শিশিরবিন্দু -১ (অনুগল্প)
সুদীপ ঘোষাল
আমাদের বিয়ের পরে তারাপীঠে প্রণাম করে এলাম দুজনে। আমার স্ত্রী আমাকে বললেন, মায়ের কাছে ঘোরা তো বারোমাসের ব্যাপার। চল, এবার দূরে কোথাও হানিমুনে যাই।
আমি বললাম, ঠিক আছে সামনের মাসে পূর্ণিমাতে হানিমুন হবে আমাদের। স্ত্রী খুব খুশি। নতুন বৌয়ের আদর সেই সুবাদে পেলাম খুব। আমি খুঁজে খুঁজে সবকিছু ঠিক করে রেখেছি। প্রেজেন্টেশন কি ভাবে করব তার প্রস্তুতিও নিয়ে রেখেছি। আদরে সমাদরে চলে এল বহু প্রতিক্ষিত পূর্ণিমারাত।
রাতে বৌ বলল, তুমি যে বললে পূর্ণিমাতে আমাকে হনিমুনে নিয়ে যাবে। সারাদিন চলে গেল কই এখনও তার প্রস্তুতি দেখছি না।
আমি বললাম, রাত তো বাকি। তুমি সেজে নাও। বৌ খুশি হয়ে সেজে নিল। তারপর আমি ব্যাগ নিয়ে ওর হাত ধরে বললাম, চল তো একবার ছাদ থেকে ঘুরে আসি।
— কেন গো, ছাদে কি হবে?
— চলোই না, গিয়ে দেখবে।
আমার জেতার জেদে বৌকে নিয়ে ছাদে উঠলাম। বৌ বলল, বলো কি বলবে।
আমি ভাল করে শয্যা পাতলাম। তারপর দুজনে বসলাম তার উপর। বৌ বলল, বল তাড়াতাড়ি বল। কি যে কর, দেরী হয়ে যাবে তো।
আমি বললাম, দেখ চাঁদের আলোর বন্যায় কেমন জগত মায়াবী হয়ে উঠেছে। তোমাকেও চাঁদের মত লাগছে। তুমিও আমার চাঁদ।
তারপর ব্যাগ থেকে ডাবরের একটা মধু মানে হানির শিশি বের করে বৌয়ের ঠোঁটে দিলাম। বললাম, এই হল হানি আর অই আকাশের মুন। তাহলে হানিমুন হল তো?
বৌও কম যায় না। বলল, আমি জানতাম তুমি যাবে না কোথাও। কেবল দৌড়টা দেখলাম। আমি বললাম, বাড়ির কাছে শিশিরবিন্দু আমরা ঠিকমত দেখি না। একটু তাকিয়ে দেখ বাইরের জগতের থেকে আপন জগতের সৌন্দর্য বেশি।
বৌ হাসতে হাসতে শুয়ে পড়ল আমাকে জড়িয়ে।
আমাদের জ্যোৎস্না রাতের ঘরে রোজ দুজনে দুজনের দেহে আলো মাখাই হানিমুনের। মন জুড়ে ক্যাপসিক্যামের আদর। আলুপোস্ত আর মুগের ডালে রসনা তৃপ্ত। ঝাল লাগলে জলের স্নেহ মাখি…
ওপারে যে কুটির দেখা যায় গোলাপ ঘেরা। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলে ছোট নদী। শ্রমিকের ঘাম ধুয়ে দেয় উদার কুলুকুলু স্রোত। ওটাই আমাদের শীতল আশ্রয়ের আদর।
সবুজ মনে মাঠে কাজ শেষে ফেরে যখন, ঈশানীর হাওয়ায় দোলে প্রতিক্ষারত চাঁদমুখ, খুশির হাওয়ায় জেগে ওঠে রাঙা সূর্যের রোদ…চন্দ্রাবলীর পরিশ্রমের ঘাম চেটেপুটে খায় খিদের পাতে।
শিশিরবিন্দু -২ (অনুগল্প)
সুদীপ ঘোষাল
রোদের ভালবাসার আদর গায়ে মেখে সস্ত্রীক উইকেন্ডসে আমরা এসেছি এখানে ভালোবাসার টানে। বহুবছরের ঋণ মনে হয় জমা হয়ে আছে এই খোলা মাঠের মায়ায়। স্ত্রী বলল, তুমি হানিমুনে এসে কবি হয়ে গেলে। স্ত্রীর নাম সোমা, সে বলল, এটা আমার দূরে যাওয়া না হলেও আফটার অল হানিমুনে আসতে পেরে ভালো লাগছে খুব।
সোমা আমাকে বলল, সিঙ্গি হল বাংলার প্রাচীন গ্রাম। এই গ্রামেরই নদী পুকুর খাল বিল জলাশয় সব আছে। ফসল বিলাসী হওয়ার গন্ধ আছে সিঙ্গীর মাটির উর্বরতায় ফুলে ফলে ফসলের সুন্দর গ্রাম।
বাংলার সব পাখিরা কমবেশি সিঙ্গীর আকাশে বাতাসে ঘুরপাক খায়। তিনি বিখ্যাত করেছেন ইতিহাসে স্থান করে দিয়েছেন। কবি কাশীরাম দাস সংস্কৃত থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছিলেন মহাভারতের কাহিনি। এই মহাপুরুষের জন্মভিটার সংস্কার কাজ শুরু হয়েছে। আমরা দিনে তাঁর ভিটাতে দাঁড়িয়ে তাঁকে শ্রদ্ধাসংগীত শোনাতে পারি। তারপর অনেকটা হেঁটে গিয়ে দাসপাড়া পেরিয়ে গিয়ে বটবৃক্ষের তলায় দাঁড়ালাম উদাস হয়ে। এই স্থানের মাটি কপালে বুলিয়ে নিলাম একবার। সবাইকে ক্ষেত্রপালের মন্দির নিয়ে গেল। ক্ষেত্রপাল বটবৃক্ষের নিচে অবস্থিত। তারপরে রাস্তা দিয়ে গিয়ে সোজা শিব মন্দির।
এখন পাকা রাস্তা হয়ে গেছে বুড়ো শিবের মন্দির যেতে। আমি বললাম, ছোটবেলায় আমাদের কোপা গ্রামে মাটির রাস্তা ধরে ধুলোমেখে ঘরে ঢুকতাম। বর্ষাকালে এক হাঁটু কাদা হয়ে যেত। গোরুর গাড়ি ছাড়া কিছুই যান ছিল না। আর ছিল পাল্কি। গ্রামের ছেলেমেয়ের বিয়ে হলেই শুনতাম পাল্কির গান।
রাতে খেয়েদেয়ে সোমা ও আমি আবার চাঁদের আকাশে।
তার পরের গল্প ডুব দিয়েছে জ্যোৎস্না সাগরে…