কালুদা – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

কালুদা – ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

কালুদা           (ছোটোগল্প)

ডঃ নিতাই ভট্টাচার্য্য

“এতো কথা ডাক্তারের সঙ্গে বললে আর আমার কি হয়েছে সেটা ডাক্তার বাবুর কথা শুনে বুঝতে পারলে না! রিপোর্ট দেখলে কম্পিউটারে, মাথা দোলালে, ইয়েস, সিওর কতো কথাই তো বললে আর এখন বলছ সব কথা বুঝতে পারিনি! চালাকি রাখো।” চেম্বার থেকে বের হয়েই চ্যাটাং চ্যাটাং করে আমাকে শুনিয়ে দিলো কালুদা। ওয়েটিং রুমের চার দেওয়ালে ধাক্কা খেয়ে গমগম করে উঠলো কালুদার কথাগুলো। আর সবার নজর ঘিরে ধরলো আমাদের। বিভিন্ন রোগের হাজারো রোগী। প্রত্যেকেই উৎকণ্ঠা নিয়ে প্রতীক্ষায় আছে এই বুঝি নিজের নাম জায়ান্ট স্ক্রীনে ফুটে উঠবে সঙ্গে নির্দিষ্ট রুম নম্বর। পাশাপাশি গোটা পনেরো ঘর। জেনারেল ফিজিশিয়ান, অর্থোপেডিক্স, চেষ্টমেডিসিন, নেফ্রোলজি, ইউরোলজি, ওঙ্কলজি আরো বিভিন্ন বিভাগের ডাক্তার একই ছাদের তলায়। সারি সারি সুদৃশ্য চেয়ার সাজানো আছে রোগীদের কথা ভেবে। প্রচুর লোকজন রয়েছে বসে। এই মুহূর্তে প্রায় সকলের দৃষ্টি আমাদের দিকে।
এমনিতে আমাকে তুই-তুকারি করেই কথা বলে কালুদা। তবে রেগে গেলে সম্বোধন পাল্টে যায় তখন “তুমি” বা “আপনি” বলে। এই মুহূর্তে আমাকে ‘”তুমি” বলার কারণ বিষয় বেশ ভাব গম্ভীর। কোন রোগ বাসা বেঁধেছে কালুদার শরীরে জানতে উদগ্রীব কালুদা। কয়েক মিনিট আগে ডাক্তার বাবুর সঙ্গে আমার যেটুকু কথা হয়েছে সবটাই ইংরেজিতে। কালুদার কান অভ্যস্ত নয় সে সব কথা শুনতে। তাই ডাক্তার বাবু আর আমার কথোপকথন প্রায় সবটাই না বুঝে বাউন্সার খেয়েছে কালুদা। দু চারটে শব্দের অর্থ হয়তো বুঝেছে, তাতে মনে ভীতির সঞ্চার হয়েছে ঠিকই তবে পরিষ্কার হয়নি শরীরে রোগটা আসলে কি। বা কি কি। “…ওই সব ঝুটা বাত আমাকে বলতে এসো না।” বলেই চলেছে কালুদা। ভাবীদিনের দুর্ভাবনা ততক্ষণে নিঃশব্দে থাবা বসিয়েছে আমার মনে। মন নেই আমার কালুদার কথায়। তবুও পাঁচজনের সামনে দৃশ্যটা অস্বস্তিকর হয়ে উঠছে ক্রমে। বাধ্য হয়ে বলি, “সিন ক্রিয়েট করো না। তোমার সমস্যাটা ঠিক কি আমি বুঝিনি। সবই তো মেডিক্যাল সাইন্স এর কথা। আমি কি ডাক্তার! আর একটু পরেই তো সব রিপোর্ট হাতে আসবে, তখন না হয় গুগল করে বোঝার চেষ্টা করবো।” হসপিটালের নিয়ম এমনই। যেকোন টেস্টের রিপোর্ট প্রথম দেখবেন ডাক্তার বাবু। পরে সেইগুলো বুঝিয়ে দেবেন পেশেন্ট বা পেশেন্টের সঙ্গে থাকা সঙ্গীকে। এইমাত্র ডাক্তার বাবু কথা বলেছেন, রিপোর্টস হাতে পেতে মিনিট তিরিশ চল্লিশ সময় লাগে। রোগী তো শুধু কালুদা একা নয় আরো অনেকেই আছে। “চলো মুখে কিছু দিয়ে আসি তারপর না হয় …।” আমার কথা পাত্তা না দিয়েই বলে, “এই কয় দিনে আপনার অমন কথা অনেক শুনেছি, আর নয়। আগে বলুন সবটা। নয়তো নো খাওয়া। নট কিছু। আমি কোথাও যাবো না।” দুটো চেয়ারে বসেছি পাশাপাশি। কালুদা গজ গজ করেই চলেছে। মনে আমার দুশ্চিন্তার প্রবাহ চলেছে। আর কলুদার নন স্টপ বকর বকর। তাই বাধ্য হয়েই বলি, “ওহ, থামবে তুমি।” ভাবান্তর নেই কোনো কালুদার। শুধু গলাটা নামিয়ে বলে, “নিজের হলে বুঝতে ভাই। টেনশন কেয়া চিস হ্যায়।”
রোগ বালাইয়ে কালুদার দারুণ ভয়। সামান্য জ্বর হলেই ব্যস্ত করে তোলে আমার মাকে। দশ মিনিট অন্তর হাঁক পাড়বে নিজের ঘর থেকে, “মামিমা…।” আর হাতের সমস্ত কাজ ফেলে রেখে মা ছুটে এসে কালুদার বগলে থার্মোমিটার লাগিয়ে দিয়ে বসে থাকে পাশে। বসে থাকে মানে বাধ্য হয় বসে থাকতে। সাড়ে চার মিনিট শরীরের সংস্পর্শ না পেলে থার্মোমিটার নাকি সঠিক পাঠ দেয় না। কালুদার এই কথা কেটে আমার মায়ের সাধ্য কি অন্য কাজে মন দেয়। মাঝে মাঝে বিরক্ত হয় মা। বলে, “তোর মামাকে বলছি থার্মোমিটারটাকে তোর বগলে বেঁধে দিক। ওটা তোর সঙ্গেই থাক। তাহলে আর ঘন ঘন কাজ ফেলে আসতে হবে না আমাকে। সকাল থেকে আমার কি আর কাজ নেই? একটু পরেই তো বলবি ভাত দাও মামিমা, স্কুলে যেতে দেরি হয়ে যাবে। ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে গুলো এসে দাঁড়িয়ে থাকবে, তখন!” শুনে কালুদা হাসে। বলে “বেশ, যাও তোমাকে দেখতে হবে না কিছু। আমার যা হয় হোক।” অভিমান তার মামিমার উপর। তখন মান ভাঙাতে আরো কত কাণ্ড করে আমার মা।
“বল না ভাই কি বললো ডাক্তার?” এইবার কালুদার গলায় অনুরোধের সুর। দু হাত জড়ো করে ধরে রেখেছে প্রণাম মুদ্রা, আমার উদ্দেশ্যে। বলি, “লোকে দেখছে। কি যে করো! এতদিন ধৈর্য ধরে থাকলে আর কয়েকটা মিনিট পারছো না!” কে শোনে কার কথা! “দেখ ভুতো কে দেখলো, কে কি বললো আই ডোন্ট কেয়ার। রোগ আমার, কষ্ট আমার, জানতে চাইছি আমি। আমার বয়েই গেলো পাবলিক কেয়া সোচেগা।” অন্য দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো কালুদা। আমার উপর রাগের বহিঃপ্রকাশ। আমি ভাবলাম থাক, রাগ করে যদি চুপ থাকে তাতেও শান্তি। আমার মন মেজাজও ভালো নেই। এই কয়দিন রোগীর সঙ্গে থেকে হাঁপিয়ে উঠেছি। “তোমার আর কি! নিজে যদি কষ্ট পেতে বুঝতে তার জ্বালা।” আমার দিকে মুখ ঘুরিয়ে পটাং করে বলে দিলো আবার। কথাটা নাড়া দিয়ে গেলো আমার মনে। হঠাৎ করেই এক তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম ভিতরে ভিতরের। বলার মতো কথা খুঁজে পেলাম না সেই মুহূর্তে। ঠিকই তো, যন্ত্রণা তো কম নয় কালুদার।
আমার বাবার পিসতুতো বোনের ছেলে কালুদা। জন্মাবধি আমাদের বাড়িতেই মানুষ। সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পর পরই আমার বাবার সেই পিসতুতো বোন পাড়ি দিয়েছে পরপারে। তারপর থেকে কালুদা রয়েছে তার মামা আর মামীর ঘরে। জীবনের ইহকাল পরকাল সবই তার মামিমা। বয়স পঁয়তাল্লিশ ছুঁই ছুঁই কালুদা অকৃতদার। এ জীবনে দার পরিগ্রহণের ইচ্ছে মুলতুবি রেখেছে। “কিছু মনে করিসনে ভুতো, রাগের মাথায় বলে ফেলেছি। উচিত হয়নি ভাই তোকে অমন কথা বলা।” আমার দুহাত নিজের হাতের মুঠোয় ধরে কাতর কণ্ঠে বলে কালুদা। আমি ডুবে ছিলাম দুশ্চিন্তায়। হঠাৎ কেনো এমন আচরণ, বুঝিনি। কিই বা তার অর্থ! জিজ্ঞাসা করি, “কোন কথা?” “ওই যে বললাম তোর এমন যন্ত্রণা হলে…।” কালুদা এই রকম মানুষ। রাগের মাথায় কি বলেছে আবার পরক্ষণেই দুঃখ প্রকাশ করছে সে কথা নিয়ে।
কিছুদিন ধরেই একটা যন্ত্রণা বেশ বেগ দিচ্ছিলো কালুদাকে। হাঁটতে গেলেই সমস্যা। ডান পায়ের কুঁচকির কাছে বেশ ব্যথা পাচ্ছে। আমাকে দেখিয়ে ছিলো একদিন। তাও মাস চারেক আগের কথা। দেখি ছোট্ট টিউমারের মতো হয়েছে। সেটা ছাড়াও কপালের ডান পাশে ওই একই রকম দেখতে আরো দুটি মাংস পিণ্ড উঁচু হয়ে উঠেছে। ঘাড়ের পাশে আরো একটা। সেই অর্থে কোনো ব্যথা যন্ত্রণা ছিলো না তখন। তবে অশান্তির কারণ কপালের মাংস পিণ্ড দুটি। প্রাতভ্রমণের সঙ্গীরা নানা ঠাট্টা করে সে দুটিকে নিয়ে। তাই ইদানীং মাথায় টুপি চাপিয়ে বাড়ির বাইরে বের হয় কালুদা। তখনই ডাক্তার দেখানোর পরামর্শ দিয়েছিলাম আমি। সে কথা বলতেই রেগে টং। বলে, “তোদের শুধু কথায় কথায় ডাক্তার আর ডাক্তার। আই অ্যাম স্পোর্টস ম্যান। মনের জোরই আসল। কিসের ডাক্তার?” তারপর দেখি কালুদার প্রাতভ্রমণ সঙ্গী তপনদার কথা শুনে লাউ আর লবঙ্গ খাচ্ছে সাত সকালে। দিন চলছিল এইভাবেই। কাজের চাপে আমিও চলেছি আমার মতো। তারপর একদিন সকালে তুমুল যন্ত্রণা কালুদার ডান পায়ে। প্রাতভ্রমণ থেকে বাড়ি ফিরেই সটান বিছানায়। অন্যদিন লাউয়ের রস খেয়ে পাক্কা পঁয়তাল্লিশ মিনিট ইউ টিউব দেখে প্রাণায়াম চলে। আজ মাথায় উঠেছে প্রাণায়াম। আমার মা ঘুম থেকে তুলে দিয়ে বলে, “কালু খুব কষ্ট পাচ্ছে ভুতো, একটা কিছু কর।” গিয়ে দেখি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে কালুদা। “এই বুড়ো বয়সে ছুটতে কে বলে তোমাকে! অলিম্পিকে যাবে?” আমার কথা শুনে রেগে ওঠে আমার মা। “তোর বাপু শরীরে দয়ামায়া নেই। দেখছিস ছটপট করছে ছেলেটা, তুই এসেছিস এখন ভাষণ দিতে। যা, আমি দেখছি। তোকে কিছু করতে হবে না।” শেষমেশ আমিই বরফ সেঁক দিতে বসলাম। মা বসে কালুদার পাশে। দু চোখ ছলছলে। কালুর জ্বালা যন্ত্রণায় বড্ড কষ্ট পায় আমার মা। কালুদার গায়ে হাত রেখে আস্তে আস্তে বলে, “তোকে একটা কথা বলি কালু। ওই সব দৌড় ঝাঁপ এইবার ছাড়। লাউ, কুমড়ো খেয়ে যদি রোগ ভালো হতো তাহলে ডাক্তার গুলো সবজি বিক্রি করতো। আজ আর স্কুলে যেতে হবে না। ডাক্তারের কাছে যা। কে জানে কি থেকে কি হয়! বাবা ধর্মরাজ রক্ষা করুন।” ডাক্তারের নাম শুনলেই বুক কাঁপে কালুদার। এদিকে মামিমা বলেছে। পাশ কাটানো মুস্কিল। বলে, ” আমি স্পোর্টস ম্যান, মনের জোর হলো আসল ওষুধ মামিমা। মনে জোর ধরো। কিচ্ছু হবে না আমার। তাছাড়া আজ স্কুলে না গেলে বাচ্ছা গুলো মিড ডে মিলের চাল পাবে না, যেতেই হবে…।” ঐ দিন বিকালে অফিস থেকে ফিরে দেখি বিছানা নিয়েছে কালুদা। সঙ্গে প্রবল জ্বর। মা থার্মোমিটার নিয়ে বসে। আমি সামনে আসতেই কালুদা বলে, “তেমন কিছু নয়রে ভুতো, চিন্তা করিসনে। মামিমা বললো বিশ্রাম নে তাই…।” জোর করে নিয়ে গেলাম জেনারেল ফিজিশিয়ানের কাছে। সব দেখে ডাক্তার বললো ওষুধ যা দিচ্ছি ব্যথা, জ্বর দুই কমবে তবে ভালো সার্জেন দেখিয়ে অপারেশন করিয়ে নেওয়াই ভালো। টিউমার তো…। তারপরই কালুদাকে সঙ্গে নিয়ে ব্যাঙ্গালোর আসা। পর পর বেশ কয়দিন ধরে নানান টেস্ট হয়েছে। একদিন রেগে বলে, “শরীরের সব রক্ত দিয়ে দিলেও এদের টেস্ট শেষ হবে না। সব পয়সা নেবার তাল। আর তুম ভি এক গাধা হো।” দিন চারেক আগে বায়োপসি হয়েছে কুঁচকির কাছের টিউমার থেকে সেল নিয়ে। ডাক্তার বাবুর পরামর্শ অনুযায়ী পেট সিটি স্ক্যানও করানো হয়েছে। ব্লাড টেস্ট পর্যন্ত সব ঠিকই ছিলো। গণ্ডগোল বাঁধলো বায়োপসি নিয়ে। সে হাজার হাজার প্রশ্ন আমাকে আগের রাতে। “কি এমন ব্যাপার! বায়োপসি করতে হচ্ছে? ছোট্ট টিউমার। আমাদের শক্তিগর হসপিটালে গেলেই কেটে ছুলে সাফ করে দিত। শুধু শুধু মানুষকে হয়রানির মধ্যে ফেলা।” সারা রাত বলেই যায় তার ক্ষোভের কথা। আমি যতো বলি, “এইসব পার্ট অফ ট্রিটমেন্ট। করতেই হয়।” কালুদা বলে, “সব ঠিকই আছে মেনে নিলাম কিন্তু বায়োপসি করে তো…।” “কেনো ভাবছো মিছিমিছি। তোমার তেমন কিছু নয়।” বলি আমি। “ঠিক বলছিস?” জিজ্ঞাসা করে আমায়। বলি, “বিশ্বাস হচ্ছে না! বেশ। নিজেই নিজের ভালো মন্দ নিজেই বুঝে নিও এইবার।” “রাগ করিসনে ভুতো, বিশ্বাস হচ্ছে। এই দেখ ধর্মরাজের দিব্যি।” সে রাতের মত শান্ত হলো কালুদা। সকালে উঠে আবার সেই এক কথা। ফোন করে আমার মাকে। বলে, “মামিমা বাঁচবো না গো, শরীরের মাংস কেটে নিয়ে বায়োপসি হবে…।” ততদিনে আমার মায়ের দুশ্চিন্তাও লাগাম ছাড়া। কালুর জন্য উতলা হয়ে উঠেছে ভীষণ। একটানা এতদিন কালুকে ছেড়ে কোথাও কখনো থাকেনি। জিজ্ঞাসা করে আমাকে, “সত্যি কথা বলতো ভুতো, ওর রোগটা কি?” মা কেও বোঝালাম সব টেস্ট না হলে কি করে বোঝা যাবে মা! মায়ের গলায় দুশ্চিন্তার সুর। বলে, “বাবা ধর্মরাজ রক্ষা করুন আমার কালুকে।” ফোনের ওই প্রান্তে আমার মায়ের চোখের জল আমি মানস চোখে প্রত্যক্ষ করতে পারি এতো দুর থেকে। মিটলো বায়োপসি পর্ব। পরদিন পেট সিটি স্ক্যানও করানো হোলো। সেই দিনও সারাক্ষণ গজ গজ করেছে কালুদা। বলে, “সব ব্যবসাদার। শুধু পয়সা নেবার ফিকির। সামান্য একটা ব্যাপার! আমাদের শক্তিগর হসপিটালে গেলেই মিটে যেতো। তোদের দেখছি মনের জোরটাই নেই।”
সমস্ত রিপোর্ট আজ পাওয়া যাবে। দুপুর দুটোর সময় অ্যাপয়েন্টমেন্ট আছে ডাক্তারের সঙ্গে। খুব ভোরে ফোন করেছিলো আমার মা। বলে, “কালু কেমন আছে ভুতো? মনটা খুব খারাপ জানিস। আজ চৈত্র সংক্রান্তি। আজকের দিনটিতে ওই তো আমার সঙ্গে থাকে।” বাবা ধর্মরাজের পুজোর জোগাড়ে মায়ের সঙ্গে হাত লাগায় কালুদা। আজ কাছে নেই, তাই অস্থির আমার মা। “কি করছে কালু?” কান্নায় ধরে এসেছে মায়ের গলা। গতকাল রাতে যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারছিলো না কালুদা। শেষমেশ ঘুমের ওষুধ দিয়েছিলাম। তারই রেস। বললাম, “ঘুমাচ্ছে।” “শোন ভুতো, পুরোহিতকে বলেছি সকাল সকাল ধর্মরাজের পুজো করতে। পুজো হলে পর তবেই হসপিটালে যাস। সব ভালোয় ভালোয় মিটে যাবে দেখিস।” মাকে নিশ্চিন্ত করলাম, “বেশ, তাই হবে।” মামিমার নির্দেশ পৌঁছে দিয়েছিলাম কালুদার কানে। দুহাত কপালে ঠেকিয়ে হাজার মাইল দূরে থাকা ধর্মরাজের উদ্দেশ্যে প্রণাম ভাসিয়ে দিয়ে চেম্বারে ঢুকেছিলো কালুদা। তার মামিমার আদেশ, সে তো বেদবাক্য। সমস্ত রিপোর্টস ডাক্তার বাবু দেখেছে। আমাকেও বোঝানোর চেষ্টা করেছে। ‘লিম্ফোমা’ আক্রান্ত কালুদা। গ্রেড থ্রি। বেশ ভয়াবহ ব্যপার। তারই কারণে অতো টিউমার দেখা দিয়েছে। শুধু দেহের বাইরে নয় লিভারেও একাধিক টিউমার। সেগুলির অবস্থা আরো ভয়ঙ্কর। ডাক্তার বাবুর কথা বুঝেছি সবই। কিন্তু বলবো কি করে কালুদাকে! তুমুল যন্ত্রণা অনুভব করছি কালুদার কথা ভেবে। বুক ফেটে কান্না আসছে আমার, গলা টিপে থামিয়ে রেখেছি নিজেকে। বলি, “তুমি বসো, আমি ওয়াশ রুম থেকে আসছি।” কালুদার কাছ থেকে উঠে এসেছি আমি। দুই পা ভারী হয়ে এসেছে এইবার। দূর্ভাবনার কালো মেঘ জমেছে মনে। সময় যেনো ভাবীকাল থেকে কালুদার জরাজীর্ণ কঙ্কালসার চেহারা হাজির করেছে আমার সামনে। ওয়াশ রুমের আয়নায় সেই সব অনাগত চিত্র প্রত্যক্ষ করছিলাম আমি। নিজেকে সংযত রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করছি। ফিরে এসে দেখি সমস্ত রিপোর্ট এর প্রিন্ট দিয়ে গেছে কালুদার হাতে। কালুদার দু চোখ নিথর হয়ে রয়েছে মোবাইলের স্ক্রিনে। লিম্ফোমার অর্থ খুঁজে পেয়েছে গুগল থেকে। জেনেছে গ্রেড থ্রি আসলে কি বোঝায়। সে মারক রোগের মারাত্বক বিষ ছড়িয়েছে তার শরীরের সর্বত্র। মোবাইলের স্ক্রীন থেকে চোখ তোলে কালুদা। চেয়ে আছে আমার দিকে। দূর্বোধ্য সেই চাউনির ভাষা। জগতের সমুদয় অসহায়তা ছেয়ে এসেছে আমার মনে। “ভেঙে পড়িস নে ভুতো। সব ঠিক হয়ে যাবে। মনের জোরটা হারাসনে।” বেজে উঠেছে আমার ফোন। আমার মা, কালুর খবর নেবে। কালুদা বলে, “মামিমাকে তুই কিছু বলিস নে ভুতো, বুঝিয়ে বলছি আমি।” আমার ফোন নিজের হাতে নেয় কালুদা। “হ্যালো, মামিমা কালু বলছি। এদিকের সব খবর ভালো। কাজ মিটেছে আমাদের। কালই রওনা দেবে এখান থেকে।” ওই প্রান্তে আমার মা। কালুদার কথা শুনে শান্তি পেয়েছে। হয়তো বলছে সবই ধর্মরাজের কৃপা, সাবধানে থাকিস বাবা। মামিমা কষ্ট পাবে তাই…। কালুদার থেকে মুখ ফিরিয়ে রেখেছি আমি জোর করে। নির্বোধ দৃষ্টি আমার হেঁটে চলে জায়ান্ট স্ক্রিনের বুকে। আমার ডান হাতটা নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরেছে কালুদা। বলে, “ভেঙে পড়িসনে ভুতো। জীবনে ঝড় ঝাপটা আসে। মন শক্ত না রাখলে চলবে কেনো। বি লাইক এ স্পোর্টস ম্যান।” বিস্ময়াবিষ্ট আমি। এ কোন কলুদা! সামান্য জ্বরে যে মানুষ আমার মাকে অতিষ্ঠ করে তোলে, শরীরে সূচ বেঁধার আগেই যন্ত্রণায় কাতর হয়ে ওঠে, জীবন মৃত্যুর দৃশ্যমান সীমানায় দাঁড়িয়ে সেই মানুষ বদলে গেলো কি করে! গতকাল বিকেলে বাড়ি ফিরেছি। দুই দিনের ট্রেন জার্নি, সাত সকালে উঠে অফিস যাবার মত ইচ্ছে নেই আজ। বিছানায় শুয়ে কালুদার কথা ভাবছি। হাল ছেড়ে দিয়ে তো বসে থাকা যায় না। ভাবছি বোম্বে নিয়ে যাবো এইবার। হঠাৎ করে ঘরের দরজা ঠেলে মা আসে। “সত্যি কথা বল ভুতো কালুর কি হয়েছে? আমার মনটা বড্ড কু ডাকছে।” কি ভাবে মাকে সত্যি কথাটা বলবো সেই ভাবনা চেপে বসেছে মনে। ঘরে আসে কালুদা। প্রাতভ্রমনে যাবে বলে তৈরি। “কিরে ভুতো অফিস যাবি না?” “শরীরটা ভালো লাগছে না।” “বেশ বেশ, বিশ্রাম নে। মামিমা আজ আমাকে স্কুলে যেতেই হবে। জানি না ছোটো ছোটো ছেলে মেয়ে গুলো কেমন আছে।” হাত ঘোরাতে ঘোরাতে মাঠে চলে গেলো কালুদা। মায়ের কোলে মাথা রেখে হাউ হাউ করে কাঁদছি আমি। একটা বড়ো শ্বাস ফেলে মা বলে, “বাবা ধর্মরাজ আমার ক্ষতি কিছুতেই করবে না, কিছুতেই…।” এইবার আমার মাও ভেঙে পড়েছে তার কালুর কথা ভেবে।