স্বপ্নবিলাসী (ছোটোগল্প)
সদানন্দ সিংহ
সাত সকালের বিভ্রান্ত হাওয়ায় এক কাপ কড়া চায়ের সাগরসম তেতো-মিষ্টির দুধ-জলে তিন ফোটা পরিমান কফির সঙ্গম হলে মনটা হয়ে ওঠে সত্যিই স্বপ্নবিলাসী। তখন কাঠখোট্টা কাজ আর কাঠখোট্টা মনের অতলে লুকিয়ে থাকা কত কিছু বেরিয়ে এসে চোখের ওপর নাচে। তাতে এক মই নিয়ে দিশা খোঁজে চন্দ্রকান্ত। একমাত্র পাঁচ বছরের মেয়েকে নিয়ে বিশাল স্বপ্ন দেখে। যে মেয়ে একদিন তিলোত্তমার জালকে কেটে ছিন্নভিন্ন করবে এবং মাথা উঁচু করে বাঁচবে।
এই স্বপ্ন নিয়েই সাত সকালে পান্তা ভাত খায় চন্দ্রকান্ত। মাথার ওপর বনবন করে ফ্যান ঘোরে। ইলেকট্রিক লাইন চলে গেলে তার বৌ মনোরমা হাতপাখার বাতাস করে। তারপর তাড়াহুড়ো করে সে বেরিয়ে পড়ে। তার জন্যে প্রচুর লোক হয়তো অপেক্ষা করে আছে।
চন্দ্রকান্ত পেশায় একজন সাধারণ ড্রাইভার। বাস ড্রাইভার। বি. এ. পাশ করার পর আর কোনো চাকরি পায়নি, তাই বাধ্য হয়ে ড্রাইভিং-কে পেশা হিসেবে বেছে নিতে হয়েছিল। সাধারণ লোকজন হয়তো বাস চালকের কাজকে ঠিক সম্মানের কাজ মনে না করলেও চন্দ্রকান্ত জানে তার কাজটা কত গুরুত্বপূর্ণ, কী রকম কেয়ারিং নিয়ে তার হাত-পা সব প্রতিটি মুহূর্তে রোবটের মতো ব্রেক, এ্যাক্সিলেটার, গিয়ার, ইন্ডিকেটার, স্টিয়ারিং হয়ে ছোটাছুটি করাতে হয়। প্রতিদিন অসংখ্য যাত্রীর প্রাণের নিরাপত্তা তার হাতের ওপর নির্ভর করে চলে। একটু এদিক সেদিক হলেই আর রক্ষে নেই। কিন্তু দুর্ঘটনা ঘটার আগে সেটা কেউ সেটা টের পায় না।
সকাল থেকেই সারাদিন ড্রাইভিং। এক শহর থেকে আরেক শহরে যায়। আবার সেই শহর থেকে যাত্রী নিয়ে ফিরে আসে। মাঝে মাঝে দশ-ত্রিশ মিনিট লাঞ্চ বা চা। ফাঁকে ফাঁকে মনোরমা এবং মেয়ের সাথে ফোনালাপ। এইসবের মাঝে সময় এবং ভাব এলেই সে বুক-পকেট থেকে মিনি ডায়েরি এবং কলম বের করে কবিতার আঁকাবুকি কাটে। এ অভ্যাস তার অনেকদিন আগের, কলেজে থাকতেই হয়েছিল।
ইদানীং বার মাসে তের পার্বণের দিনগুলি আরো লম্বা হয়। যাত্রীদের দৌড়াদৌড়ির ঝাঁপ শিথিল হয় না। বাসভর্তি লোক চলাচল করে।
ডিউটির পর গাড়ি পার্ক করে চন্দ্রকান্ত যখন ফিরছিল তখনো রাত বেশি হয়নি, মাত্র সাতটা। মাঝে মাঝে ক্লান্ত শরীরে সে ঘরে ফেরার পথে কম দামি এক কোয়ার্টার হইস্কি কিনে গুনে গুনে দু পেগ মারে। আজও সে দু পেগ মেরে দেয়। এটাও যেন তার এক সিমবলিক বিলাসিতা। এতে মনটা উড়ু উড়ু লাগতে আরম্ভ করে। তখন পৃথিবীর সব কিছুই জীবন্ত হতে থাকে। বুক পকেটে রাখা মিনি ডায়েরির অক্ষরগুলি হাসতে থাকে। পাশ দিয়ে কোনো রাস্তার কুকুর পাশ কাটিয়ে গেলে তাকে বলে যায়, হ্যালো। সেও উত্তর দেয়, হ্যালো।
উড়ু উড়ু মন নিয়ে চন্দ্রকান্ত যখন রাস্তা দিয়ে এগোচ্ছে তখন সে দেখে এক জায়গায় রাস্তার কিনারে বেশ কিছু লোকজন দাঁড়িয়ে খালের দিকে মুখ করে কী জানি দেখছে। সে জানে এদিকের রাস্তার পাশেই রয়েছে খাল। কাছে গিয়ে সে দাঁড়িয়ে থাকা একজনকে জিজ্ঞেস করে, ভাই, কী হয়েছে ?
লোকটা উত্তর দেয়, খালে ইলেকট্রিক পোস্ট থেকে ছিঁড়ে পড়া কারেন্টের তারে গরু প্যাঁচিয়ে গেছে।
কর্পোরেশনের রাস্তার আলোয় চন্দ্রকান্ত দেখে, কর্দমাক্ত নোংরা খালের মধ্যে এক গরু পড়ে রয়েছে। গরুটার পায়ে ইলেক্ট্রিকের তার প্যাঁচিয়ে আছে। সে বলে, গরুটাকে তো বাঁচানো দরকার।
সেই লোকটিই আবার উত্তর দেয়, কে আর নিজের প্রাণের রিক্স নিয়ে বাঁচাতে যাবে ! তাছাড়া ঐ নোংরা কাদা-আবর্জনার মধ্যে ?
চন্দ্রকান্ত বুঝতে পারে, গরুটাকে বাঁচানোর মত এখানে কেউ উপস্থিত নেই। উড়ু উড়ু মন নিয়ে সে ভাবে, সে একা কি গরুটাকে বাঁচাতে পারবে ? কীভাবে ?
গরুটার চোখ দুটো খোলা। মাঝে মাঝে গরুটা গাক করে এক আওয়াজ করে উঠছে। চন্দ্রকান্ত কিন্তু স্পষ্ট শোনে, গরুটা মাঝে মাঝে বলে উঠছে, বাঁচাও।
— আচ্ছা, দাঁড়াও আমি আসছি। বলে চন্দ্রকান্ত তার পায়ের চটি খুলে নোংরা কাদা-আবর্জনারর মধ্যে নেমে পড়ে। ধীরে ধীরে সে গরুটার দিকে এগোয়। রাস্তার পাশের লোকজন সব বলে ওঠে, আরে মশাই, করছেন কী এভাবে ? প্রাণে মারা যাবেন যে।
লোকজনের কথাগুলি তার কানে ঢোকে না। সে এগিয়ে গিয়ে গরুটার এক ঠ্যাং ধরে টানার চেষ্টা করতেই কারেন্টের এক শক তাকে একটু দূরে ছিটকে ফেলে দেয়। নোংরা কাদার মাঝে সে চিৎ হয়ে পড়ে থাকে। হঠাৎ কী হল তার বুঝতে একটু সময় লেগে যায়। এইসময় তার মাথা থেকে উড়ু উড়ু ভাবটা অদৃশ্য হয়ে যায়। সে কঠিন বাস্তবে ফিরে আসে। এবং সে টের পায়, তাকে নিয়ে অনেক লোক তামাশায় মত্ত। এই লোকগুলোর না আছে দায়িত্ববোধ, না আছে মানবতাবোধ।
স্বপ্নবিলাসী চন্দ্রকান্ত নোংরা কাদায় শুয়ে তখনো ভাবছে, কী করে একটা প্রাণীকে বাঁচানো যায়।