বহুরূপী – সদানন্দ সিংহ

বহুরূপী – সদানন্দ সিংহ

বহুরূপী       (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

সামনে একটা লোক এক কুকুরকে গলায় চেইন বেঁধে দৌড়ে চলে যাচ্ছে। কুকুরটা লোকটার আগে আগে দৌড়োচ্ছে। কুকুরটা কি ব্লাড হাউন্ড ? হতে পারে। বিলেতি কুকুরের জাত চিনে না কানাই। মানে কানাইলাল। দেশী কুকুর নিয়ে সে ঝামেলা নেই। সবগুলোই এক রকমের। মালিকদের পা চেটে যায়। যা পায় তাই খায়। কী রকম কুঁকড়ে থাকে সারা জীবন। পড়ে পড়ে ঘুমোয়। মাঝে মাঝে হাই দেয়। ব্যর্থতায় ভরা জীবন যেন।
আর বিলেতি কুকুরেরা ? সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যে ভরা জীবন এদের। এদের খাবারের কৌটো-প্যাকেটে খরচ হয় হাজার হাজার টাকা। এদেরকে বেড়াবার ব্যবস্থা করতে হয় প্রতিদিন। নিয়মিত পশু ডাক্তার দেখাতে হয়। আদর করতে হয়। এসব দেখে কানাইয়ের রীতিমত হিংসে হয়। মাঝে মাঝে মনে হয়, বিলেতি কুকুরের মতো তার জীবনটা যদি হত তাহলে খুব ভাল হতো।

কানাইলালের বাপ ছিল বহুরূপী। বংশানুক্রমিক ভাবে নয়। আবার সেই হিজড়েদের মত নয় যারা হিজড়া সেজে কাণ্ড করে বেড়ায়। জীবনধারণের এক উপায় হিসেবেই কানাইয়ের বাপ বহুরূপীকে একদিন পেশা হিসেবে বেছে নিয়েছিল। জোয়ান বয়সে এক চায়ের দোকানে একজন স্কুল মাস্টারের কাছ থেকে শরৎচন্দ্রের বহুরূপী গল্প শুনে সাধ হয়েছিল বহুরূপী হবার। টুকটাক কিছু যাত্রাপালায় বহুরূপীর অভিনয়ও করেছে। পরবর্তীকালে কোনোদিন হনুমান সেজে, কোনোদিন ভালুক সেজে, কোনোদিন আবার মহাদেব বা সন্নাসী সেজে বাড়ি বাড়ি গিয়ে নাচ দেখাতো। খুশি হয়ে লোকেরা যে যা দিতো সেটা দিয়েই কষ্টে সংসার চালাতো। তারই একমাত্র ছেলে কানাইলাল বাপের পথে যায়নি। পাঁচ ক্লাসের পর সে এক চায়ের দোকানে কর্মচারি হিসেবে লেগে গিয়েছিল। এতে তার মায়ের পুরো সায় ছিল। পরে আঠারো বছর বয়েসের সময় সে নিজেই রাস্তার এক পাশে এক টেবিল নিয়ে চা দোকান খুলে ফেলেছিল। দেখতে দেখতে সেই চা দোকান তের বছরের মাথায় আস্তে আস্তে একটু বেড়ে বিস্কুট, চিপস, সঙ্গে হরেক মালে ভরে ওঠে। সেই ছোট্ট টেবিলের বদলে এখন হয়েছে রিক্সার দুই চাকা লাগানো একটা ভ্যান, যার ভেতরে রাতে ঘরে যাবার আগে তার দোকানের জিনিসপত্রগুলিই ঢুকিয়ে তালা মেরে রেখে যায়। অনেকদিন আগেই রিক্সার চাকাগুলির কংকাল বেরিয়ে এসেছিল। এতে তার অবশ্য ভালোই হয়েছে। এখন তার দোকানটাকে কেউ নাড়াতেও পারে না। এছাড়া সে চারিদিকে ইট-পাথর লাগিয়ে তার দোকানটাকে একটু শক্তও করে নিয়েছে।
বছর তিনেক আগে কানাইলালের বাপ মারা গেছে জ্বরে ধুকতে ধুকতে। অবশ্য বহুরূপীর লম্ফ-ঝম্ফ কয়েক বছর আগেই ছেড়ে দিয়েছিল। টিবি হয়েছিল। খুব বিড়ি খেতো। কানাইলাল তার বাপকে অনেকবার মানা করেছে বিড়ি-টিড়ি না খেতে। বাপ তার কথা শোনেনি। বাপ মারা যাওয়ার পর মা কানাইকে নিয়েই ভালোভাবে বাঁচার স্বপ্ন দেখেছিল। হয়তো এখনো দেখে। কানাই নিজে এসব খায় না। তবে তার দোকানে বিড়ি-সিগারেট রাখে। রাখতেই হয় কাস্টমারের জন্যে। অনেক লোকেই এসব খেতে তার দোকানে আসে, চা-ও খায়। সঙ্গে অন্য জিনিসও নিয়ে যায়। কোনোদিন যদি এর চালান শেষ হয়ে যায় তাহলে আবার কাস্টমাররা এসে উলটে ধমকায়, কেন এগুলি ঠিক করে এনে রাখ না ?

ইদানীং এক ঝামেলা বেধেছে। কানাইলালের দোকানের পিছনের বাড়িটা বিক্রিই হয়ে গেছে। এই বাড়ির নতুন মালিক এসে বলেছে কানাইয়ের দোকানটাকে ডান দিকে বেশ একটু সরাতে হবে। কারণ উনি নাকি এইদিকে একটা বড় গেইট করবেন। এই লোকটার সঙ্গে ঝামেলা করার মত সামর্থ কানাইলালের নেই। তাই কানাই, কাল করছি, পরশু করছি বলে কাটাচ্ছে। তার আশঙ্কা, দোকানটাকে নাড়াচাড়া করলেই ভ্যান কাঠামোর ক্ষতি হয়ে যাবে। ফলে তার মেরামতির জন্যে টাকা লাগবেই। তাই সে যত পারে তত পিছাচ্ছে।

আজ অনেকদিন বৃষ্টি নেই। বিকেলে কানাইলাল যখন বাড়ি থেকে এসে দোকান খুলতে যাচ্ছে তখন সে দেখে অনেক লোক হুড়মুড় করে পাড়ার এক গলির দিকে ছুটছে। কানাইলাল একজনকে ধরে জিজ্ঞেস করে, সবাই কেন এদিকে দৌড়োচ্ছে ?
লোকটা উত্তর দেয়, ভূত তাড়ানো হচ্ছে।
— ভূত ? তাই নাকি! আশ্চর্য হয় কানাইলাল। নিজে এসবে বিশ্বাস করে না। যাক, গিয়েই দেখি ব্যাপারটা। সে আর দোকান খোলে না। লোকজনদের পিছু পিছু সেও পাড়ার গলির ভেতর ঢোকে।

যে বাড়িতে ভূত তাড়ানো হচ্ছে সে বাড়িটায় এখন প্রচুর লোক। যেন কোনো তামাশা হচ্ছে আর লোকজনেরা সব যেন মজা করে দেখছে। কানাইলাল দেখে সেই বাড়ির বারান্দায় গলায় রক্তজবার মালা পরা এক ওঝা জাতীয় লোক এক মহিলাকে ঝাঁটাপেটা করতে করতে বলছে, তুই চলে যা এখান থেকে, এক্ষুণি চলে যা, নইলে আমি তোকে ঝ্যাঁটিয়ে এমন ভাবে বেঁধে রাখব আর কোনোদিন তোর মুক্তি হবে না। এদিকে ঝ্যাঁটার মার খেয়ে মহিলাটি বলে উঠছে, ও বাবা গো, ও মাগো।
কানাইলাল মহিলাটির মুখ দেখতে পায়নি, কারণ সে উপুড় হয়ে শুয়ে শুয়ে মার খেয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ মহিলাটি উঠে বসে ওঝার ঝ্যাঁটা পাকড়ে বলতে থাকে, আমার লাগছে, খুব লাগছে, আমাকে মেরো না।
সেই মুহূর্তেই কানাইলাল টের পায়, এতক্ষণ ধরে যাকে সে মহিলা ভাবছে, সে আসলে বছর পঁচিশের একটা মেয়ে। এই মেয়েটিকে সে অনেকদিন দেখেছে এই গলির রাস্তায়। চোখাচোখিও হয়েছে অনেকবার। কোনোদিন কথা হয়নি। মেয়েটিকে দেখলেই তার চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হত। আজ এই অবস্থায় মেয়েটিকে মার খেতে দেখে তার হৃদয়টা বেদনায় ভরে যায়। তার জ্ঞানগম্যি ঠিক থাকে না। শুধু মনে হয়, মেয়েটার নাম মঞ্জুলিকা এবং এই মঞ্জুলিকাকে আজ বাঁচাতে হবে। ভাবামাত্র সে ওঝাকে ঝাপটে ধরে বলতে থাকে, আপনি ওকে মারছেন কেনো শুধুশুধি?
কানাইলালের এই কাণ্ডে ওঝা বেশ ঘাবড়ে যায়, এমন অবস্থায় সে আগে কোনোদিন পড়েনি। ফ্যাল ফ্যাল করে সামনে চেয়ে থাকে ওঝা।
এ ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই আবার কয়েক জন লোক কানাইলালকে ধরে টানতে থাকে আর বলতে থাকে, ছেড়ে দাও ওঝাকে। ওকে ওর কাজ করতে দাও।
কানাইলাল বুঝতে পারে, এত জনের সঙ্গে সে কিছুতেই পেরে উঠবে না। তাই সে ওঝাকে ছেড়ে দিয়ে পিছিয়ে আসে। কিন্তু তার মঞ্জুলিকাকে এভাবে মার খেতে দেখে মাথায় বুদ্ধি খেলাতে থাকে, কীভাবে মঞ্জুলিকাকে উদ্ধার করা যায়। অবশেষে সে একটা উপায় খুঁজে পায় এবং দ্রুত তার নিজের বাড়ির দিকে চলে যায়।

টিনের চাল দেওয়া বাড়ি। দেয়ালটা কানাইলাল অনেক কষ্টে পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথুনি দিয়ে করেছে। তবে প্লাস্টার মারা সম্ভব হয়নি। মা ছোট্ট বারান্দায় বসে কী একটা সেলাই করছে। কানাইলাল মাকে বলে, মা, বাবার সঙ সাজার জিনিসগুলি কোথায় আছে?
— সে তো কাঠের সিন্দুকে আছে। কেন?
— আছে, একটা দরকার। পরে বলব।
কানাইলাল সিন্দুক খুলে বিভিন্ন সিন্দুক ভর্তি সাজার জিনিসগুলি থেকে সন্ন্যাসী বেশের জিনিসগুলি বের করে নিজেকে সন্ন্যাসীবেশী করে ফেলে। তারপর আয়নায় নিজেকে দেখে নিজেকেই সে চিনতে পারে না। মাথায় ইয়া বড় জটা, এক হাত লম্বা দাড়িগোঁফ, লুঙ্গির মত পরা লাল কাপড়, উদোম গায়ের ওপর লাল চাদর। তারপর এক হাতে লোহার চিমটা এবং আরেক হাতে মোষের শিং দিয়ে তৈরি শিঙ্গা নিয়ে সে খালি পায়ে বেরিয়ে আসে। তাকে দেখে তার মা আশ্চর্য হয়। আওয়াজ করে, এ মা, আবার কি! কানাইলাল উত্তর দেয় না, বেরিয়ে যায়। দ্রুতগতিতে হাঁটতে থাকে।

কানাইলাল সোজা চলে আসে ভূত তাড়ানোর জায়গায়। ওঝা আগের মতোই তার মঞ্জুলিকাকে ঝ্যাঁটাচ্ছে। মঞ্জুলিকা যন্ত্রণায় কাতর। খুব খারাপ লাগে তার। সে লোকজন ডিঙ্গিয়ে সামনে গিয়ে থামে। তারপর শিঙ্গায় এক দীর্ঘ ফু দেয়। শিঙ্গার আওয়াজে এবার সব লোকজন তার দিকে ফিরে তাকায়। সে তিন-তিনবার শিঙ্গায় ফু দেয়। তারপর আওয়াজ করে বলতে থাকে,
    আরে হো-অ-অ ব্যোম ব্যোমং
    ব্যোম চিকা ব্যোম চিকা ব্যোম ব্যোমং
    শাণ্ডিল্য মান্ডিল্য ঘটোৎকচ ঘুমং
    দ্রাবিড়িয় দ্রাঘিমায় কুরুক্ষেত্র ধুমং
    অক্ষরোহিং কালিমায়ঃ মনস্তুপং
কথাগুলি বলেই কানাইলাল আবার শিঙ্গায় ফু দেয়। সে মুখ দিয়ে কী বলছে তা সে নিজেও বুঝতে পারে না, আপনা-আপনি কথাগুলি মুখে এসে যাচ্ছে।
সবাই এবার সন্ন্যাসীবেশী কানাইলালের দিকে চেয়ে রয়েছে। ওঝার ভূত তাড়ানোর কাজও থেমে গেছে। এবার কানাইলাল ধীরে ধীরে সামনে এগোয়। সামনে গিয়ে চিমটে দিয়ে ইঙ্গিতে ওঝাকে বলে, সে যেন কিছু না করে। তারপর সে মঞ্জুলিকার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়। মুঞ্জুলিকা তাঁর দিকে অবাক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে। তার মঞ্জুলিকাকে সামনে এ অবস্থায় দেখে তার পরাণটা ছলাৎ ছলাৎ করে। এই মঞ্জুলিকাকে সে কি ভালোবাসে ? ভালোবাসা কি এই রকমই হয় ? সে ঠিক জানে না। সে চিমটে দিয়ে মঞ্জুলিকার মাথায় স্পর্শ করে রাখে। তারপর চোখ বন্ধ করে কীসব বিড় বিড় করে মন্ত্র বলে যায়। একসময় চোখ খুলে বিকট স্বরে চেঁচাতে থাকে, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও, তফাৎ যাও ………। ঝাঁটার বাড়ি খেয়ে আহত এবং ক্লান্ত মঞ্জুলিকা কানাইলালের বিকট আওয়াজ শুনতে শুনতে একসময় জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে। এবার কানাইলাল ওঝাকে বলে, ভূত চলে গেছে বাছা। ওঝা উঠে এসে সন্ন্যাসীর পা ধরতে যায়। তা দেখে কানাইলাল আবার চেঁচিয়ে ওঠে, তফাৎ যাও।
এরপর ‘তফাৎ যাও, তফাৎ যাও’ বলতে বলতে কানাইলাল দ্রুত স্থানত্যাগ করে।
তার দোকানের সামনে দিয়ে যাবার সময় সে দেখে দোকানের পেছনের বাড়ির নতুন মালিক রাস্তায় দাঁড়িয়ে তার দোকানের দিকে চেয়ে আছে। কানাইলাল যাওয়ার পথে লোকটার সামনে থামে। তারপর বলে, বাছা, তুমি ভাবছ যে এই দোকানটা কেন ডানদিকে একটু সরে যাচ্ছে না। তাই তো?
— একদম ঠিক বাবা।
— চিন্তা করো না। সরে যাবে। তবে দেখছো তো, এই ভ্যান রিক্সাটা একেবারেই ভেঙে গেছে। তুমি যদি নতুন একটা বানিয়ে দাও তাহলে ও নির্ঘাত সরে যাবে।
— হ্যাঁ বাবা। তাহলে আমি ওকে একটা নতুন বানিয়ে দেব। বাবা, আপনার জন্যে কী করতে পারি আমাকে বলুন।
— কিছুই করার দরকার নেই। তুমি শুধু এই দোকানের ছেলেটাকে একটু দেখে রাখো। ও খুব ভালো মানুষ।
— ঠিক আছে বাবা। তাই হবে।

কানাইলাল দ্রুত তার বাড়ির দিকে যেতে থাকে। যেতে যেতে সে বেশ বুঝে যায় এই জগতে বহুরূপী মানুষদের বেঁচে থাকা নিয়ে তেমন কোনো সমস্যা নেই। কারণ বহুরূপীদের একটা মূল্য এখনো আছে। সাধারণ মানুষের কাছে। অবাস্তব ও বাস্তবের মধ্যে যে পার্থক্য তা নিয়ে সাধারণ মানুষ চিন্তা করে না। বহুরূপীরা এসবের ভেতরে এসে নিজের কাজ গুছিয়ে চলে যায়।