ফ্রেণ্ডস (ছোটোদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
রবিবার বিকেলে হঠাৎ দেখলাম আমাদের বাড়ির ঠিক পেছনে কাঁঠাল গাছের নিচে একটা শিশু কাঠবিড়ালী মাটিতে পড়ে আছে। ভাল করে লক্ষ করে দেখি ওটা নড়ছে এবং আস্তে আস্তে সামনের দিকে এগোচ্ছে। আমাদের কাঁঠাল গাছটা বিরাট বড়। অনেক কসরৎ করে আমি মাঝে মাঝে এই গাছে চড়ি। তারপর অনেক ওপরে উঠে বসে থাকি। ওপরে উঠে বসে থাকলে আমাকে আর কেউ খুঁজেও পায় না। এই গাছে অনেক কাঠবিড়ালী দৌড়াদৌড়ি করে প্রায়সময়েই। হয়তো এই গাছের কোন কোটরে ওদের বাসা আছে। আমি ঠিক জানি না। এই কাঁঠাল গাছের উঁচু মগডালে আমি অবশ্য উঠিনি।
আমি এই শিশু কাঠবিড়ালীটির মা-বাবাকে কোথাও আছে কিনা খুঁজতে লাগলাম। কাছাকাছি জায়গায়, গাছগাছালির ডালে আমি কোন কাঠবিড়ালীকে দেখতে পেলাম না। কি করব ভেবে পেলাম না। আমি ওটাকে হাতে তুলে নিলাম। ওটা মৃদু স্বরে চিঁচিঁ করে আওয়াজ করে উঠল।
আমি ওটাকে নিয়ে মায়ের কাছে গেলাম। মাকে জানালাম কীভাবে ওটাকে পেয়েছি। মা ওটাকে নিজের হাতে নিয়ে বললেন, এ তো দুধের ছানা। মা ছাড়া কী করে বাঁচবে ?
আমি বললাম, আমি কাপে একটু দুধ নিয়ে আসছি। বলে আমি দুধ আনতে ঘরে ঢুকলাম। তারপর আমার পড়ার টেবিল থেকে কলমে কালি ভরার এক নতুন ড্রপার এবং একটা কাপে কিছু দুধ নিয়ে মায়ের কাছে গেলাম। মা ড্রপার দিয়ে কাঠবিড়ালীর ছানাটাকে দুধ খাওয়ার চেষ্টা করতে লাগলেন। বুঝতে পারলাম না, দুধ ছানাটার পেটে যাচ্ছে কিনা। ওটার মুখ থেকে দুধ বেরিয়ে নিচে পড়ে যাচ্ছিল।
মা বললেন, এটাকে দুধ খাওয়ানো খুব মুশকিল। আচ্ছা, এক কাজ কর। বাড়ি পিছনে রাখা তারের খাঁচাটা নিয়ে আয়।
আমি দৌড়ে খাঁচাটা আনতে গেলাম। এই খাঁচাটাতে আমাদের এক টিয়ে ছিল। আমি, ভাই এবং মা — আমরা তিনজন মিলে লোমহীন এক টিয়ে পাখির ছানাকে বড় করে তুলেছিলাম। পরে একদিন আমাদের আদরের টিয়ে পাখিটা হারিয়ে গিয়েছিল। সে গল্প আরেকদিন বলবো।
আমি খালি খাঁচাটাকে একটু সাফসুতরো করে মায়ের সামনে রাখলাম। মা কাঠবিড়ালীর ছানাটাকে খাঁচাটার ভেতরে ঢুকিয়ে দিয়ে বললেন, খাঁচাটার মুখ খোলা রেখে যেখানে ছানাটাকে পেয়েছিলে তার কাছাকাছি কোনো গাছের ডালে এটাকে ঝুলিয়ে রেখে দিস। ওর মা এসে ঠিক ওকে খুঁজে নেবে।
আমি বললাম, ওর মা যদি না আসে, তাহলে ?
মা বললেন, আচ্ছা, সে তখন দেখা যাবে।
আমি বললাম, তাহলে কিন্তু আমি এটাকে পালবো। আমি এর নাম দেবো ফ্রেণ্ডস।
মা বললেন, আচ্ছা আচ্ছা, ঠিক আছে।
আমি খাঁচাটাকে বাড়ির পেছনে নিয়ে একটা ছোট গাছের ডালে এমনভাবে ঝুলিয়ে দিলাম যাতে আমি ছানাটাকে সহজেই বের করে আনতে পারি। ভাবলাম, এর নাম যে ফ্রেণ্ডস এটা অন্যেরা কী করে বুঝবে ? তাই আমি আমার অঙ্ক খাতার এক পাতা ছিঁড়ে, সেটার ওপর ফ্রেণ্ডস কথাটা তুলির সাহায্যে সবুজ রং দিয়ে লিখে, সে কাগজটা খাঁচাটাতে টাঙিয়ে দিলাম।
সেদিন আমি কিছুক্ষণ পরপর বাড়ির পেছনে গিয়ে ফ্রেণ্ডস কে লক্ষ করতে লাগলাম, ওর মা ওকে খুঁজতে এসেছে কিনা। দেখলাম একা ফ্রেণ্ডস একটু একটু করে এদিক থেকে ওদিক যাওয়ার চেষ্টা করছে।
সন্ধ্যের দিকে ছোট ভাই সদেব খেলাধুলো শেষে বাড়ি ফিরে এলে কাঠবিড়ালীর ছানাটাকে দেখালাম আর বোঝালাম যে ওর নাম ফ্রেণ্ডস।
রাতে ঘুমোবার আগে টর্চ নিয়ে দেখে এলাম, ফ্রেণ্ডস ঘুমোচ্ছে।
সকালে মায়ের ডাকে ঘুম ভাঙল। মা বলছেন, উঠ উঠ, চা-মুড়ি খেয়ে পড়তে বস। স্কুলে যাবার সময় এসে যাবে।
তাড়াতাড়ি উঠে বসলাম। কখন সকাল হয়ে গেছে টের পাইনি। ফ্রেণ্ডস-এর কথা মনে পড়ল। উঠে এক ছুটে বাড়ির পেছনে গেলাম। খাঁচাটার কাছে গিয়ে দেখলাম, ভেতরে ফ্রেণ্ডস নেই। কাছাকাছি খুঁজলাম। কিন্তু কোথাও ফেণ্ডস কে দেখতে পেলাম না। দৌড়ে গিয়ে মাকে জানালাম। মা বললেন, তাহলে হয়তো ওর মা এসে ওকে নিয়ে গেছে।
আমার ঠিক বিশ্বাস হল না। বললাম, কিন্তু কোন রাক্ষস কাকও তো আসতে পারে।
— আচ্ছা, চল। দেখি কী হয়েছে। মা আমাকে নিয়ে বাড়ির পেছনে গেলেন। খাঁচাটাকে ভাল করে লক্ষ করলেন। তারপর বললেন, মনে হচ্ছে ওর মা-ই এসে ওকে নিয়ে গেছে। যাক ভালোই হয়েছে। মায়ের কাছে ফিরে গেছে।
কথাগুলি আমার ঠিক বিশ্বাস হচ্ছিল না। কান্না পেল।