কংস দেববর্মার বাপ – সদানন্দ সিংহ

কংস দেববর্মার বাপ – সদানন্দ সিংহ

কংস দেববর্মার বাপ   (অনুগল্প)

সদানন্দ সিংহ

লোকটার নাম জাপান দেববর্মা। সবাই তাকে জাপান বলেই ডাকে। গাঁও পঞ্চায়েতের একজন মেম্বারও বটে। আজাদ হিন্দ ফৌজ এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালীন জাপান নামের এক খ্যাতি তৈরি হয়েছিল ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলে। বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরও জাপান নামের প্রতি একটা ভালো লাগা থেকে গিয়েছিল বলে জাপানের বাবা ছেলের নাম রেখেছিল জাপান দেববর্মা। নিজের নাম নিয়ে কোনোদিনই ভাবেনি জাপান। তার ছিল যাত্রাপালার প্রতি টান। শীতের সময় ফসল কাটা হয়ে গেলে প্রতি বছর তাদের গ্রাম থেকে দু মাইল দূরে এক জায়গায় মাঠের ওপর তাঁবু পড়ত। যাত্রাপালা হত। সত্যি বলতে কি, জাপান যাত্রাপালার জন্যে বছর বছর অপেক্ষা করতো। যাত্রাপালায় তার এক প্রিয় চরিত্র হল কংস। সেজন্যেই তার ছেলের নাম রেখেছিল কংস দেববর্মা।
কিন্তু কে জানতো প্রিয় চরিত্রের নামটাই তার কাল হয়ে দাঁড়াবে। ছেলেকে যখন প্রথম শ্রেণিতে ভর্তি করালো তখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। দ্বিতীয় শ্রেণিতে উঠার পর একদিন ছেলে এসে জানাল সে আর স্কুলে যাবে না। কারণ হিসেবে বলল, স্কুলের সবাই নাকি তার কংস নাম নিয়ে মস্করা করে।
এতে জাপান একটু মুশকিলে পড়ে গেল। কাছাকাছি আর অন্য স্কুলও নেই যে স্কুল পালটিয়ে ফেলবে। এছাড়া স্কুল পালটালেও কি আর সমস্যার সমাধান হবে ?
গ্রামের পঞ্চায়েত সেক্রেটারি পরামর্শ দিল কোর্টে এফিডেভিট করে নামটা পালটে নিতে। কথাটা মনে ধরল জাপানের। সে ঠিক করে, পঞ্চায়েত সেক্রেটারিকে নিয়ে একদিন কোর্টে যাবে। কিন্তু কী নাম দেওয়া যায়? সে ভেবে ঠিক করতে করে উঠতে না। নারদ চরিত্রটাও তার খুব প্রিয়। শুনে পঞ্চায়েত সেক্রেটারি বলল, সব্বোনাশ, এই নারদ নামটা রাখলে আবার হয়তো এফিডেভিট করতে হবে।
— তাহলে ভবানন্দ ?
— একটু সেকেলে। তার চেয়ে অনেক ভাল আনন্দ দেববর্মা।
শেষ পর্যন্ত আনন্দ দেববর্মা নামটাই টিকে যায়।
পঞ্চায়েত সেক্রেটারিবাবুকে নিয়ে জাপান একদিন কোর্টে গিয়ে নাম পরিবর্তনের এফিডেভিট করে এল। গাঁও পঞ্চায়েতের রেজিস্টারে নতুন নাম লেখা হয়ে গেল। জাপান গাঁও পঞ্চায়েতের এবং এফিডেভিটের কাগজ নিয়ে স্কুলে গিয়ে ছেলের নাম পরিবর্তন করে এল।

সবকিছু হল। শেষে এই নাম পরিবর্তন উপলক্ষে গ্রামের মান্যগণ্য লোক এবং গাঁসভার প্রধান-মেম্বারদের নেমতন্ন করে একটা ভোজন করানো হল। খেয়ে-দেয়ে তৃপ্ত হয়ে অতিথিরা যাবার সময় একে একে বিভিন্ন কথা বলে গেল — “খুব ভালোই খেলাম কংসের বাপ” “চলি কংসের বাপ” “ছেলের নাম পালটিয়ে ভালোই করেছ কংসের বাপ” “ছেলেকে নিয়ে ভাল থেকো কংসের বাপ” ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু। জাপান হা করে সবার দিকে চেয়ে রইল, কোন উত্তর দিল না।