বাংলার গর্ব ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় – সুদীপ ঘোষাল

বাংলার গর্ব ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় – সুদীপ ঘোষাল

বাংলার গর্ব ডাঃ বিধানচন্দ্র রায়

সুদীপ ঘোষাল

তিনি এমন একজন চিকিৎসক ছিলেন যিনি পর্দার আড়ালে রোগীকে দেখেও রোগ নির্ণয় করে ফেলতে পারতেন। কথিত আছে, একবার একটি স্থূলকায় লোক ডাক্তারবাবুকে বার বার এসে রোগের ফিরিস্তি দিয়ে কাঁদুনি গাইতেন। ডাক্তারবাবু বললেন, তোমার ক্যান্সার হয়েছে। ওষুধ খাও, আবার ছয়মাস পরে এসে দেখা করো। দেখা গেল ছয়মাস পরে অই স্থূলকায় লোকটি রোগা হয়ে গেছে বাঁশের কঞ্চির মত, প্রচণ্ড টেনশনে। তারপর ডাক্তারবাবু তাকে বললেন, তুমি সম্পূর্ণ সুস্থ। তোমার এখন কোন রোগ নেই। লোকটি খুশিমনে চলে গেল।
১৮৮২ সালের ১লা জুলাই ডাঃ বিধানচন্দ্র রায় জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে থেকে আমৃত্যু তিনি ওই পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চিকিৎসক হিসেবেও তাঁর বিশেষ খ্যাতি ছিল। ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড থেকে এমআরসিপি এবং এফআরসিএস উপাধি অর্জন করার পর কলকাতার ক্যাম্পবেল মেডিক্যাল স্কুলে (বর্তমানে নীলরতন সরকার মেডিক্যাল কলেজ) শিক্ষকতা ও চিকিৎসা পেশা শুরু করেন। পরে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেনেট সদস্য, রয়্যাল সোসাইটি অফ ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন এবং আমেরিকান সোসাইটি অফ চেস্ট ফিজিশিয়ানের ফেলো নির্বাচিত হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের প্রভাবে রাজনীতিতে যোগ দিয়ে বঙ্গীয় ব্যবস্থাপক সভার নির্বাচনে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়কে পরাজিত করেন। পরে কলকাতা কংগ্রেসের সাধারণ সম্পাদক ও কলকাতা পৌরসংস্থার মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধীর ডাকে আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়ে কারাবরণ করেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মনোনীত হন। ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় নির্বাচন কেন্দ্র থেকে কংগ্রেস প্রার্থীরূপে আইনসভায় নির্বাচিত হন। ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দে গ্রহণ করেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব। তিনি পাঁচটি নতুন শহরের প্রতিষ্ঠা করেন: দূর্গাপুর, বিধাননগর, কল্যাণী, অশোকনগর-কল্যাণগড় ও হাবড়া। তাঁর চৌদ্দ বছরের মুখ্যমন্ত্রিত্বকালে নবগঠিত পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের প্রভূত উন্নতি সম্ভব হয়েছিল সে কারণেই তাকে পশ্চিমবঙ্গের রূপকার নামে অভিহিত করা হয়। ১৯৬১ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভারতের সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মান ভারতরত্নে ভূষিত হন। মৃত্যুর পর তাঁর সম্মানে কলকাতার উপনগরী সল্টলেকের নামকরণ করা হয় বিধাননগর। তাঁর জন্ম ও মৃত্যুদিন ১লা জুলাই দিনটি সারা ভারতে “চিকিৎসক দিবস” রূপে পালিত হয়।
রাজনৈতিক দীক্ষা লাভ করার পর। কিছুদিনের মধ্যে আইন সভার সদস্য নির্বাচিত হন। মহাত্মা গান্ধীর ডাকে কংগ্রেসে যোগদান করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে কারাবরণ করেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর উত্তরপ্রদেশের রাজ্যপাল হওয়ার জন্য তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর লোভনীয় প্রস্তাব সবিনয় ফিরিয়ে দেন। পশ্চিমবঙ্গ আইন সভার সদস্যগণ একবাক্যে তাকে দলনেতা নির্বাচন করলে সমস্যাকণ্টকিত পশ্চিমবঙ্গের নব রূপায়ণকল্পে দায়িত্বপূর্ণ মুখ্যমন্ত্রীর পদ অলংকৃত করেন (পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দ্বিতীয় মুখ্যমন্ত্রী)। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস দলের প্রতিনিধিত্বে ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ১৪ থেকে মৃত্যুকাল অবধি ১৪ বছর তিনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। ১৯৩৫-১৯৪০ সময় তাঁর জন্য ঘটনাবহুল ছিল। শরৎ বসুর সাথে মতবিরোধের কারণে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে তিনি ইস্তফা দেন এবং কিছু সময়ের জন্য রাজনীতি থেকে দূরে থাকেন। অবশ্য গান্ধীর মধ্যস্থতায় কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য হিসেবে তিনি পুনরায় যোগ দেন। তিনি ভারতীয় মেডিক্যাল কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তাঁকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মনোনীত করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূত্রপাতে এ.আই.সি.সি তাদের নীতি পরিবর্তন করে আইন পরিষদ বর্জন করলে তিনি ওয়ার্কিং কমিটি থেকে ইস্তফা দেন।

যুদ্ধচলাকালে ভারতীয় সরকার আর্মি মেডিক্যাল কোর গঠনের জন্য বিধানচন্দ্রের সহযোগিতা প্রার্থনা করলে ১৯৪২ সালে গান্ধীর সম্মতি নিয়ে তিনি এ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ঐ একই বছর তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর পদে নিযুক্ত হন। ১৯৪৩ সালে গান্ধী তাঁর অনশন শুরু করলে তিনি স্বেচ্ছায় এই নেতার শারীরিক অবস্থা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব নেন। পরর্বতী বছর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় রায়কে ‘Doctor of Science’ সম্মানে ভূষিত করে। স্বাধীন ভারতে তিনি যুক্তপ্রদেশের গভর্নর মনোনীত হন। কিন্তু স্বাস্থ্য সংক্রান্ত কারণে তিনি এ পদ থেকে ইস্তফা দেন। ১৯৪৮ সালে পশ্চিম বাংলায় প্রফুল্ল ঘোষের মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে গেলে তিনি প্রদেশ কংগ্রেসের প্রধান নির্বাচিত হন এবং তাঁকে পশ্চিম বাংলা সরকারের দায়িত্ব নিতে হয়। ১৯৫২ সালে তিনি দ্বিতীয় বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৭ সালের নির্বাচনে তিনি তৃতীয় বারের মতো মুখ্যমন্ত্রী হন। তাঁরই উদ্যোগে ভারত সরকার ‘দণ্ডকারণ্য’-এ শরণার্থী পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়। ড. রায় সল্টলেক, কল্যাণী এবং দুর্গাপুর উপশহর কর্ম-পরিকল্পনার উদ্যোগ নেন এবং দিঘায় একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি বর্ধমান, কল্যাণী ও উওর-বাংলায় বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৬১ সালে তাঁকে ‘ভারতরত্ন’ উপাধি প্রদান করা হয়। ১৯৬২ সালের ১লা জুলাই তাঁর তিরোধান দিবস। একইদিনে তাঁর জন্মমৃত্যুর দিন পয়লা জুলাই, আমাদের কাছে অবশ্য পালনীয় দিন।
সময়টা ১৯৪৮ খ্রিস্টাব্দ। সদ্যখন্ডিত পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিন্নমূল লক্ষ লক্ষ নরনারী শিশু নিঃসম্বল অবস্থায় শুধু প্রাণটুকু বাঁচাবার তাগিদে পশ্চিমবঙ্গে আছড়ে পড়ছে সাতপুরুষের পদধূলিরঞ্জিত বাস্তুভূমি ছেড়ে। এই অক্লিষ্টকর্মা কর্মবীর তাদের দিয়েছিলেন মাথাগোঁজার ঠাঁই, একমুঠো খাবারের প্রতিশ্রুতি। উদ্বাস্তুর আগমনে রাজ্যে তখন খাদ্য ও বাসস্থানের সমস্যা ভয়াবহ আকার নিয়েছে। তাছাড়া পূর্ব পাকিস্তান থেকে কাঁচামাল পাটের যোগান বন্ধ। তিনি বহু পতিত জমি উদ্ধার করে এবং কিছু ধানের জমিতে পাটচাষের ব্যবস্থা করে লক্ষাধিক চটকলকর্মীর সম্ভাব্য বেকারি রুখলেন। শিল্পসমৃদ্ধ বাংলা গড়তে তার ত্রুটিহীন পরিকল্পনায় স্থাপিত হল দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী, চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা। বাসস্থানের জন্য তৈরি হল কল্যাণী উপনগরী, লেক টাউন, লবণহ্রদ নগর। দুগ্ধ সরবরাহের জন্যে গড়ে তুললেন হরিণঘাটা দুগ্ধ প্রকল্প। শিক্ষিত বেকারদের বিপুল পরিমাণে কর্মনিয়োগ করেন। স্বাধীনতার পর তখন পিলপিল করে ওপার বাংলা থেকে আসছে উদ্বাস্তুরা। ছড়িয়ে গেল বাংলার নানা জায়গায়। এত এত মানুষ থাকবে কোথায় ? খাবে কী ? কর্মসংস্থানই বা হবে কোথায় ? সমস্যা বেশ গুরুতর। মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সামনে বড় এক চ্যালেঞ্জ। একদিন ডেকে পাঠালেন প্রফুল্ল সেনকে। মন্ত্রীসভার কাজ চালানোর ব্যাপারে প্রফুল্লবাবুর উপর অনেকটাই নির্ভর করতেন। প্রফুল্লবাবুকে নিজের ঘরে ডেকে বললেন, পূর্ব কলকাতায় অনেক জলা জমি আছে। অনেক ভেড়ি আছে। সেগুলি বুজিয়ে ফেলতে হবে এবং এই কাজটা তোমাকেই করতে হবে। শুনেই মাথায় হাত প্রফুল্ল সেনের। তিনি বললেন, ‘সেটা কী করে সম্ভব ? পুরো জায়গাটাই তো আমাদের হেমদার।’ হেমদা মানে, হেমচন্দ্র নস্কর, বিধান রায়ের ক্যাবিনেটে তিনিও একজন মন্ত্রী। বয়সে বিধানবাবুর থেকেও বড়। তাঁর জায়গা নিয়ে নেওয়া হবে! বিধানচন্দ্র বললেন, ‘যেভাবে হোক হেমদাকে বুঝিয়ে রাজি করাও।’ প্রফুল্ল সেন পড়লেন মহা সমস্যায়। খোঁজ নিলেন সেচমন্ত্রী হেমচন্দ্র নস্করের। তখনও তিনি মহাকরণে ঢোকেননি। আধঘণ্টা পর পর ফোন হেম নস্করের ঘরে। এবার হেম নস্কর বললেন, কী ব্যাপার বলো তো। তোমরা তো আমাকে মন্ত্রী বলে মনেই করো না। আমাকে কোনও গুরুত্বই দাও না। আজ হঠাৎ এতবার খোঁজ কেন ? ঠিক আছে, তোমার ঘরে যাচ্ছি।’ প্রফুল্ল সেন বললেন, ‘আপনাকে আসতে হবে না, আমি আপনার ঘরে আসছি। ডাক্তার রায়ের আপনাকে দরকার।’ হেম নস্করকে একরকম পাকড়াও করেই নিয়ে গেলেন বিধান রায়ের কাছে। হেম নস্কর ভাবলেন অন্য কথা। বললেন, ‘বুঝতে পেরেছি। মাছ লাগবে তো! ঠিক আছে, আপনাকে বড় মাছ পাঠিয়ে দেব। আর প্রফুল্ল, তমিও তো মাছ খেতে ভালবাসো। তোমাকেও মাছ পাঠিয়ে দেব।’ তখন বিধান রায় বললেন, ‘না না, মাছের কথা বলছি না। প্রফুল্ল, হেমদাকে বুঝিয়ে দাও আমরা কী করতে চাইছি।’প্রফুল্লবাবু আমতা আমতা করে বললেন, ‘হেমদা, আমরা পূর্ব কলকাতায় একটা নতুন উপনগরী করতে চাইছি। তার জন্য আপনার ওই ভেঁড়িগুলো বুজিয়ে ফেলতে চাই।’ শুনেই আঁতকে উঠলেন হেম নস্কর। ওগুলো দিয়ে দিলে আমি খাব কী ?’ বিধানবাবুও ছাড়ার পাত্র নন। তিনি বললেন, ‘আপনার অনেক টাকা আছে। ওগুলো না থাকলেও আপনার দিব্যি চলে যাবে। সরকারের হাতে টাকা নেই, তাই আপনার যা প্রাপ্য, সেই দাম দিতে পারব না। তবে একেবারে বিনামূল্যে নেব না। এক টাকা দেব।’পরিকল্পনা সাজানোই ছিল। ঘরে ঢুকে পড়লেন চিফ সেক্রেটারি। হাতে নকশা। আর জমি হস্তান্তরের প্রয়োজনীয় কাগজপত্র। ওই ঘরে বসিয়েই সই করিয়ে নেওয়া হল হেম নস্করকে। বেচারা মন্ত্রী! ঠিকমতো বুঝে ওঠার আগেই বিধানবাবুর কথায় সই করে ফেলতে হল। আগে থেকেই সল্টলেকের নকশা তৈরি করে রেখেছিলেন বিধান রায়। ফলে, কাজ শুরু হতে সময় লাগল না। দ্রুত শুরু হয়ে গেল সল্টলেক তৈরির কাজ। পুরো কাজটা বিধানবাবু দেখে যেতে পারেননি। আজকে আমরা যে সল্টলেক দেখছি, তার প্রায় পুরোটাই ছিল বিধান রায়ের পরিকল্পনা ও দূরদৃষ্টির ফসল।
দুর্গাপুর ইস্পাতনগরী , চিত্তরঞ্জন রেল ইঞ্জিন কারখানা । বাসস্থানের জন্য তৈরি হল কল্যাণী উপনগরী, লেক টাউন, লবণহ্রদ নগর । দুদ্ধ সরবরাহের জন্য গড়ে তুললেন হরিণঘাটা দুগ্ধপ্রকল্প। শিক্ষিত বেকারদের বিপুল পরিমাণে কর্মনিয়োগের জন্য সৃষ্টি করলেন কলকাতা রাষ্ট্রীয় সংস্থা। তিনি ১৯৪৩-৪৪ খ্রীঃ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ ছিলেন। তাঁর ঐকান্তিক ইচ্ছায় গড়ে উঠল রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
(তথ্যঋণ- বাংলার রূপকার ও বিভিন্ন গ্রন্থাবলী ও উইকিপিডিয়া।)