গোবর্ধনের ছবি (ছোটোদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
চার-পাঁচ দিন বাড়ি থেকে বের হয়নি। স্কুলেও যাইনি। আমার জ্বর হয়েছিল। গতকাল রাত থেকেই আমার আর জ্বর ছিল না। তাই বাড়ি থেকে বের হলাম। যেতে লাগলাম হিন্দি স্কুলের মাঠের দিকে। সেই খোলা মাঠ। মাঠের একদিকে একটা প্রাচীর আছে, বাকি দিকগুলি খোলা। হিন্দি স্কুল ছুটি হয়ে গেলে এবং ছাত্র-ছাত্রীরা সব চলে গেলে এই মাঠ আমাদের পাড়ার ছেলেদের দখলে থাকে। বেশ বড় মাঠ বলে মাঠের বিভিন্ন দিকে অনেক ধরনের খেলা করা যায়। একদিকে হাইজাম্প, লংজাম্প। আরেক কোণে কবাডি এবং খোখো। মাঝখানে ফুটবল বা ক্রিকেট। স্কুলে ভ্যাকেশন এলে আমাদের আর পায় কে, সকাল থেকেই আমাদের খেলাধুলা শুরু হয়ে যায়।
মাঠের দিকে যাবার সময় দেখলাম, গোবর্ধনদা রাস্তার এক কোণে চুপ করে বসে রয়েছেন। আমি কাছে যেতেই আমাকে ডাক দিলেন, হাবু শুনো। আমি কাছে গেলাম। ইঙ্গিতে গোবর্ধনদা আমাকে চুপ থাকতে এবং আমাকে অপেক্ষা করতে বললেন। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম। ব্যাপারটা বুঝতে পারলাম না।
মিনিট তিনেক চুপ করে অপেক্ষা করার পর আমি জিজ্ঞেস করলাম, আর কতক্ষণ ?
গোবর্ধনদা একটু বিরক্ত হলেন, ভালো কিছু পেতে গেলে একটু কষ্ট পেতে হয়।
— ভালো জিনিসটা কী ?
— আরেকটু অপেক্ষা করো, দেখতেই পাবে।
কি আর করি। অপেক্ষা করতে লাগলাম। খুব জানতে ইচ্ছে করছিল, ভালো জিনিসটা কি?
মিনিট দশেক অপেক্ষা করার পর দেখলাম সামনের একটা দোতলা বাড়ির ওপরের এক জানালা খুলে গেল, তারপর সেই জানালা থেকে একটা দুমড়ানো কাগজের মণ্ড রাস্তায় এসে পড়ল, আর গোবর্ধনদা দৌড়ে সেই দুমড়ানো কাগজটাকে কুড়িয়ে নিয়ে এল। আমাকে বলল, চল আমার সঙ্গে আমার ঘরে। সব তোমাকে দেখাচ্ছি।
বুঝতে পারলাম, ভালো জিনিসটা হচ্ছে ঐ দুমড়ানো কাগজটা। কৌতূহল চেপে আমি গোবর্ধনদার সঙ্গে রওনা দিলাম।
গোবর্ধনদার ঘরে ঢুকলাম। গোবর্ধনদা আমাকে ড্রয়িং রুমে বসালেন। তারপর সেই কাগজটাকে ধীরে ধীরে আমার সামনে প্রসারিত করতে করতে বললেন, ওখানে ওপরের ঘরে এক পাগল আছে। সেই পাগলটা খুব সুন্দর সুন্দর ছবি আঁকে। আঁকা শেষ হলে আঁকা কাগজটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। দেখো, কী সুন্দর আঁকে সে।
আমি কাগজে আঁকা ছবিটাকে দেখলাম। ছবির বিষয়বস্তু পাহাড়, নদী,গাছপালা।
এখন আমি বুঝতে পারলাম, চিংড়িমামা আমাদের একদিন যে একইরকম ছবিটা নিজের আঁকা বলে চালিয়েছিল সেটা তাহলে এভাবেই সংগ্রহ করেছিল!
গোবর্ধনদা এবার বললেন, এর আগে দু’দিনে আমি আরো দুটো ছবি পেয়েছি। সব তোমাকে দেখাচ্ছি।
গোবর্ধনদা আমাকে দেখালেন। সবগুলো ছবিই একই রকমের, গাছপালা, পাহাড় এবং নদীনালা। গোবর্ধনদা দুঃখ করে বললেন, আমি খবর নিয়ে জেনেছি, আগামীকাল ওই পাগলটা চলে যাবে। তাই আর ছবি পাওয়া যাবে না।
এমন সময় হর্ষবর্ধনদা ঘরে ঢুকে আমাদের দেখলেন। তারপর বললেন, বাঃ বেশ সুন্দর ছবি হয়েছে তো। তা গোবরা, কোত্থেকে এগুলি মেরে এনেছিস ? তুই তো বকের ঠ্যাং ছাড়া কিছুই আঁকতে পারিস না।
দাদার কথা শুনে গোবর্ধনদা একটু অখুশি। বললেন, আমি কি এগুলি আঁকতে পারি না?
— তা এই ছবিগুলির মধ্যে তোর আঁকা কোনো জিনিস আছে ? আগে এগুলির মধ্যে নিজে এঁকে সাপ-ব্যাং কিছু ঢুকিয়ে দে। তখন হয়তো বলা যাবে, তুই কিছু এঁকেছিস। বলেই হর্ষবর্ধনদা অন্য ঘরে চলে গেলেন।
গোবর্ধনদার চোখে-মুখে একটা খুশির ঝিলিক দেখলাম। বললেন, দাদার কথা মতো আমি এগুলির সাপ-ব্যাং ঢুকিয়ে দিচ্ছি। তাহলে এগুলি আমার আঁকা ছবিই হয়ে যাবে। আচ্ছা, আমি কলম নিয়ে আসছি।
গোবর্ধনদা ভেতরে ঢুকে একটা নীল কালির কলম নিয়ে এলেন। তারপর একটা ছবির নীচের দিকে একটা রেখা টেনে আমাকে বললেন, ভাই আমি সাপের লেজটা এঁকে দিলাম, এবার তুমি সাপের বাকি অংশগুলি একটু এঁকে দাও না।
অনুরোধ ঠেলতে পারলাম না। গোবর্ধনদার টানা রেখাটার ওপরে ভিত্তি করে আমি একটা সাপ এঁকে দিলাম। তারপর গোবর্ধনদা এবার আরেকটা ছবির নীচে একটা ছোট্ট গোল চিহ্নে এঁকে বললেন, একটা ব্যাঙের চোখ আঁকলাম। এবার ভাই, তুমি একটু পুরো ব্যাঙের ছবি এঁকে দাও।
কী আর করি, এঁকে দিলাম। গোবর্ধনদা এবার তৃতীয় ছবিটা নিজের দিকে টেনে কি একটা আঁকার চেষ্টা করতে লাগলেন। আমাকে বললেন, এবার কী আঁকব বুঝতে পারছি না। কিছুক্ষণ পর আবার বললেন, আচ্ছা আমি দাদার চেহারাটা আঁকি ছবির এই গাছটার নীচে। বলেই গোবর্ধনদা প্রথমে একটা ডিম আঁকলেন। ডিমের মাঝে দুটো ফোঁটা দিয়ে চোখ বানালেন। ছোট্ট একটা টান মেরে নাক, ঠিক সেই রকম আরেকটা টান মেরে ছোট্ট একটা নৌকো এঁকে মুখ, মাথার ওপর খাড়া খাড়া কয়েকটা টান মেরে চুল বানালেন। তারপর দুটো লম্বা পাট কাঠি এঁকে দুটো পা এবং দুটো ছোট পাট কাঠি এঁকে দুটো হাত বানালেন। তারপর আমাকে বললেন, আমার আঁকা শেষ। এবার তিনটে ছবিই আমার আঁকা ছবি হয়ে গেল। তাই না? আচ্ছা, তুমি একটু বসো। আমি দাদার ছবি কেমন হল দাদাকে একটু দেখিয়ে আনি।
বলেই গোবর্ধনদা ঘরের ভেতর চলে গেলেন।
ভেতরে হর্ষবর্ধনদা তাঁর নিজের ছবি দেখে কী বলবেন এবার আপনারাই অনুমান করুন। আমি কিন্তু আর বসিনি, দ্রুত চলে এসেছিলাম।