেতর আটকা পড়া হরিণগুলো ছটফট করছে।
রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে রুইদাস বলে — হারামজাদা মতলব কইর্যেছে আমাকে জেলে পুরতে। এত এত গাঁয়ের মানুষের সামনে আমার ইজ্জত খারাপ করছে শালা।
বেশ করছি। নৌকো সে আবার দ্যাবতা। ঠিক আছে আমি তুমাদের সঙ্গে থাইকব নাই। চলি।
বলে হরিণের ফাঁদশুদ্ধু টান দিতেই তার মা মিলা এসে বঁটি দিয়ে ফাঁদের জাল কেটে দিতে লাগলো। রুইদাসের তখন জোয়ান বয়েস, শক্ত করে কুটুসের হাত ধরে বউকে বলল — ফাঁদের ফাঁস বেশ বড় করে কেটে দে মিলা।
মিলা ফাঁদের ফাঁস কেটে দিতেই বেরিয়ে পড়ল হরিণগুলো, তারপর তীব্রগতিতে ছুটে অদৃশ্য হলো। কুটুস সোজা দাঁড়িয়ে বলল — আমি চললাম। আর কখনও আমার মুখ দেখতে পাবে না।
সেই যে গেল বড়ছেলেটা আর ফিরে এলো না। ছোটছেলে শুকিয়া তখন কিশোর। ইশকুল যায়।
মিলা পাথর হয়ে দাঁড়িয়ে। তেমনই ছোট্ট শিশুসন্তান ফেলে দাঁড়িয়ে শুকিয়ার বউ। একেবারে চুপ। চোখে জল নেই একফোঁটা। আগুন জ্বলছে দাউদাউ। শুকিয়ার দেহ পুড়ে ছাই হচ্ছে।
ওদিকে ছোট্ট তিনমাসের শুকিয়ার ছেলেটা কাঁদছে জোর। ছ’বছরের ছেলেটা মাকে নকল করে ভাইএর কান্না রুখবার চেষ্টা করে। কী করবে বুঝে পায় না। পাশের ঘরের থুপথুপে বুড়ি লাঠি ঠুকঠুক করে ঘরে ঢোকে। বুড়ির হাত কাঁপে। এই ঘটনায় আজ তাদের ঘরেও খাওয়াদাওয়া হয় নি। আকাশে সূর্যের বড় তেজ আজ।
বলে — হা হা হা কেঁদো না খোকা। তোমার বাপ যে গেল অনেক দূর। বাবা দক্ষিণ রায়, ও যেন সগগে যায়। বড় ভাল ছিল। ঘরে দুধ আছে বাছা?
— জানি না।
— আচ্ছা আমি দেখছি।
খুঁজে পেতে কিছু দুধ পাওয়া দেল, ছাগলের দুধ। ঠাণ্ডা দুধ বাটিতে নিয়ে একখানা চামচ খুঁজে পেতে বের করে বুড়ি তাকায় বাটির দিকে। পেটে উদভ্রান্ত খিদে, এক চুমুক দিয়ে দেখল ভারি মিষ্টি তার স্বাদ। তারপর আরেক চুমুক। শিশুটির কাঁদতে কাঁদতে দম আটকে যাচ্ছে, এবার যেন বুড়ির হুঁশ হলো। এ কি করছে সে! এই বুড়ো বয়েস, কী তার বেঁচে থাকার মানে! না খেয়ে মরে গেলেই বা কি! এই শিশুটি মাত্র এলো এই দুনিয়ায়, কিন্তু কেন এলো! বাঁচবার জন্যে কি? না কি জলা জঙ্গলে বাঁধে কুমিরে শেয়ালে বাঘে ঝড়ে তুফানে মিলেমিশে এই বাঁচি এই মরে যাই করে কম খেয়ে কম পরে দিন যাবে? কেন এলি রে বাছা এই সুন্দরবনে? কাংরা ধরতে?
এই ঠাকুমা, দুধ খেয়েছ? তোমার ঠোঁটে যে দুধ লেগে আছে! — বুড়ি দেখে শুকিয়ার ছ’বছরের ছেলে অবাক চোখে তার দিকে তাকিয়ে।
বুড়ি লজ্জা পেয়ে কিছু না বলে বাটি খোঁজে। একটা ঝিনুক বাটি খুঁজে পায়, তাতে বাকি দুধটুকু ঢেলে ছোট্ট শিশুটিকে ঝিনুক দিয়ে একফোঁটা দিতেই বাচ্ছাটা যেন দুধটুকু শুষে নেয়। ছ’ বছরের ছেলেটা মুখে আঙুল পুরে চুষতে থাকে।
বুড়ি একা একা বকবক করে — নৌকোদেবতা! বাবা রুষ্ট হয়ো না। যে আমাদের খাবার তুলে দেয় মুখে, তোর জ্যাঠা তার চোখেই করল গুলি। হতভাগা! এতো পাপ সয়!