রোগের নাম ইডিয়েট সিনড্রোম – সদানন্দ সিংহ

রোগের নাম ইডিয়েট সিনড্রোম – সদানন্দ সিংহ

রোগের নাম ইডিয়েট সিনড্রোম

সদানন্দ সিংহ

আমাদের এই বর্তমান যুগে ইডিয়েট সিনড্রোম বলে এক নতুন রোগের উৎপত্তি হয়েছে। বয়স্ক থেকে শিশু সহ পৃথিবীর প্রচুর লোক এখন এই রোগে আক্রান্ত এবং চট-জলদির যুগে এই রোগে আক্রান্তের সংখ্যা অতি দ্রুতগতিতে বেড়েই চলেছে কেবল। এই রোগের জন্যে আমাদের জীবনে অনেক সমস্যাও তৈরি হয়ে চলেছে। অনেকেই হয়তো এই রোগের নামই শোনেননি।  কিন্তু আপনি কি জানেন, আপনিও এই রোগে আক্রান্তদের মধ্যে একজন কিনা?

তাহলে এবার জানা যাক এই ইডিয়েট সিনড্রোম রোগটি  আসলে কী ধরনের রোগ ? ইডিয়েট বলতে আমরা বুঝি বোকা, কিন্তু এখানে ‘ইডিয়েট’ বা IDIOT হচ্ছে একটি abbreviation যার full form হচ্ছে ‘Internet Derived Information Obstruction Treatment’ যার মূল অর্থ হচ্ছে ইন্টারনেট থেকে উদ্ভুত তথ্য নিয়ে সত্যিকারের চিকিৎসায় বাধা এবং নিজেই নিজের কিংবা পরিবারের চিকিৎসায় লেগে পড়া। সাদামাটা কথায় বলা যায়, এর মূল কারণ হল ইন্টারনেটের তথ্যের প্রতি আসক্তি ও অন্ধবিশ্বাস।

বর্তমানের যুগ হচ্ছে ডিজিটাল যুগ, ইন্টারনেটের যুগ এবং সোসিয়্যাল মিডিয়ার যুগ। ইন্টারনেট জিনিসটা চোখে দেখা যায় না, ধরা-ছোঁয়া যায় না, যাকে ঈশ্বরের মতো অনুভব করা যায় তার বিভিন্ন কার্যকলাপের মাধ্যমে। ইন্টারনেট এখন একটা শক্তিশালী হাতিয়ারও। যে কোনো ধরনের তথ্যই এখন ইন্টারনেটে পাওয়া যায়। এই তথ্য পাওয়ার জন্যে গুগোল, বিং, ইয়াহু-র মতো বিভিন্ন সার্চ ইঞ্জিন বর্তমান। এর মধ্যে বেশির ভাগ লোক গুগোল ব্যবহার করে তথ্যের অনুসন্ধান করেন। জানুয়ারি ২০২৪-এর তথ্যানুযায়ী গুগোল ব্যবহার করে প্রতি সেকেন্ডে ৯৯ হাজার তথ্যানুসন্ধান করে চলেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের প্রচুর লোক।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে এই যে ইন্টারনেটে এত তথ্য বর্তমান, এই তথ্যগুলি কোত্থেকে এলো বা কারা এগুলি ইন্টারনেটে দিয়ে রেখেছে ? এর উত্তর হলো এইসব তথ্যগুলি বিভিন্ন দেশের সরকারি দপ্তর, বিভিন্ন নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান এবং আমি-আপনার মতো সাধারণ-অসাধারণ লোকেরাই দিয়েছেন। সরকারি দপ্তর এবং নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠান-এর তথ্যগুলি ছাড়া বাকি যেসব তথ্য আছে সেগুলির অনেকগুলির ভুলভাল তথ্যও সার্চ করলে চলে আসে। আবার অনেক নামকরা নিউজ চ্যানেলেও ইন্টারভিউ-এর মাধ্যমে পরিবেশিত ভুলভাল তথ্যও হেডিং হয়ে পরিবেশিত হয়। ইন্টারনেটে থাকা এইসব ভুল তথ্য দেখাশোনা করার জন্য কোনো হেডমাস্টারও নেই। সাধারণ লোক অনেক সময় বুঝতেও পারেন না, কোন্ তথ্যগুলি ভুল।

ইন্টারনেটের তথ্যের প্রতি আসক্তি আমাদের জীবনে যেমন অনেক সমস্যার সমাধান এনে দিয়েছে, তেমনি আবার অন্যদিকে এর প্রতি অন্ধবিশ্বাস আমাদের জীবনে অনেক সমস্যাও তৈরি করেছে। বিশেষ করে এই সোসিয়্যাল মিডিয়ার যুগে নিজেকে একজন পণ্ডিত বা বিশেষজ্ঞ হিসেবে উপস্থাপন করে যে কেউ যেভাবে ইচ্ছেমতো নিজের লজিক, নিজের মতবাদ, ভুল তথ্য পরিবেশন করে চলেছে তা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এতে অনেক সাধারণ মানুষ প্রভাবিত হয়ে বিভ্রান্ত হয়ে যাচ্ছেন।

তবে ইডিয়ট সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে যেমন সাধারণ মানুষ আছেন, তেমনি হাই কোয়ালিফাইড শিক্ষিত লোক যাঁরা ইন্টারনেটের সরকারি এবং নির্ভরযোগ্য প্রতিষ্ঠানের তথ্য ছাড়া বিশ্বাস করেন না, তাঁরাও আছেন। সম্প্রতি ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের জার্নাল কিউরিয়াসে এই সংক্রান্ত প্রকাশিত এক গবেষণাপত্র অনুযায়ী বিজ্ঞানীরা ইডিয়ট সিনড্রোমে আক্রান্ত ব্যক্তিদের কিছু লক্ষণের কথা উল্লেখ করেছেন। সেগুলিকে নিম্নলিখিত ভাবে ব্যাখ্যা করা যায়ঃ-

১) ডাক্তারের কাছে না যেতে চাওয়া, ২) ডাক্তার দেখালেও প্রেশক্রিপশন অনুযায়ী ওষুধ না খাওয়া এবং নিজের মতো করে ওষুধ বা ওষুধের ডোজ নির্ণয়, ৩) লক্ষণ দেখে নিজের রোগ নিজেই নির্ণয় করা, ৪) তারপর নিজেই ওষুধ ঠিক করে বাজারের ওষুধ কিনে খাওয়া, ৫) ঘরোয়া দাওয়াই হিসেবে ভেষজ উপকরণের সাহায্য, ৬) বিভিন্ন রোগের পরিণতির কথা জেনে নিজেকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকা।

আর ইডিয়ট সিনড্রোম-এ আক্রান্ত ব্যক্তিরা যে-কোনো ছোটো সমস্যা নিয়েও ইন্টারনেটে সার্চ করেন এবং ইন্টারনেটের তথ্যের ওপর আস্থা রাখেন। কেউ কেউ আবার ইন্টারনেটে পাওয়া তথ্যের পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু করেন, আবার কেউ অন্ধভাবে বিশ্বাস করেন। আবার গুগোলে সঠিক উত্তর না পেলে কেউ কেউ বিষণ্ণতায় চলে যান।

মনে রাখা দরকার, ভুল চিকিৎসায় যেমন নিজের বা নিজেদের বিপদ ঘনিয়ে আসতে পারে, সেজন্যে সঠিক সময়ে চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন; তেমনি ভুল তথ্যের ওপর ভিত্তি করে জীবন যাপন আমাদের সমাজেও বিরূপ প্রভাব পড়তে পারে। তাই গুগোল করে পাওয়া সমস্ত তথ্যকে অন্ধভাবে বিশ্বাস না করাই ভাল। আর যাই হোক, গুগোল তো আর ঈশ্বর নয়।