
মঞ্জুরি (ছোটোগল্প)
শুভংকর নিয়োগী
আষাঢ়ের এক অবিশ্রান্ত বৃষ্টি-মুখরিত সন্ধ্যায় বোন, মেজদা, বড়দা ও আমি লণ্ঠনের আলোয় পড়তে বসলাম। মেজদা পড়তে বসেই তার মাথাটি ডান কাঁধের ওপর হেলিয়ে ঠেস দিয়ে গুই গুই করে শুরু করল পড়তে। দাদা মিনিট পনেরো এত দ্রুত পড়ত যে তার একটি শব্দও প্রবেশ করত না আমার কানে। তবে একটানা ছন্দ-তাল-হীন শব্দ কানে ঘুরপাক খেত। আমি জোর করে পড়তাম, ফলে দূর থেকে আমার পড়ার শব্দ ছাড়া আর কেউ কিছু শুনতে পেত না। খানিক পরে মেজদা বলত, “আস্তে পড়।” মানে তার ঘুমানোর অসুবিধে হত। বাধ্য হয়ে আমি সপ্তম থেকে নামিয়ে বড়জোর চারে রাখতাম। এদিকে দাদা তখন সাপ খেলানো ঢঙে কখনো ডানদিকে কখনো বাঁদিকে আচমকা ঝুঁকে পড়ে আবার নিজেকে চাঙ্গা করে নেওয়ার চেষ্টা করত। কারণ পড়তে বসেই ঘুমতে দেখলে হাল-বাড়ির ঘা পড়ত পিঠে। পাছে বাবা এসে পড়েন এই ভয়ে আমি একবার দাদাকে ডানহাত দিয়ে একবার মেজদাকে বামহাত দিয়ে ঠেলে সজাগ করে রাখার চেষ্টা করতাম। কিন্তু তখন দাদা ও মেজদার চোখে নিদ্রা-দেবী পুরোপুরি জাঁকিয়ে বসতেন। ফলে আমার ঠেলে দেওয়া একসময় তাদের বিরক্তির কারণ হয়ে উঠত। অগত্যা তারা সেখানেই শুয়ে পড়ত লাঙল-মুড়ি হয়ে।
কিছুক্ষণ বাদে ঠাম্মা পান সেজে হামানদিস্তায় ছিঁচে গালের মধ্যে ঢুকিয়ে আসতেন আমাদের বাইরের বৈঠকখানায় পড়ার ঘরে। দরজার আওয়াজ শুনে দাদা ও মেজদা উঠে বসত ধড়পড়িয়ে। কিন্তু যখনই দেখত যে ঠাম্মার আগমন অমনি তারা আনন্দের এক দীর্ঘনিশ্বাস ফেলত, যেন মনে হতো তারা এ যাত্রা বেঁচে গেল বাবার হাল-বাড়ির হাত থেকে। তিনি আমাদেরকে জোরে জোরে এবং বুঝে বুঝে পড়ার উপদেশ দিয়ে আমার পাশে বসতেন। দেখতাম মঞ্জুরি নামে ঠাম্মার আদরের বিড়ালটিও তাঁর পাশে চারটি পা মুড়ে বসত, যেন সেও কিছু উপদেশ দেবে!
পাঠ্য বিষয়ের দু-চারটি যা জানবার জেনে নিয়ে বোন চলে যেত তার নিজের ঘরে। কাজেই ঘরের মধ্যে মঞ্জুরিসহ আমরা পাঁচটি প্রাণী গভীর বিদ্যাভ্যাসে মগ্ন।
আকাশে গুরু গুরু গর্জনের সঙ্গে বৃষ্টি হয়েই চলেছে মুষলধারে। মাঝে মাঝে বিদ্যুতের আলো অন্ধকারময় সারা পৃথিবীকে দুভাগ করে আবার মিশিয়ে দিচ্ছে। অ্যাসবেস্টরের চালে বর্ষিত বৃষ্টির টাপুর-টুপুর শ্রুতিমধুর শব্দ কানের মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করে মনের মধ্যে বেশ অনুপ্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছে। ঠাম্মা এগিয়ে গিয়ে দরজাটি খুলতেই দেখা গেল, বাইরে ঘন অন্ধকারের মধ্যে বেশ জাঁকিয়ে বসেছে বৃষ্টি। শুধু একটানা ঝম ঝম শব্দ ছাড়া বাকি সব নিস্তব্ধ। শব্দ শুনে মঞ্জুরি চোখ মেলে বাইরে তাকিয়ে কী একটু ভাবল, তারপর মিউ বলে সে বেরিয়ে গেল বৃষ্টির মধ্যে। ঠাম্মা বার বার ডাকা সত্বেও সে শুধু মিউ বলে বেরিয়ে অদৃশ্য হল। যেন বলে গেল, “তুমি চিন্তা করোনা, আমি একটু আসছি।”
খানিকপরে বন্ধ-দরজার কাছে এসে আবার মিউ বলে আমাদেরকে দরজা খোলার নির্দেশ দিল মঞ্জুরি। ঠাম্মা মুখে বিড় বিড় করে দু-একটা কথা বলতে বলতে দরজা খুলতেই মঞ্জুরি বর্ষণসিক্ত শরীর নিয়ে একেবারে আমাদের লণ্ঠনের আলোয় রাখল এক প্রকাণ্ড শোল মাছ। আমি তো বিস্ময়ে হতবাক! ঠাম্মা অবাক হয়ে বললেন, “ও- তুই এজন্যে গিয়েছিলি!” বলে তিনি তার একটি ছেঁড়া কাপড় নিয়ে এসে মঞ্জুরির শরীর পরিষ্কার করে দিলেন। দাদাকে ডেকে তুললাম। তা দেখেই তো চক্ষু ছানাবড়া। বড়দা জিজ্ঞেস করল, “কে ধরল?” ঠাম্মা মঞ্জুরির শরীর মোছাতে মোছাতে উত্তর দিলেন, “আমার মঞ্জুরি।”
বড়দার মাছ ধরার নেশা চিরকালই প্রবল। বোধ হয় তখন মঞ্জুরিই ‘উঠো মাছ’ ধরার কথাটি জানিয়ে দিল। দেখলাম দাদা তার লুঙ্গি সেঁটে গামছা জড়াতে আরম্ভ করেছে। মনে মনে বুঝলাম এবার আমাকে বলল বলে! কারণ মেজদা সেই যে লাঙল মুড়ি হয়ে শুয়েছে তার ঘুম ভাঙানো দুঃসাধ্য ব্যাপার। একমাত্র বাবার পায়ের শব্দ কানে প্রবেশ করলেই ধড়পড়িয়ে ওঠে এমন ভাবে বসে যেন চুপচাপ গভীর বিদ্যাভ্যাসে মগ্ন।
বড়দার জামা কাপড় আঁটসাঁট করে পরার পর বলল, “চল, খালুইটি ধরবি চল।” এই পড়াশোনার মাঝে কেউ কাজ করতে বললে আমার মন বিরক্তিতে ভরে উঠত; কিন্তু বড়োদের মুখের উপর না বলার মতো যোগ্যতা তখনও অর্জন করতে পারিনি। যেখানে না বলে প্রতিকার করা যায় না সেখানে মন বিষাদে ও বিরক্তিতে ভরে উঠত এবং তার আভাস ছড়িয়ে পড়ত গোটা চোখে মুখে। কাজেই কথাটি এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে নাক কুচকে বের করে দিতে হত অন্য কান দিয়ে।
অগত্যা আমাকে খালুই ও হ্যারিকেন হাতে অনুসরণ করতে হতো বড়দাকে। দেখতাম বড়দা লম্বা লম্বা পা ফেলে কখনো মৎসরাজ্যের উঠোনে আবার কখনো একেবারে মৎসরাজ্যের চেম্বারে হাজির হয়ে প্রয়োজনের অতিরিক্ত মাছ অনায়াসেই সংগ্রহ করত। সেদিন প্রথমে গেলাম বাড়ুজ্যেদের অনন্তসাহেরে, দেখলাম কয়েকটি শোল, মাগুর, কই, সব সারিবদ্ধভাবে উপর থেকে নামা লম্বা জলের ধারাকে অবলম্বন করে অতি আনন্দে ওঠে চলেছে। দাদার টর্চের আলো পড়তেই সব মাছ বিপদ বুঝে একসঙ্গে আবার উল্টো অভিমুখে পুকুরের জলে নামার জন্যে ব্যস্ত হয়ে পড়ত! বড়দা কোনোক্রমে তাড়াতাড়ি কয়েকটিকে পলোতে চেপে বাকি মাছ হাত দিয়ে ধরার চেষ্টা করত কিন্তু একটিকে ধরবার আগেই অধিকাংশ মাছ তারা আবার নেমে পড়ত পুকুরে। আমি একটি মাছকে ধরে অন্ধকারে আমার পিছনে ছোটো সাদা একটি কী দেখে পিছন ফিরে তাকাতেই দেখি মঞ্জুরি মস্ত একটি মাগুর মাছ ধরে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করছে। আমি অবাক হয়ে বড়দাকে বলতেই সে তার মুখ থেকে মাছটি নিয়ে আমার খালুইয়ের মধ্যে রেখে মঞ্জুরিকে লক্ষ্য করে আঙুল উঁচিয়ে বলল, “যা ঐ দিকে।”
মঞ্জুরি যেন আদেশের অপেক্ষায় দাঁড়িয়েছিল। বড়দার আদেশ শিরোধার্য করে ঐ দিকে গেল চলে।
বড়দা টর্চ টিপে পুকুরপাড়ে জলের ধারে ধারে আস্তে আস্তে এগোতে লাগল। আমি তার অনুজ। কাজেই তাকে অনুসরণ করাই আমার কাজ। একটু পরেই সে ঝপাস করে জলের মধ্যে পলোটি জোর করে মাটির সঙ্গে চেপে ধরল। এরপর পলোর মুখ দিয়ে হাত গলিয়ে প্রথমে একটি কই মাছ, একটু পরে একটি ছোটো মাগুর মাছ ধরে আমার খালুইতে রাখল। আরও একটু পরে হঠাৎ বাপরে বলে পলো ছেড়ে লাফিয়ে পাঁচ হাত পিছনে এল! আমি অবাক হয়ে বললাম, “কী হল!” বড়দা বিড় বিড় করে নিজের মনে মনে বলল, “না, সাপ হলে তো খসখসে হবে,” বলেই আমাকে লক্ষ্য করে বলল, “দেখ তো, একেবারে পলোর ধারে কী একটি তেলতেলে হাতে লাগছে!” বড়দার মুখের দিকে চেয়ে কিছু একটি বুঝে নেবার চেষ্টা করে মনে মনে বললাম, “বড়দা কি শেষ পর্যন্ত আমাকে সাপের মুখে ঠেলে দিচ্ছে!” আদেশ যখন লঙ্ঘন করার উপায় নেই তখন আদেশ মতো কাজ করতেই হবে। মনে মনে ঠাকুরকে ডেকে, ডান হাতটি গলিয়ে দিতেই ঠিক পলোর ধারে তেলতেলে লাগতেই ‘ওগো মাগো’, বলে আমিও পিছিয়ে এলাম। বড়দা আমাকে কটাক্ষ করে বলল, “ভীতু কোথাকার! তেলতেলে কিনা!।” বড়দার ধমক খেয়ে আমতা আমতা করে বললাম, “হ্যাঁ।” “তাহলে শিওর মাগুর মাছ”, বলেই বড়দা পলোটিকে সামান্য কাত করে যখন হাত বের করল তখন দেখলাম একটি বড়ো মাগুর মাছের মাথা বাদে ধড় সমেত লেজের দিকের বাকি অংশ। তাহলে মাথাটি গেল কোথায় ভেবে পলো তুলল কিন্তু তার আর সন্ধান পাওয়া গেল না।
ওখান থেকে যখন রায়েদের পুকুরপাড়ে যাবার মতলব আঁটছি তখন বড়দা, “মঞ্জুরি……”,- বলে একটি ছোটো ডাক দিল। কিন্তু তার আর পাত্তা পাওয়া গেল না। অগত্যা তাকে রেখেই চলে যেতে হল।
বৃষ্টি তখনও থামেনি। গুঁড়ি গুঁড়ি ঝরেই চলেছে। মাথায় আচ্ছাদিত তালপাতার পেখো। বাম হাতে খালুই আর ডান হাতে হ্যারিকেন। বড়দার কেবল বাম হাতে টর্চ আর ডান হাতে পলো। কাঁচা, কর্দমাক্ত, চটচটে, পিচ্ছিল পথে চলেছি আমরা দুই মেছেল।
মাছ ধরে ফিরে বাড়ির দরজায় টোকা মারতেই ঠাম্মা দরজা খুলে দিলেন। ভিতরে ঢুকে দেখি মেজদা তেমনি ভাবে সুখে নিদ্রা যাচ্ছে লাঙল-মুড়ি হয়ে শুয়ে। বোঝা গেল বাবা তখনও কয়াপাট থেকে ফেরেননি। লণ্ঠনের আলোয় একাগ্রচিত্তে গভীর পাঠে নিমগ্ন মঞ্জুরি।
কতকগুলো মাছ হাঁড়িতে জিইয়ে রেখে বাকিগুলোকে রাঁধবার জন্যে মায়ের হাতে দেওয়া হল। যখন আবার পাঠে মনোসংযোগ করার জন্যে লণ্ঠনটা নিভিয়ে হ্যারিকেন নিয়ে পড়তে বসলাম ঠিক তখনই ঠাম্মা বললেন, “মঞ্জুরি একটি কত বড়ো কই মাছ ধরে এনেছে দেখবি”! বলেই তিনি যা দেখালেন তা চোখে না দেখলে কই মাছ বলে বিশ্বাসই হতো না! এরকম কই মাছ যে আমাদের আশেপাশের পুকুরে জন্মাতে পারে তা আমাদের ধারণার বাইরে ছিল। ঠাম্মা বললেন, “আমার জীবনে দেখা এত বড়ো কই মাছ এই প্রথম।”
আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে মঞ্জুরিকে একটু আদর করার জন্যে কোলে তুলে নিলাম। দেখলাম তার ঠোঁটে রক্ত। ভাবলাম বোধ হয় মাছের রক্ত, তাই ওরকম চাপ চাপ ভাবে বসে আছে ঠোঁটে। ভালো করে লক্ষ করে দেখলাম ঐ রক্ত মাছের নয় তার নিজের মুখের। বুঝা গেল ঐ কই মাছটিকে ধরতে তাকে অনেক নাকাল ভোগ করতে হয়েছে, কারণ কই মাছটি যে সহজে তার কাছে আত্মসমর্পণ করেনি তা তেলাইয়ের ওপর এখনও খস খস করে যাওয়ার ধরণ দেখেই বোঝা গেল। অধিকিন্তু সে ওকে কামড়ে নিয়ে এসেছে তবুও তার নৈতিক শক্তিকে এতটুকু টলাতে পারেনি। কথায় বলে ‘কই মাছর প্রাণ’। আমি ও বড়দা যথারীতি পড়তে বসলাম।
রাত্রিতে ভাত খাবার জন্যে যখন মা রান্নাঘর থেকে হাঁক দিলেন তখন রাত্রি সাড়ে নটা। এবারে মেজদাকে বার কয়েক ঠেলতেই সে বহুকষ্টে উঠল। মঞ্জুরিও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে গেল ভাত খাওয়ার জায়গায়, গৌরবে বলা যায় ডাইনিং হলে। তাকে যথারীতি দুধ দিয়ে ভাত মেখে খেতে দেওয়া হয়েছে সঙ্গে ভাজা মাছ। সে শুধু চোখ দুটি ঢুলু ঢুলু করে রেখে চুপচাপ হয়ে বসে রইল। অন্যদিন হলে সে মিউ মিউ করে আরো দাও আরো দাও বলে ঝালা পালা করে দিত; কিন্তু আজ এই মাছ ধরার যে কর্ণধার সে যদি না খায় তাহলে আমরা সবাই কেমন করে নিজেদের উদরস্থ পূরণ করি!
বুঝলাম কই মাছটি খুব জোরে কাঁটা ফুটিয়েছে ওর মুখে। অতএব সিদ্ধান্ত নেওয়া হল ওকে শুধু দুধ দেওয়া হোক। মঞ্জুরির কিছু হলে সর্বাগ্রে ঠাম্মার অধিকারই বেশি কাজেই তিনিই তার দুধ খাওয়াবার ব্যবস্থা করতে লাগলেন।
অন্য দিন হলে সে এক নিমেষেই সমস্ত দুধ জিভ দিয়ে ছলাক ছলাক করে চেটে খেয়ে নিত। কিন্তু আজকে সে চুপচাপ। শুধু মাঝে মাঝে বন্ধ চোখ দুটিকে খুলে পারিপার্শ্বিক অবস্থাটা একটু দেখে নিয়েই আবার চোখ দুটিকে বন্ধ করে দিল।
খেতে বসেই মেজদা আর একটি মাগুর মাছের চেকার অর্ডার দিয়ে নির্বিঘ্নে চলে গেল খাওয়া শেষ করে। তার দেখাদেখি বড়দাও খেল কিন্তু সে যে পরিতৃপ্তি করে খেতে পারেনি আমি তার খাওয়ার ধরণ দেখেই বুঝতে পেরেছিলাম। পাছে মা বা ঠাম্মার দৃষ্টি আমার উপর পড়ে তাই আমি কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে দ্রুত আহার শেষ করতে লাগলাম। বোধ হয় ঠাম্মা ও মা তাকে নিয়ে বেশি ব্যস্ত ছিলেন বলেই আমাদেরকে খুঁটিয়ে দেখার সময় পাননি।
মঞ্জুরির জন্যে মনটি খারাপ হয়ে গেল আমার। ধরতে গেলে ওতো আমাদেরই একজন। কাজেই একজন সারারাত অভুক্ত অবস্থায় থেকে খিদেই ছটছট করবে আর আমি পেট পুরে খেয়ে সারা রাত্রি নাক ডেকে নিদ্রা যাব! আমি রক্ত মাংসের শরীর ধারণ করে কেমন করে পরিতৃপ্তি পাই!
এই মঞ্জুরির একটি বড়ো দোষ ছিল। প্রতি ছ-মাস অন্তর তিন-চারটি করে বাচ্চা প্রসব করে যায়। এ হয়েছে আর এক বিরাট ঝামেলা। বাচ্চাগুলির চোখ ফুটে যখন নিজেরাই খেলতে আরম্ভ করেছে, পায়ে পায়ে জড়াতে আরম্ভ করেছে কিম্বা রান্নাঘরে খেতে বসলেই যখন তিন-চারটি বাচ্চা সহ স্বয়ং গর্ভধারিণী এক সঙ্গে মিউ মিউ করে খাবার জন্যে কিল বিল করতে আরম্ভ করেছে তখন রাগে একদিকে যেমন মেজাজ চড়চড়িয়ে উঠত অন্যদিকে তেমনি ঠাম্মা তাদেরকে আদর করে পাড়ার দ্বারে দ্বারে ঘুরে একটি করে বিড়াল বাচ্চা গচ্ছিত করার ব্যবস্থা করতেন। বস্তুতঃ যখনই আবার বাচ্চাগুলির অভাবে পা-গুলি খালি লাগত এবং খেতে বসলে মঞ্জুরির ডাক ছাড়া আর কারো ডাক শোনা যেত না তখনই আবার তাদেরকে ফিরিয়ে আনার জন্যে মনটা আনচান করত, অবশ্য তা কেবল কয়েকদিন মাত্র কারণ ছয়মাস পেরতে না পেরতেই সে আবার কয়েকটি সন্তানের মা হতে চলেছে। এ ব্যাপারে তাকে কখনই অলস দেখিনি।
আমাদের তখন তৈরি হয়েছে পশ্চিম দোয়ারি মাটির বাড়িটি। অর্থনৈতিক অনটনের জন্যে কোনরকমে বাহিরের দিকের দরজা, জানালা বসানো হয়েছে, কিন্তু ভেতর দিকের দরজা ও জানালা বসানো হয়নি। কাজেই শীতকালে ভেতর দিকের দরজা ও জানালাতে তেলাই ও চট দিয়ে ঝাঁপ তৈরি করে শীত ঋতু প্রবেশ নিষেধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। একখানি তেলায়ের ওপর একটি কাঁথা আর বাতিল ছেঁড়া ন্যাকড়া ঢুকিয়ে মায়ের হাতে তৈরী বালিশে মাথা দিয়ে সঙ্গে লেপ গায়ে কী পরম সুখেই না গভীর নিদ্রা যেতাম। অধিক রাত্রে পাশ ফিরতেই ‘মিউ’ ডাক শুনে ভেঙে যেত ঘুম। দেখতাম মঞ্জুরি গভীর রাত্রে নোটিশ অগ্রাহ্য করে চুপিচুপি ঝাঁপ ঠেলে লেপের তলায় ঢুকে একেবারে আমার শরীরের সঙ্গে টাচ করে ঘড়র ঘড়র নাক ডেকে দিব্যি আরামে নিদ্রা যাচ্ছে। তার পরিতৃপ্তির নাক ডাক শুনে মনে হতো যে এত আরাম সে বোধ হয় জীবনে কোনোদিন পায়নি। অজান্তে সে আমার লেপের ভাগ নিয়েছিল তাতে কিছু যায় আসে না; কিন্তু সজ্ঞানে কেমন করে তাকে আমার পাশে শুতে দিই! বিশেষত তার ঐ ঘড়র ঘড়র নাক ডাক আমার একেবারে অনন্ত ঘুমের পরিপন্থী! তাকে দাবড়িয়ে ভাগাবার চেষ্টা করা বৃথা; কাজেই হাত দিয়ে ধরে যদি তুলে তাড়াবার চেষ্টা করি তাহলে সে তার চার পায়ের তীক্ষ্ণ নখ দিয়ে বিছানা এমন খামচিয়ে ধরবে যে কার সাধ্য তাকে সে সময় বিছানা থেকে মুক্ত করে, কাজেই সে চেষ্টাও অসম্ভব। অর্থাৎ কোনোভাবেই সে এ রাজ সুখ বিসর্জন করে যাবে না। মারলে শরীর ও মাথা হেলিয়ে পড়ে পড়ে মার খাবে তবু যাবে না। মনে মনে মতলব আঁটতে আরম্ভ করলাম। খানিকক্ষণ চুপচাপ শুয়ে ঘুমিয়ে যাবার ভান করলাম। সে যখন বুঝতে পারল যে আমি ঘুমিয়ে পড়েছি সেও তখন সহজ ভাবে তার শরীরটি আমার বিছানায় এলিয়ে দিয়ে আবার ঘড়র ঘড়র করে নাক ডেকে রাজ-নিদ্রা যেতে আরম্ভ করল। ঠিক তখনই আমি তাকে বিছানা খামচে ধরার সুযোগ না দিয়ে লেপ তুলে চকিতে পায়ে করে ছুড়ে দিলাম। মুখে বললাম, “ভাগ এখান থেকে!” অতঃপর সে একবার গা ঝেড়ে সশরীরে ঝাঁপ ঠেলে ‘মিউ’ বলে প্রস্থান করল। যেন বলে গেল যে বাইরের দরজায় শীত না ঢোকার নোটিশ দেওয়া আছে কিন্তু বিড়াল না ঢোকার তো নোটিশ দেওয়া নেই! মনে মনে মুচকি হেসে ‘যাক বাঁচা গেল’, বলে আমি আবার লেপের তলায় ঢুকে পড়লাম।
সেদিন স্কুল থেকে ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি একটি কুকুর তাড়া করেছে আমাদের মঞ্জুরিকে! সে পালিয়ে যাবার আগেই কুকুরটি তাকে একেবারে পাঁচিলের ধারে কোণঠাসা করে ফেলল। নিরুপায় হয়ে সে একেবারে কুকুরের সামনে সারা শরীর ফুলিয়ে নাক মুখ খিঁচিয়ে চার পায়ের সূচাগ্র ধারাল নখ বের করে এমন হিংস্র হয়ে উঠল যে, কুকুরটি প্রথমে ভয়ে দুপা পিছিয়ে আসতে বাধ্য হল। পরক্ষণেই সাহস সঞ্চয় করে যখন আবার এগিয়ে গিয়ে তাকে মারার জন্যে ঝাঁপিয়ে পড়ল তখন সে অত্যন্ত দ্রুত ক্ষিপ্রতায় তার নখ দিয়ে কুকুরটির গালে ও মুখে এমন আঁচড়াল যে রক্তাক্ত অবস্থায় কাঁই কাঁই শব্দ করে সে পিছু হঠতে বাধ্য হল। মনে মনে বললাম, “কথায় বলে, বাঘের মাসি”। সে হাড়ে হাড়ে প্রমাণ করে দিল।
সেদিনের ঘটনাটি আজও স্পষ্ট। স্কুল থেকে ফিরে ভাত খেতে বসেছি। মঞ্জুরি আজ আর আমার থালার পাশে বসে মিউ মিউ করছে না। বোঝা গেল পেট ভর্তি আছে। দেখলাম সে কাঠের উনুন ধারে ফুটন্ত দুধের কড়ার কাছে চুপচাপ বসে গভীর তপস্যায় রত। আমি নির্বিঘ্নে ভাত খেতে লাগলাম। হঠাৎ নজরে এল সে তার সামনের বাম পাটি তুলে গরম দুধের কড়ায় আলতো করে ডুবিয়ে তা চেটে সাফ করে নিল। তার সাহস দেখে আমি তো অবাক। রাগ চড়চড়িয়ে ওঠে যেতে লাগল আমার! তবুও রাগ সামলে ভাত খাওয়া সমাধা করে আস্তে আস্তে তার দিকে এগিয়ে যেতে লাগলাম। সে ভেবেছিল যে তার গর্হিত কৃতকর্ম কেউ দেখেনি যখন তখন তার চিন্তার কোনো কারণ নেই। সে আমার পদধ্বনি শুনেও পূর্বেকার মতো অবিচলিত ভাবে বসে রইল। আমি তখন বল খেলতাম। কাজেই দুপায়েরই প্রচণ্ড শটের জোর। ভাবলাম ডান পায়ে মারি তারপর সে বাম পায়ের থাবা দিয়ে দুধের উত্তাপ অনুভব করেছে ভেবে তাকে আমি বাম পায়ে করে এত জোরে একটি লাথি মারলাম যে সে একটি অবর্ণনীয় আওয়াজ করে একেবারে দশ হাত দূরে একটি দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে মুমূর্ষু হয়ে একেবারে হয়ে গেল ধরাশায়ী। তার মুখ দিয়ে কোনো কাতর আর্তনাদ না শুনতে পেয়ে ভয় নামক অদৃশ্য বস্তুটি আমার মনে বসল জাঁকিয়ে। আমার জ্বর হলে ডাক্তার এসে যেমন আমার ডান হাতটি তুলে একদিকে বুড়োআঙুল অন্যদিকে চারটি আঙুল দিয়ে কব্জির কাছে ধরে মধ্যমা ও তর্জনী দিয়ে চেপে নাড়ি দেখে তেমনি আমি মঞ্জুরির সামনের ডানপাটিকে তুলে তার নাড়ি দেখতে লাগলাম। কিছুই বুঝতে পারলাম না। ভয় নামক বস্তুটি আমার সারা শরীরে খুব জোরে ঝাপটে ধরতে আরম্ভ করেছে। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে মনে মনে ভাবলাম, নাড়িটি কি দেওয়ালে ধাক্কা লেগে আটকে গেল নাকি! যদি মারা যায় তাহলে আর নিস্তার নেই আমার। একঘটি জল নিয়ে কাছে গিয়ে তার মাথায় আস্তে আস্তে ঢালতেই সে আমাকে দেখে দ্রুত ওঠে ঢুকে গেল মরায়ের তলায়। যাক “বাঁচা গেল”, বলে আমি একটি দীর্ঘনিশ্বাস ফেললাম।
কাছাকাছি কেউ না থাকার ফলে ঘটনাটি আমি আর মঞ্জুরি ছাড়া আর কারো নজরে এল না। মনে মনে ভাবলাম, সে মরে গেলেও যখন কে মেরেছে তার প্রমাণ নেই তখন সে দিক দিয়ে নিস্তার পেয়ে যাব। পরক্ষণেই নিজের মনে মনে বললাম, “নিজের বিবেকের কাছে নিস্তার পাওয়া যাবে কি! সে যে সারাজীবন অপরাধ বয়ে নিয়ে ঘুণপোকার মতো কুরে কুরে খাবে! তার কাছে রেহাই পাব কী করে? আমি দোষী, আমি অপরাধী, শেষ পর্যন্ত বোধ হয় খুনির সমতুল্য হয়ে যেতে হবে!”
যা হবার হয়েছে। এখন এই এক কোড়া দুধকে কী করে জীবাণুমুক্ত করে বাঁচানো যায় সে চিন্তা করতে লাগলাম। উপায়টি আর কিছুই নয়, দুধে বেশি করে জ্বাল দিয়ে ফোটাতে লাগলাম। টগবগ করে ফুটে গেলে নিঃসন্দেহে জীবাণু নষ্ট হয়ে যাবে!
মা এতক্ষণ ঘাটে ছিলেন। একগাদা বাসন হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকে আমার কীর্তিকলাপ দেখে তিনি তো একেবারে থ! বাস্তবিকই একটি কাজ বললে যে কোনোদিন পারব না ছাড়া পারব বলেনি, সে কিনা বিনা আদেশেই কাজ করতে বসেছে? মুখে বললেন, “ব্যাপার কি রে”? আমি মনে মনে বললাম, “মা, তুমি যদি আর দশটা মিনিট পরে আসতে তাহলে আমার কাজ হাসিল হয়ে যেত এবং কেউ ঘুণাক্ষরেও জানতে পারত না।” মুখে মিষ্টি করে হেসে বললাম, “তুমি দুধে যা জল দিয়েছ, দুখ খাচ্ছি না জল খাচ্ছি বুঝতে পারছি না।” আমার কথাটি ধরে নিয়ে বললেন, “হঠাৎ জিভের স্বাদ এত গাঢ় হয়ে গেল কী করে শুনি!” বুঝুন, একথার কী উত্তর দিই এবার! মনে মনে দুষ্টু চিন্তাগুলোকে খুব তাড়াতাড়ি কাজ করার জন্যে মস্তিষ্কের হেড কোয়ার্টারে নির্দেশ দিলাম। মুশকিলটা এখানেই, সময়ে দুষ্টু মতলব একটাও তাড়াতাড়ি বের হতে চাই না। গলায় একেবারে মধু ঢেলে বললাম, “না-মা, আজ একটু টেস্ট করে দেখতে চাই!” তিনি এবার গম্ভীর হয়ে বললেন, “আর টেস্ট করে দেখতে হবে না! আমার দেখা আছে!” একটু থেমে তিনি আবার বলতে লাগলেন, “সবাই যাতে একটু করে দুধ পায় সে দিকে নজর রেখে ব্যবস্থা করতে হয়। একজনের জিভের স্বাদ বদলাতে গিয়ে আর পাঁচজনকে তো না দিয়ে থাকা যায় না!” বলেই, “উঠ,” বলে আমার ডান হাতটি ধরে টেনে তুলে দিলেন। বুঝলাম সত্যি কথা না বললে কতদূরের জল কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে কে জানে! কাজেই মাকে সত্যি কথা বললাম। আমি ভেবেছিলাম যে মা কথাটি শুনে অবাক হয়ে যাবেন। কিন্তু তাকে চুপচাপ স্থির হয়ে বসে থাকতে দেখে আমিই অবাক হয়ে গেলাম। তিনি অত্যন্ত শান্ত স্বরে বললেন, “এ আর এমন কি?” আমি অবাক হয়ে বললাম, “মানে”! তিনি তেমনি শান্ত স্বরে বললেন, “যার যা স্বভাব”! আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “মানে, এর আগে মঞ্জুরির এই অপরাধীয় কৃতকর্ম তুমি দেখেছ?” তিনি এবার মৃদু হেসে বললেন, “দেখেছি, বকেছি, মেরেছি; কিন্তু স্বভাব যায় না মলে”, বলে আমার দিকে মৃদু হেসে তাকিয়ে রইলেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তারপর তুমি কী করেছিলে”? তিনি উত্তর দিলেন, “দুধে জল ঢেলে দুধ ফুটিয়েছি! তুই যেমন করছিলি তেমন; তবে আগে দুধে জল ঢালতে হবে।” মাকে মনে মনে তারিফ করে বললাম, “রাগে তাকে এমন একটি লাথি মেরেছি যে সে আর বাঁচবে কি-না জানি না!” এবারে মা বড়ো বড়ো চোখ করে বললেন, “বলিস কি রে! কোথায় সে?” আমি বললাম, “মরাই তলে”। বলেই চলে যাচ্ছিলাম। মা, তাড়াতাড়ি করে ছুটে এসে মরাই তলে উঁকি মারতে মারতে বলতে লাগলেন, “আর শোন, দুধের কড়াতে মঞ্জুরির দুধ খাওয়ার কথা কাউকে বলিস নি যেন!” আমি লাফিয়ে লাফিয়ে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বলতে লাগলাম, “না-মা, তোমার রসগোল্লার হাড়িতে ইঁদুর পড়েছে তা আমি বলতে যাব কেন?” কথাটি বলে পশ্চিম দিকের দরজা পেরচ্ছি এমন সময় সম্মুখে একেবারে শ্রীচরণকমলেষু ঠাম্মা। তাঁকে চকিতে দেখে নিয়েই তাড়াতাড়ি পাশ কাটিয়ে যাবার উপক্রম করতেই তিনি ডাকলেন, “খোকন শোন, কী হয়েছে রে?” মনে মনে বললাম, “যার কানে ঢুকেছে, পাড়া মাত করতে আর মাত্র কয়েক সেকেন্ড!” আমি ঠাম্মার কথাকে ভ্রূক্ষেপ না করে চলে যেতে যেতে চেঁচিয়ে বললাম, “কিছু হয় নি!”
ঠাম্মা ঘরে ঢুকতেই আমি ফিরে এসে দরজার পিছনে লুকিয়ে রইলাম। তিনি ঘরে ঢুকেই হাঁকলেন, “হ্যাঁ গো বৌ!” মা বোধ করি রান্নাশাল থেকেই বললেন, “যাই মা!” মায়ের ডাক শুনে ঠাম্মা বলতে লাগলেন, “খোকন যেতে যেতে কী যেন বলছিল যে তোমার রসগোল্লার হাঁড়িতে ইঁদুর পড়েছে, আমি বলতে যাব কেন?” মা এবার আমার মুখ থেকে শোনা মঞ্জুরির অপরাধীয় কৃত কাহিনীটি আদ্যপ্রান্ত বললেন। তারপর মা তার শাশুড়ি-মাকে বললেন, “আমি খোকনকে বললাম, “তুই কাউকে বলিসনি যেন! তাই ও ওরকম বলে যাচ্ছিল!” ঠাম্মা তাঁর ফোগলা হাসি হেসে বললেন, “ছেলেটা বড়ো দুষ্টু হয়েছে তো?”
তার কিছুদিন পরেই আবার আপন সংসার সাজিয়ে জাঁকিয়ে বসল মঞ্জুরি। কয়েকদিন যেতে না যেতেই তিন চারটি বাচ্চা মিউ মিউ করে পায়ে পায়ে জড়িয়ে মা-খাব, বাবা-খাব, রব তুলে একেবারে অতিষ্ঠ করে মারতে লাগল। এর আগে মা ষষ্ঠীর দয়ায় মঞ্জুরির যত বিড়াল বাচ্চা হয়েছিল তাদের প্রত্যেকটিকে পাড়া প্রতিবেশীর ঘরে ঘরে তার স্মৃতি বহাল তবিয়তে গচ্ছিত করে রেখে এসেছিলেন ঠাম্মা। কাজেই বর্তমানে ওপথ বন্ধ। এখন এতগুলি বাচ্চা সহ সহস্র পুত্রের গর্ভধারিণীকে প্রতিপালন করতে হলে শুধু এদের জন্যেই প্রতি বছর তিন বিঘে জমি বেশি করে চাষ করতে হবে। শুধু তাই নয়, প্রতি ছয় মাস অন্তর সে যদি এমনি ধারাবাহিকতা বজাই রাখে তাহলে আমি হলফ করে বলতে পারি সে একাই দু বছর বাদে ভোটের আধিক্য হেতু ইন-ক্লাব, জিন্দা-বাদ করে আমাদেরকে বাড়ি থেকে উচ্ছেদ করে বেদখল করে নেবে। এ-তো শুধু গেল মঞ্জুরির কথা। তারপর কয়েকমাস বাদ দিয়েই তার কন্যারা আমাদের অজান্তেই জননী হয়ে সংসারের পরিধি এত বড়ো বাড়িয়ে দেবে যে সে সমস্যা সমাধান করতে নতুন সংবিধান রচনা করে পুষি-রাজ্যে পরিণত হবে! আবার তার কন্যারা … !! আবার তার কন্যারা… !! উঃ! ভাবা যাচ্ছে না! বাপরে বাপ! এতশত গণনা করতে গেলে স্বয়ং গণিতবিদও ফেল করবে বোধ হয়। তাই সবিশেষ বিবেচনা করে একদিন বাড়ির সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে মঞ্জুরি সহ সব বিড়াল বাচ্চাগুলিকে আগামীকাল শ্রীনগর যাবার পথে ছয়-সাত মাইল দূরে চটের থলিতে করে নিয়ে গিয়ে ছেড়ে দেওয়া হবে।
ঠাম্মা প্রথম প্রথম কিন্তু কিন্তু করলেও যখন দেখলেন যে ভোটে হেরে গিয়ে জামানত জব্দ হয়ে যাবে তখন নিরুপায় হয়ে, “তাই তবে কর,” বলে সায় দিলেন।
পরের দিন মেজদা শ্রীনগর যাবার পথে বাড়ি থেকে প্রায় আট মাইল দূরে ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় ছেড়ে দিয়ে এল। আমরা ঘরে বলাবলি করতে লাগলাম, “যাক বাঁচা গেল।” সারাক্ষণ যেন বিড়াল বাচ্চাগুলি মারছিল জ্বালিয়ে। কেবল দেখলাম ঠাম্মার হৃদয়ে যেন বিরাট পাথর চাপানো। বুঝলাম মঞ্জুরি সহ বিড়াল বাচ্চাগুলি শুধু যায়নি সঙ্গে ঠাম্মার মনটিকে কেড়ে নিয়ে গেছে। লুকিয়ে লুকিয়ে কাপড়ের খুঁট দিয়ে কতবার চোখের জল মুছতে দেখলাম। ঠাম্মার হৃদয়ে তারা কতখানি স্থান দখল করে নিয়েছিল তা আজ স্বচক্ষে দেখলাম। দেখলাম নির্বাসন দণ্ড শুধু মঞ্জুরি এবং তার বাচ্চাদের হয়নি, হয়েছে স্বয়ং আশ্রয়দাতারও। বুঝলাম, “দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে, সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।” অবশ্য মঞ্জুরি বা তার বাচ্চাদের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ সে তার বয়সের ধর্ম ও কর্ম পালন করেছিল মাত্র। কিন্তু বাচ্চারা! তারা কোন অপরাধে নির্বাসন দণ্ড পেল! জানি এ প্রশ্ন অর্বাচীন!
পরের দিন প্রত্যুষে ঠাম্মা ডাকতে লাগলেন, “খোকন দেখে যা, কে এসেছে!” ঠাম্মার ডাক শুনে আমি পাশ ফিরে শুলাম। তিনি আবার ডাকতে লাগলেন, “কই রে! শুনছিস! দেখে যা!” মনে মনে রাগান্বিত হৃদয়ে বললাম, “ওঃ! বুড়িটা জ্বালিয়ে মারল তো! বুড়ির কি রাত্রিবেলা একটু ঘুমও হয়নি! ভোরবেলা একটু ঘুমতে দেবে না!” আবার ডাক শুনে উঠতেই হল, বললাম, “ভোরবেলা ডাকছ কেন?” তিনি মিষ্টিমুখ করে, বিগলিত হয়ে অত্যন্ত প্রফুল্ল চিত্তে বললেন, “এখনও ভোর কী রে বাবা! সূর্য উঠল বলে, দেখবি আয়!” বলেই ঠাম্মাকে এগিয়ে রেখে তার পিছনে অনুসরণ করে রান্নাশালে গিয়ে দেখলাম মঞ্জুরি বিড়াল তপস্বী হয়ে তার এক পুত্র ও এক কন্যাকে নিয়ে উনুন ধারে চুপচাপ বসে আছে। আমি হতবাক হয়ে ঠাম্মার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি তিনি মুখে-চোখে হাসির ঝিলিক নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। আমি ঠাম্মার আঁচলে চোখ দুটিকে কচলে নিয়ে আরও একবার দেখে নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “মঞ্জুরি এল কী করে?” তিনি আমার প্রশ্ন শুনে আনন্দে বিগলিত হয়ে বললেন, “বাবা, ওরা মা ষষ্ঠী, সব বুঝতে পারে, সব জানতে পারে, যাওয়ার পথ ধরেই ফিরেছে!” আমি জিজ্ঞেস করলাম, “তাহলে, আর তিনটে বাচ্চা গেল কোথায়?” ঠাম্মা তেমনি মৃদু হেসে বললেন, “আসবে আসবে, সব আসবে!” তারপর একটু থেমে বললেন, “আমি জানতুম ওরা ফিরে আসবে।”
তার পরদিন আর একটি বাচ্চা ফিরে এসেছিল এবং তার পরদিন আর একটি। কিন্তু আর একটি বাচ্চার কোন হদিশ পাওয়া যায়নি। অবশ্য তার জন্যে ঠাম্মার মনে কোন ক্ষোভ দেখতে পায়নি। বোধ করি মা সমেত বাচ্চাদের আধারটি পেয়েই আনন্দে তাঁর মন পরিপূর্ণ হয়ে গিয়েছিল।
বছর দুয়েক পরের ঘটনা। আমি তখন কলকাতায় “সিটি কলেজ অফ কমার্স অ্যান্ড বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন” কলেজে ভর্তি হয়েছি। পুজোর ছুটিতে বাড়িতে গিয়ে দেখি মঞ্জুরি নতুন বাড়ির দোতলায় নতুন সংসার পেতে জাঁকিয়ে বসেছে। চারটি বাচ্চার কোনোটির মাথায় লম্বা একটি কালো দাগ, বাকিটা সাদা; কোনোটির পেটের দুদিকে দুটি সাদা দাগ, বাকিটা কালো; কোনোটির অর্ধেক সাদা, অর্ধেক কালো; কোনোটি পুরোটাই সাদা। তাদেরকে দেখে আমার চোখ জুড়িয়ে গেল।
সেদিন বিকেলবেলা লাইব্রেরীর উদ্দেশ্যে যাচ্ছিলাম। মাঝপথে দেখি সুনয়না বৌদি মুখটি হাঁড়ি করে খামারে লাতা দিচ্ছে। বোধ হয় সেদ্ধ ধান শুকতে দেওয়া হবে তারই চলছে প্রস্তুতি পর্ব। আমাকে একবার আড়চোখে দেখে নিয়েই পূর্ববৎ মুখটি হাঁড়ি করে রেখেই নির্বিঘ্নে কাজ করে যেতে লাগল। বুঝলাম, সুনয়না বৌদির মনে একটু আগে সাইক্লোন বয়ে গেছে। সাইক্লোন এখন আর নেই কিন্তু তার চাপ এত বেশি ছিল যে, সে চাপের ভারে তার মুখ নত হয়ে হাঁড়ির মতো দেখাচ্ছিল। অন্য সময় হলে সুনয়না বৌদি আমাকে দেখে মিষ্টি হেসে জিজ্ঞেস করত, “কি ঠাকুরপো! কখন এলে? কেমন ছিলে? কলকাতা কেমন লাগছে?” তারপর একথা সেকথার পর একেবারে মনের কথা জানার জন্যে উৎসুক হয়ে পড়ত। আমি মনে মনে বললাম, “থামো, সুনয়না বৌদি, তোমার মুখ হাঁড়ি করে রাখা বের করছি!” মনে মনে একটু চিন্তা করে নিলাম যে, কীভাবে কথা আরম্ভ করা যাবে! হঠাৎ মনে পড়ে গেল যে, সে তখন পঞ্চায়েত থেকে ‘শি এইচ ভি’-র ট্রেনিং নিয়ে বসে আছে। কথা বলার একটি মারাত্মক অস্ত্র খুঁজে পেয়ে আর নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। জিজ্ঞেস করলাম,
— বৌদি তোমার ‘শি এইচ ভি’-র ট্রেনিং আছে না?
সুনয়না বৌদি তেমনি মুখটি হাঁড়ি করে উত্তর দিল, হ্যাঁ, কেন?
— তুমি কেস পিছু সবাইকে কত করে দাও?
— ছয় টাকা।
— আমি যদি তোমাকে কয়েকটি কেস দিই তাহলে আমাকে কত করে দেবে?
— বৌদি তেমনি শান্ত অথচ দৃঢ় কণ্ঠে বলল, সবাইকে যা দিই, তোমাকেও তাই দেব।
— আমিও নরম সুরে বললাম, তাহলে আর হল না। অন্য জায়গায় দেখতে হবে, বলে পা বাড়াতে উদ্যত, এমন সময় বৌদির ডাক শুনতে পেলাম।
— শোনো!
বোধ করি কয়েকটি কেস তার যেমন হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে তেমনি বেশকিছু টাকাও হাতছাড়া হয়ে যাবে। লোভের বশবর্তী হয়েই বোধ হয় আমায় ডাকল! আমি তার কাছে গিয়ে হাজির হলাম।
সে আবার মৃদু হেসে বলল, এতগুলি কেস তুমি কি কলকাতা থেকে নিয়ে এলে না-কি, ঠাকুরপো?
আমি স্বভাবসিদ্ধ ভঙ্গিতে বললাম, তা জেনে তোমার দরকার কী? তোমার অপারেশন করা নিয়ে কাজ!
সে এবার নরম হয়ে বলল, তা বটে, তবে তুমি যখন বলছ তোমাকে কেস পিছু সাড়ে ছয় টাকা করে দেব।
আমি আর একবার যাচিয়ে দেখে নেবার জন্যে জিজ্ঞেস করলাম, ঠিক বলছ?
বৌদি তেমনি ঘাড় নেড়ে সায় দিয়ে বলল, হ্যাঁ, ঠিক বলছি।
আমি আর দ্বিরুক্তি না করে, কথা না বাড়িয়ে একেবারে আসল কথা বললাম, দেখ বৌদি, আমাদের মঞ্জুরি নামে বিড়ালটি আর তার চারটি বাচ্চাকে অপারেশন করে দিলে অন্ততঃ বিড়াল জন্ম-নিয়ন্ত্রণটি অকেজো হলে আমরা বেঁচে যায়! সে যে হারে সহস্র পুত্রকন্যার জননী হচ্ছে তাতে আর কয়েকদিন বাদেই আমাদেরকে বাস্তু থেকে উচ্ছেদ করে দেবে। তুমি আমাদেরকে তার হাত থেকে বাঁচাও। আমাদের মঞ্জুরি কবেই মহাভারতের গান্ধারীকে পিছনে ফেলে …
— চুপ করো! একেবারে বৌদির কড়া ধমক খেয়ে দেখি, বৌদিরই আদেশ বার্তা। তারপর একটা লম্বা লাঠি নিয়ে বলল, তোমায় দেখাচ্ছি মজা, বলে আমার দিকে উদ্যত হতেই আমি মারলাম টেনে দৌড়! ওটা আমি ভালই পারি। ফুটবল খেলতাম তো!
সন্ধেবেলা হ্যারিকেনের আলোয় বই নিয়ে পড়তে বসেছি এমন সময় ঠাম্মা লণ্ঠন হাতে ফোগলা মুখে হাসতে হাসতে আমাকে সরাসরি জিজ্ঞেস করলেন, “হ্যাঁ রে খোকন! তোর সুনয়না বৌদিকে কী বলেছিস রে?” বুঝলাম পাড়া মাত হয়ে গেছে। ঠাম্মা তেমনি মিষ্টি হেসে বললেন, “এত দুষ্টু বুদ্ধি তোর মাথায় আসে কী করে?”
পরের দিন লাইব্রেরী যাবার সময় দেখি আশে পাশে, সামনে পিছনে জোড়া জোড়া দুষ্টু মিষ্টি চোখের চাহনি ও হাসির ঝিলিক আমার সারা মুখমণ্ডলে সেঁটে বসে আছে। বুঝলাম ঐ কথাটি নিয়ে ঢাকঢোল বেশ ভালোই পেটানো হয়েছে।
বিড়াল বাচ্চাগুলি সহ মঞ্জুরির উপদ্রব এত বেশি বেড়ে গিয়েছিল যে উঠতে, বসতে, খেতে, শুতে সবসময় তারা নাজেহাল করে মারছিল। কাজেই ঠাম্মা ছাড়া বাকি সবারই মন ভরে উঠেছিল বিতৃষ্ণায়। তারা যে কখনও ইঁদুর ধরত না তা নয়, কষ্ট করে ইঁদুর ধরে মেরে খাওয়ার পরিবর্তে স্বচ্ছন্দে দুধ-ভাত খাওয়ার প্রবণতা বেশি থাকায় বোধ করি তাদের ইঁদুর ধরার প্রবণতা কমে গিয়েছিল; অধিকন্তু এতগুলি বিড়াল থাকা স্বত্বেও ধেড়ে ইঁদুর, নেংটি ইঁদুর স্বচ্ছন্দে এবং অনায়াসেই ধানের বস্তা, চালের বস্তা, গমের বস্তা কেটে নিজেদের গুদাম ভরাট করার ফলে বিড়ালগুলির প্রতি বেড়ে গিয়েছিল বিদ্বেষের মাত্রা। তাই একদিন সকলে মিলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হল যে এবারে মঞ্জুরিসহ সব বিড়াল বাচ্চাগুলিকে দু-মোহনা নদীর ওপারে ছেড়ে দিয়ে আসতে হবে; তাহলে ওরা আর কোনোদিন এত বড়ো নদী পেরিয়ে ফিরে আসতে পারবে না।
তাই করা হয়েছিল। ঠাম্মার মন সেই ভারাক্রান্ত। গোপনে চোখের জল মোছা, অল্প খাওয়া, দীর্ঘনিশ্বাস ফেলা, খেতে বসে ভুলবশত মঞ্জরীকে ডেকে ফেলে নিজেই লজ্জা পাওয়া, তারপর কোনরকমে অল্প গলাধঃকরণ করে ওঠে পড়া।
এতগুলি বিড়াল যে সারা সংসারটা ভরাট করে রেখেছিল তা সেদিন টের পেলাম। বিড়াল বাচ্চাগুলির অভাবে সারা সংসারটা কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগছিল। তারা উড়ে এসে জুড়ে বসেও সংসারের মাঝে তথা মনের মধ্যে এতখানি জায়গা করে নিয়েছিল যে মাত্র একদিনের ব্যবধানেই তা টের পাওয়া গেল। পরক্ষণেই যখন চিন্তা করলাম যে তারা এখন কোথায় আছে! কী করছে! যদি কুকুর ধাওয়া করে! মনে করেই সারা সর্বাঙ্গে কাঁটা দিয়ে উঠল।
দিন পনেরো কেটে গেছে। মঞ্জুরি ও তার বাচ্চাগুলির স্মৃতি ঝাপসা হয়ে আসছিল। কিন্তু বাধ সাধলো বল খেলতে গিয়ে গড়বেতায়। সে এক রোমাঞ্চকর দিন!
দু-মোহনা নদী পেরিয়ে বল খেলতে যেতে হত গড়বেতায়। দু-মোহনা নদীর এপারে দাঁড়িয়ে দেখলাম নদী তার ভরা যৌবনে উন্মত্ত-প্রায় হয়ে কুলু কুলু শব্দে দুরন্ত গতিতে ছুটে চলেছে সাগর সঙ্গমে মিলনের আশায়। মনে মনে প্রশ্ন করলাম যে এই জলের প্রচণ্ড স্রোতের মুখে যদি কেউ পড়ে তাহলে তার কি আর রক্ষা আছে? চেয়ে দেখলাম যে মাঝিরা যাত্রী নিয়ে নৌকায় করে আসছে মাঝ-নদীতে। এই দু-মোহনা নদীটি প্রায় এক মাইলের ওপর চওড়া। কাজেই আসতে ও যেতে বেশ সময় লাগে, কারণ নৌকা চলাচল করে মাত্র দুখানি।
নৌকা থেকে ওপারে নেমে রাস্তায় ওঠে সাইকেলে চাপতে যাব এমন সময় সেই সুপরিচিত মিউ মিউ ডাক শুনতে পেলাম। বল খেলতে যাবার তাড়নায় প্রথমে শব্দটা অবজ্ঞা করে এক কান দিয়ে ঢুকিয়ে অন্য কান দিয়ে বের করে আবার সাইকেলে চাপতে যাব দেখি কঙ্কালসার মঞ্জুরি একেবারে আমার সামনে মিউ মিউ করে ডেকে চলেছে। তার সেই কঙ্কালসার খাঁচাটি দেখে আমি হতবাক হয়ে বললাম, “মঞ্জুরি, এ কী দশা হয়েছে তোর!” আমার মুখ থেকে তার নাম শুনে সে ছুটে এসে প্রথমে আমার দুপায়ের ওপর সে মাথা রেখে মিউ মিউ করে ডেকে যেতে লাগল, যেন সে বলতে লাগল, “আমায় ক্ষমা করে দাও।” তারপর এক সময় লেজ নাড়তে নাড়তে জিভ দিয়ে চাটতে লাগল আমার পা এবং আমার দুপায়ের মধ্যে বেড় দিয়ে ঘুরতে লাগল। আমি হতবাক হয়ে তার দিকে তাকিয়ে দেখতে লাগলাম তার ক্রিয়াকলাপ। এমন সময় একটি কুকুর আসতেই সে পিছনের গাছে ওঠে গেল।
আমার দলের যারা সঙ্গী ছিল তারা কতদূর গিয়েছিল জানি না। কিছুক্ষণ বাদে তাদের মধ্যে দুজন ফিরে এসে জিজ্ঞেস করল, “কি রে! এখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কি করছিস?” বললাম, “কিছু না!” তারপর বলল, “তাড়াতাড়ি চল, সময় নেই বেশি।”
যাবার উপক্রম করতেই মঞ্জুরি আবার মিউ মিউ ডাক দিয়ে আমার মন কেড়ে নিল। কিন্তু সে আর কাছে আসতে পারল না কারণ কুকুরটি দারোয়ানের ন্যায় দণ্ডায়মান গাছের তলায়।
অগত্যা তাকে ফেলে রেখেই বল খেলতে গেলাম গড়বেতায়। বল যে কী খেলেছি তা আমি নিজেও জানি না। সব সময় মনে হচ্ছিল যেন মঞ্জুরি আমার মনটিকে টেনে ধরে রেখেছে! খেলার শেষে বাড়ি ফিরতে উদ্যত হলাম।
মঞ্জুরি আমার আসার অপেক্ষাতেই ছিল। কুকুরটি বোধ হয় খানিকক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে যখন বুঝতে পেরেছিল যে ‘আঙ্গুর ফল টক’ তখন পালিয়েছে। আমাকে দেখেই সে আবার মিউ মিউ চিৎকার করতে করতে একেবারে আমার কাছে এসে হাজির হল। তার মিউ মিউ ডাকের যে অবোধ ভাষা আমার মতো নির্বোধের পক্ষে বোঝা কঠিন; কিন্তু এই মুহূর্তে সে যে আমাকে বলতে চায়, “আমি আর কোনো অন্যায় করব না, তুমি শুধু আমাকে ক্ষমা করে তোমাদের বাড়ি নিয়ে চল।” তার বাড়িতে আসার কী করুণ মিনতি, কী কাতর আবেদন, কী সনির্বন্ধ অনুরোধ, সর্বোপরি আমার পায়ের ওপর মাথা রেখে কী সবিনয় প্রার্থনা! আমি রক্তমাংসের শরীর হয়ে অমান্য করি কী করে!
আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে তাকে কোলে তুলে নিয়ে তার গায়ে মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বললাম, “দেখ, আমার একার কোনো ক্ষমতায় নেই মঞ্জুরি, তুই বরং এখানেই থাক! বাড়িতে গিয়ে সমস্ত বিবরণ শোনাবার পর যদি বাড়ির লোক অনুমতি দেয় তাহলে কালকেই তোকে আমি নিয়ে যাব।” বলে তাকে ছেড়ে দিলাম।
নৌকা আমার জন্যেই অপেক্ষা করছিল। তাড়াতাড়ি করে আমি নৌকাতে পা দিতেই মাঝি নোঙর তুলে ছেড়ে দিল নৌকা। আমি মঞ্জুরিকে না নিয়ে চলে যাচ্ছি দেখে সে আবার মিউ মিউ করে ডেকে একেবারে জলের ধারে এসে নৌকাতে যাবার জন্যে দিল লম্বা লাফ। নৌকা তখন তার নাগালের বাইরে। কাজেই সশরীরে সে প্রচণ্ড স্রোতের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। উন্মত্ত কল্লোলিনী শিলাবতী তাকে খড়কুটোর মতো ডুবিয়ে সলিল সমাধি করে দিল এক ঘূর্ণিপাকে। যেন বলে গেল, “আমার এত কাতর প্রার্থনা যখন তোমার সুহৃদয়ে ও কর্ণকুহরে প্রবেশ করল না তখন আমি আর এ জীবন কাউকে দেখাতে চাই না।” আর আমি কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে বিহ্বল দৃষ্টিতে স্বার্থপরের মতো অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ক্ষমা প্রার্থনা করে বললাম, “মঞ্জুরি, এ তুই কী করলি! আমায় ক্ষমা করে দিস মঞ্জুরি, আমায় ক্ষমা করে দিস,” বলে নিঃশব্দে তার অজানা অন্তিম যাত্রাপথের দিকে তাকিয়ে রইলাম।