ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা – গুলশন ঘোষ

ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা – গুলশন ঘোষ

ভবিষ্যৎ দ্রষ্টা     (অনুগল্প)

গুলশন ঘোষ

শুকনো পাতাগুলো ভেসে ভেসে বিছানো চাদরের উপর পড়ছে। সেইখানেই জমা হচ্ছে দশ-বিশ-পঞ্চাশ-একশো-দু’শো টাকার নোট। কেউ বা নমস্কার করে দিয়ে যাচ্ছে কয়েন।
চাদরের উপর রাখা কত অজানা গাছের নানা শিকড়। কিছু রঙ-বেরঙের পাথর। লোহা ও তামার রিং।
গাছের নীচে বসে আছে অমূল্যচরণ শাস্ত্রী। আগে নাম ছিল অমূল্য সাঁতরা। শাস্ত্রী তার উপাধি। এছাড়া তার আরো একটি উপাধি আছে — রত্নপ্রভাকর। ছেলের চিকিৎসার জন্য গেছেন ভেলোরে। ছেলে ভর্তি রয়েছে এক সপ্তাহ। সারাদিন একা একা সময় তার কাটছে না। তাই সি.এম.সি. ভেলোরের পুরানো বিল্ডিং-এর গেটের বাইরে গাছতলায় বসে বসে মানুষের ভবিষ্যৎ বলছেন।
লম্বা লাইন। যারা হাত দেখাচ্ছে তারা প্রত্যেকেই এখানে চিকিৎসা করাতে এসেছে। তাদের নানা প্রশ্নের সমাধান বলে দিচ্ছেন অমূল্যচরণ। সেই সঙ্গে কাউকে গাছের মূল পরার বলছেন কিংবা গ্রহরত্ন ধারণের নির্দেশ দিচ্ছেন।
মিরাকেল। রোগী সুস্থ হয়ে উঠেছে। অমূল্যচরণের গ্রহরত্ন কথা বলেছে। সেই খুশিতে অমূল্যের পায়ে পড়ে গেল কলকাতা থেকে আগত ব্যবসায়ী দম্পতি। নগদ দশহাজার টাকা তুলে দিল তারা হাতে।
গর্বের সঙ্গে অমূল্যচরণ বললেন, বলেছিলাম না আপনার টাকা বিফলে যাবে না। ১০০ % গ্যারেন্টি। রত্নপ্রভাকর-এর কথা মিথ্যা হয় না। যারা দাঁড়িয়েছিল তাদের মনের বিশ্বাস ক্রমশ গাঢ় হয়ে উঠছে পাহাড়ের কোলে পুঞ্জীভূত বর্ষার ভাসমান মেঘের মতোই।
চিন্তায় ছিলেন অমূল্যচরণ ছেলের অপারেশনের টাকা জোগাড় করা নিয়ে। কিন্তু মানুষের ভবিষ্যৎ গণনা করে এক সপ্তাহেই সব টাকা জোগাড় করে ফেলেছেন তিনি।
স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে ৪ নম্বর ক্যাশ কাউন্টারে দাঁড়িয়ে আছেন অমূল্যচরণ। কাল অপারেশন । উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা অমূল্যচরণের চোখে মুখে। ভিতরে একটা চাপা টেনশন কাজ করছে।
হঠাৎ টোকেন নম্বর ১৪ বি ঘোষণা হতেই চঞ্চল হয়ে উঠল অমূল্যচরণ। না ক্যাশ জমা নয়, ডাক্তার তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন তিনি। ভিতরে কোন পেশেন্ট রয়েছে। গেটের বাইরে অপেক্ষা করছেন অমূল্যচরণ। পাশেই দাঁড়িয়ে তার এক ভক্ত। দেখা যাচ্ছে অমূল্যচরণের দেওয়া গাছের মূল তার হাতে লাল সুতোয় বাঁধা। ভক্ত মনে জোর পেল। চোখে চোখে সৌজন্য বিনিময় করল দু’জনে।
ভিতরে যাওয়ার ডাক পড়ল অমূল্যের। কয়েক মুহূর্ত পরেই হঠাৎ ভক্তের কানে ভেসে এলো কান্নার আওয়াজ।
কৌতূহল চাপতে না পেরে দরজাটা একটু ফাঁক করে দেখে, হাউ হাউ করে কাঁদছেন অমূল্যচরণ শাস্ত্রী মহাশয়। আর বলছেন, যে ভাবেই হোক ডাক্তারবাবু আমার ছেলেকে বাঁচান।
অমূল্যের ভক্ত একবার ঢোঁক গিলে তার বাহুতে লাল সুতোর সঙ্গে বাঁধা শিকড়টার দিকে তাকিয়ে আছে ভীত চোখে।