উন্মোচন – গুলশন ঘোষ

উন্মোচন – গুলশন ঘোষ

উন্মোচন     (অনুগল্প)

গুলশন ঘোষ

বি.এ পাস করার আগেই বিয়ে গিয়েছিল সঙ্গীতার। শ্বশুর বাড়ি গ্রাম থেকে অনেক দূরে। মা-বাবার একমাত্র সন্তান সে। চেয়েছিল কাছাকাছি কোন গ্রামে বিয়ে হোক। কিন্তু চাইলে-ই যে সব সাধ পূরণ হয় – এমনটা ক’জনের ভাগ্যেই বা ঘটে।
বিয়ের প্রথম তারা কয়েক বছর ঘনঘন আসা-যাওয়া করছিল। এখন তা কমে গেছে। বাবার শরীর খারাপ শুনে সঙ্গীতা অনেক দিন পর বাবাকে দেখতে এসেছে।
ঘরে মুদিখানার মালমশলা সব শেষ হয়ে গেছে। সঙ্গীতা গ্রামের দোকানে গেলো মুদিখানার ঝালমশলা আনার জন্য।
গ্রামে রয়েছে রাজকুমাদের মুদিখানার দোকান। বি.এড করেও সে এখনও কোন চাকরি পায়নি। বাবার সঙ্গে দোকানে বসে মুদিখানার ব্যবসা সামলায়।
ফর্দ হয়ে গেলে খুচরো ঝাল-মশলা পুরানো বই-এর কাগজ ছিঁড়ে মুড়ে দিচ্ছে রাজকুমার। কাগজ শেষ হয়ে গেলে ওজন দরে কিনে রাখা বইয়ের তড়পা থেকে সে একটা বই টেনে নেয়। সেই বইয়ের পাতা ছিঁড়তে গিয়েই যেন বিদ্যুৎ স্পৃষ্ট হল রাজকুমার। কয়েক মুহূর্ত সে থেমে গেলো। দেখল জন্মদিনের শুভেচ্ছা সহ দীর্ঘায়ু কামনা করে ঐ বইয়ের পাতায় লেখা – তোমার রাজু। তার চোখ চোখ ছলছল করে উঠল। এক ঝটকায় ফেলে আসা স্কুল বেলা ভিড় জমালো মনের গলিতে। ঢোক গিলতে গিয়ে সে অনুভব করল তার গলার কাছে কী যেন একটা আটকে আছে। আনমনা হয়ে বই থেকে পাতাটা ছিঁড়ে পরিমাণ মতো মৌরি দেওয়ার পর কাগজ মুড়তে মুড়তে ভাবে স্কুলের টিফিন-এর জমানো টাকায় কাউকে কিনে দেওয়া এমনই এক উপহারের কথা।
মৌরি মুড়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে সঙ্গীতার মাথার লাল টকটকে সিঁথির দিকে। সঙ্গীতা তার দিকে একটা ৫০০ টাকার নোট বাড়িয়ে দিতেই চমক ভাঙল রাজকুমারের। ফর্দর সঙ্গে সব কিছু ঝাল-মশলা মিলিয়ে নিয়ে বাড়ি ফিরল সঙ্গীতা।
রান্না ঘরে ঢুকে সব ঝাল-মশলা এক এক করে ঢেলে রাখছে কৌটোর মধ্যে। মৌরির মোড়ক খুলে ঢালার পর কাগজটা ফেলতে গিয়ে চমকে উঠল সে। ফর্দের হাতের লেখার সঙ্গে হুবহু মিল রয়েছে এমন হাতের লেখাতেই ওই কাগজে লেখা -জন্মদিনে তোমাকে আমার এই ছোট্ট উপহার…… । কাগজটা রেখে দ্রুত এগিয়ে গেলো মায়ের কাছে। মা-কে গিয়ে জিজ্ঞাসা করে, মা আমার বইগুলো কোথায়?
তার মা বলে — কেনো? কে আর পড়বে। ঘরে পড়ে পড়ে ধুলো জমছে আর পোকায় কাটছে, তাই দোকানে তোর বাবা ওজন দরে বিক্রি করে এসেছে।
সে ছুটে যায় রান্না ঘরে। মোচড়ানো কাগজটা হাতে তুলে নিয়ে সমান করে একভাবে তাকিয়ে আছে লেখাটার দিকে। তার চোখ জলে ভরে উঠল……মোচড়ানো কাগজের মতোই মুচড়ে যাচ্ছে তার বুক। তার মনকে কে যেন ঘূর্ণিজলের মতোই টেনে ঢুকিয়ে নিচ্ছে অতীতের চোরাস্রোতে। মনে মনে ভাবে এমন কতই না সাধ অপূর্ণ হয়ে মোড়া থাকে। ক’জনের ভাগ্যে সেই মোড়ক খোলার সৌভাগ্য ঘটে তার হিসাব রাখে না কেউ।