প্রেমিক পানকৌড়ি ও এক মনোরম সন্ধ্যা (ছোটোগল্প)
সুদীপ ঘোষাল
লাথি মেরে মুড়ির বাটি ফেলে দিয়েছিলেন কাকা। রাগে তার মাথার ঠিক ছিলো না।
মিনুর মনে স্মৃতিগুলো উঁকি মারে। ঠিক পুরোনো আয়নার মত। সামনে বসে আছে মন। মন তার ছেলেবেলার বন্ধু।
মন অবাক হয়ে শোনে মিনুর মাটির বেহালার সুর।
— প্রথমে অবাক হয়েছিলাম। পরে বুঝলাম আমারই ভুল।
মন, মন দিয়ে শোনে। কোনো মন্তব্য করে না।
— তারপর কত বসন্ত এলো গেলো। লঙ্কারাজ্যের সিংহাসনে যে বসে তার একই রূপ। শুধু রং পরিবর্তনের ফলে মানুষ পালটায়, কালো, সাদা, হলুদ হরেক রঙের চিহ্ন নিয়ে।
জানালার ধারে বসে মিনু। পাড়াসুদ্ধ ডি’জের শব্দে অতিষ্ঠ। মিনু কানে আঙুল দেয়। দুদিন পরে শহর নিস্তব্ধ হলে মন তার জানালার কাছে গাছটায় বসে। তারও খুব মনখারাপ। মনে মনে কষ্ট পায় মন। সে মিনুকে বলে, তুমি একা কেন? অন্য মানুষের মত পরনিন্দা, পরচর্চা করো না কেন?
— সকল মানুষ একরকম স্বভাবের হয় না।
— তাহলে তুমি তো ব্যাকডেটেড পার্সেন।
— আপডেট হতে গিয়ে নিজস্বতা খোয়াতে পারব না।
— চলো আমার সঙ্গে সবুজ গাছের ডালে। গাছে গাছে উড়ব। কত সবুজের মুখোমুখি হব।
— তাই চলো।
তারপর দুজনে ওড়ে। মুক্তির আনন্দে ওড়ে। উড়তে উড়তে বসে অজয় নদের ধারে। কুলকুল শব্দে জল বয়ে যায় আর মিনুর স্মৃতির বন্যা কথা হয়ে মনকে বোঝায়।
মিনু আর মন শৈশবের বন্ধু। মা, মাটি, মানুষের আদরে মানুষ হয়েছে মিনু। কারণে অকারণে গ্রামের মাটি সে সারা অঙ্গে মেখে নিত। মাটিমাখা কৃষক, খেটে খাওয়া মজুর তার বন্ধু ছিল। ছোটো থেকেই সেবা করত মানুষের। কেউ খেতে না পেলে নিজের টিফিন খাইয়ে দিত অক্লেশে।
মিনু আজ মনকে তার জীবনের কাহিনি বলছে, বন্যা এসেছে। আমাদের তখন মাটির দোতলা বাড়ি। আমি, বিরাজুল, সামিম সবাই শুনছি।
সে বলছে, কাকিমা রান্না সেরে নিচ্ছেন। বন্যার ঢেউ মাটির দেওয়ালে ধাক্কা মারছে। মাটির দেওয়াল জলের ধাক্কায় পড়ে গেলো। মা কান্নাকাটি শুরু করলেন। বললেন, কত কষ্ট করে এই বাড়ি হয়েছে। আর হবে না আমার বাড়ি। কাকু বললেন, চলে এসো পাকা বাড়িতে।
বেঁচে থাকলে আবার হবে বাড়ি। আমাদের সবাইকে নিয়ে মা কাকুদের বাড়ি চলে এলেন। দুদিন আমরা অই বাড়িতে ছিলাম। আখের গুড় আর ছোলা ভিজে খেলাম সবাই। গোপালদা গরু মোষ দেখার জন্য নীচে ছিল।
সে বলল, আমি দেখ এখানে বসে আছি। বাবু বলল, গোপাল দা তোমার পাশে শাঁখামুটি সাপ। গোপালদা বলল, ভয় নেই আমার। ওরাও জলে থাকতে পারছে না। থাকুক কিছু করবে না।
সারারাত সে সাপের সঙ্গেই ছিলো। দড়ি যেমন শান্ত হয়ে পড়ে থাকে। সাপটাও জলের ভয়ে মানুষের সঙ্গে ছিলো। কিছু ক্ষতি হয় নি। বিপদে সবাই মিলেমিশে থাকে। বললেন গোপালদা। তারপর বন্যার জল নেমে গেলে বাবা, গোপালদা দুজনে মিলে পাকা ঘরটার কাদা বালি পরিস্কার করে জিনিসপত্র নিয়ে এলেন। মাটির বাড়িটা পড়ে গেছে। বড্ড ফাঁকা লাগছে।
পাকা ঘর একটা পাড়ায়। ঠিক যেন, মরুভূমিতে মরূদ্যান। সেখানেই আমরা সবাই একসাথে বাস করতে লাগলাম। আমরা এখন পাঁচজন। তিন ভাই আর বাবা, মা। কাকিমা দুই বোনকে নিয়ে কাটোয়ায় থাকেন। কাকিমা চাকরি পাওয়ার পর কাটোয়া চলে এলেন যাতায়াতের অসুবিধার জন্য। তারপর আবার প্রকৃতির নিয়মে নতুন বছর এলো।
নতুন বছরে নতুন মন নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার স্পৃহা জেগে ওঠে মিনুর। ঠিক সাপের খোলোস ছাড়ার মত। তারপর এই ইচ্ছেটা ধরে রাখাই খুব কঠিন কাজ বলে মনে হয়। প্রথম প্রথম কবিতা লিখতে এসে, নতুন কবির পাতার পর পাতা ভরে যায়। কিন্তু যখন কোবিতা, কবিতা হয়ে ধরা দেয় ভাষা যায় ফুরিয়ে। ছ’মাসে, ন’মাসে হয়ত একটা কবিতা ধরা দেয়।
এখানেই মহাপুরুষের সঙ্গে আমাদের পার্থক্য। তাঁরা হাল ছাড়েন না। লেগে থাকেন। আর লেগে থাকলেই হবে। যে কোনো কাজে সফল হওয়া যাবেই। প্রেমে লেগে থাকলেই হবে। পড়াশোনায় তাই। লেখা-জোখা সমস্ত কিছুতেই লেগে থাকলেই, চর্চা করলেই সফলতা পাওয়া যায়। তাই লেগে থাকতে হবে।
বিফলতাগুলো সফলতার এক একটা স্তম্ভ। বাবা এইসব কথা আমাদের বলতেন। বাবা চাষবাস দেখাশোনা করতেন আর বড়দা লিলুয়ায় চাকরি করতেন একটা বড় স্টিল কারখানায়। আমি গ্রামের স্কুল থেকে হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে হাওড়া নরসিংহ দত্ত কলেজে ভর্তি হলাম।
লিলুয়া শহরে যখন ভাড়াটে হিসাবে ঘর ভাড়া নিয়ে থাকতাম চার ভাইবোন, তখন আমরা নিজেরাই রান্নাবান্না করে নিতাম। উনুন ধরিয়ে আঁচ দেওয়া, বাসনমাজা সবকিছু নিজেরাই করতাম। খাবার জল আনতে যেতে হত দু কিলোমিটার দূরে। বালতি নামাতে নামাতে আনতাম খাবার জল।
কোনদিন আমার পালা পরত। ছোটোবেলা থেকেই এখানে কাটিয়েছি মা, বাবার সঙ্গে। তখন ভাল লাগত। আর এখন মা বাবা এখানে নেই। ভাল লাগত না। মনে হত যাই ছুটে মায়ের কোলে। যেতে পারতাম না। রোজগার করতে হবে। বসে বসে খেলে ত হবে না। বড়দা বলতেন, তোর যখন মন হবে বাড়ি চলে যাবি।
মেজদা বলতেন, যা, মায়ের কাছে যা। এখানে তোর ভালো লাগবে না। কিন্তু আমার মনে একটা অপরাধবোধ কাজ করত। বসে বসে খাব। এটা চিন্তা করতেই মন খারাপ হয়ে যেত। তখন গ্রাজুয়েট হয়ে গেছি। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ছাত্র পড়াই। আর ফাঁকা ঘরে আমি একা পড়তাম বিভূতিভূষণ, তারাশঙ্কর, রবীন্দ্রনাথ, মাণিক, শরৎচন্দ্র, নিমাই, শীর্ষেন্দু, শঙ্কর ও আরো অনেকের লেখা। মায়ের অভাব, তাদের লেখাই ভুলিয়ে দিতো নিমেষে। কিন্তু অতিরিক্ত নাটক, কবিতা, গল্প পড়ার ফলে আমার চাকরি বাকরি হয়নি। গোড়া, গৌতম, গোবিন্দ, অসীম আসতো বাসায়।
দাদার কাছ থেকে চলে এলাম মায়ের কাছে ছোটো ভাইয়ের হাত ধরে। শিবলুন স্টেশনে নেমে মাটির গন্ধে আমি আত্মহারা হয়ে গেলাম। মাটির স্পর্শ পেলাম। তারপর বাড়ি গিয়ে মা কে দেখে চোখে জল চলে এল। মায়ের চোখেও জল। তারপর সহজভাবে গ্রাম্য পরিবেশে মিশে গেলাম। ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের নিয়ে খোলা মাঠে বোসতাম। গল্প শোনাতাম।
এদিকে শুরু করলাম তিন ভাই মিলে গানের ক্লাস। তারপর আমার বিয়ে হোলো কাশীরাম দাসের জম্মস্থান সিঙ্গি গ্রামে। মনে আছে বন্ধুদের পাল্লায় পরে কাটোয়া এনিস সেলুনে ফেসিয়াল করেছিলাম। ফলে বিয়ের ছবিগুলো খুব সুন্দর হয়েছিল। বিয়ের তিন বছরের মধ্যেই পুত্র সন্তান হোলো। ভাই নাম রাখলো সৈকত।
এবার জীবিকার সন্ধানে চলে এলাম কাটোয়া শহরে। সস্তার জায়গা দেখে বাড়ি বানালাম। বেড়া দিয়ে ঘিরলাম জমি। কিছু গাছ লাগালাম। গ্রামের পরিবেশ। এটাই আমার সাদা কালো জীবনে বেশ খাপ খায়। তারপর মরণের সঙ্গে সহবাস। সস্তার সাত অবস্থা। সাপের অত্যাচারে অতিষ্ঠ হলেও পালাবার পথ বন্ধ। মায়ার শেকল পায়ে জড়িয়ে গেছে। সামনে গঙ্গা নদী।
ভয়ের চোটে আমি স্বপ্নে দেখছি আমি গঙ্গা নদীর জলে ডুবে গেছি। কিছুক্ষণ জলের তলায় পড়ে থাকলাম। তারপর ফুলে ফেঁপে ভেসে উঠলাম। পেট ফোলা দেখে একটা কাক এসে বসলো আমার উপরে। তারপর খুঁটে খেতে লাগলো পেটের চর্বি। পেট ফুটো হলেই জল ঢুকতে শুরু করলো। আবার আমার দেহ চলে গেলো জলের তলায়। এবার কুমীর, বোয়াল মাছে খেতে লাগলো আমার দেহের মাংস। শেষে কুমীরটা গিলে ফেললো আমার কংকাল শরীর। কুমীরটা, খাওয়ার পরে সাঁতার কেটে চলে গেলো আনন্দে। আমি দেহ শূন্য হয়ে উড়তে উড়তে আকাশের পথে চলেছি। আমি এখন আমার মৃত দাদু, বাবা, ঠাকুমা সবাইকে দেখতে পাচ্ছি। তারা এক একটা তারা হয়ে জ্বলজ্বল করছে। আমি থমকে গেছি। তাদের কাছে যেতে পারছি না। দাদু এগিয়ে এসে নিজের আলো ছড়িয়ে দিলেন আমার দিকে। আমি তার সঙ্গে চলতে শুরু করলাম। তাদের মাঝে আমারো জায়গা হোলো।
আমি মাঝে মাঝে গ্রামে যাই। মায়ের কাছে। মাটির কাছে। এবার গ্রামে গিয়ে দেখলাম, গোস্বামি বাড়িতে রাধামাধব এসেছেন।
রাধামাধাব আসলে আমাদের গ্রাম বৃন্দাবন হয়ে উঠত। ঘরে ঘরে হরিনাম হত। আমরা নিমন্ত্রণ পেতাম সাতদিন ধরে। গোস্বামি বাড়ির পুজোতলায় রাতে বসত কীর্তনের আসর। রাধার উজাড় করা প্রেমের কাহিনি শুনে মা, পিসির চোখে জল বাঁধ মানত না।
মিনু বলে চলেছে তার জীবনের গল্প, আমার মা মহাভারতের অনেক গল্প বলতেন। আমাদের ছোটোবেলাতে অনেক গল্প শুনে মুখস্ত হয়ে গেছিল। রামায়ণের গল্প সুর করে পড়ে শোনাতেন আমার দাদু। দাদু ভাল গান করতেন একতারা বাজিয়ে। তখনকার দিনে যাত্রা শিল্পে মহিলা পাওয়া কঠিন ছিল। আমার দাদু মহিলা সেজে স্টেজে অভিনয় করতেন। বেশ ছিল ছোটোবেলার দিনগুলো। এখন বয়স বেড়েছে। আবেগ এখন পাগলামি বলে মনে হয়। অথচ এই পাগলামি ছিলো বলেই দাদু এত নামকরা শিল্পী হয়েছিলেন।
মিনুর দেশপ্রেম, মানবপ্রেম দেখে আমরা তার ভক্ত হয়ে পড়েছিলাম। সব জাতির মিলনে সে স্বছন্দ বোধ করত। তারপর, মিনু সমাজসেবার দল করেছিলো। প্রায় কুড়ি বছর মানুষের সেবার কাজে সংযুক্ত ছিল। বীরভূমের বাড়িতে থাকে সে। একদিন মা বাবাকে প্রণাম করে একদম আদুল গায়ে গামছা জড়িয়ে বন্ধুদের সঙ্গে চলে গেলো বক্রেশ্বর নদীতে। ওর সঙ্গে মনও ছিলো। মন দেখল অনেক উঁচু লাল টিলা থেকে লাফিয়ে নদীর জলে ঝাঁপ দিলো। তার পরেই বন্ধুরা। তারপর মিনু গান ধরলো,”ও আমার দেশের মাটি,তোমার পরে ঠেকাই মাথা”। মন ওর গান শুনে মুগ্ধ। বড় মানবপ্রেমিক এই যুবক একসঙ্গেই বড় হয়েছে।
মিনু এখন বুড়ো হয়েছে। খক খক করে কাশি হয় সারাদিন। হাঁফায়, হাঁটতে কষ্ট হয়। তবু ভালোবাসতে জানে মানুষকে। মন দেখে মিনুর আবেগ বেশি, সহজেই লোককে বিশ্বাস করে ফেলে। মন তাকে সাবধান করে। সে বলে, এখন সকলে প্রফেশনাল, ইমোশনাল হলেই ঠকবে। মিনু হাসে, তবু সে ঠকে, ভালোবাসে।
তারপর চারপেয়ে রথ আসে। স্বপ্নে, জাগরণে দেখা দেয় মিনুর চোখে। সব কী শূন্য। তা বটে। তবে জানালার ধারে বসে পাখির ডানায় ভর করে উড়ে যাওয়া কিন্তু মিথ্যা নয়। মিথ্যে নয় পুকুরের জলে একডুবে ওপাড়ে ভেসে ওঠা। মিথ্যে নয় জীবন, মিথ্যে নয় ভালোবাসা, প্রেম।
মিনু আর মন বসে থাকে অজয় নদের পাড়ে, প্রতিদিন বিকেলে। শজারু কাশবনে ঢোকে, কাঠবিড়ালি কাছে আসে। ফড়িং ওড়ে রঙ বেরঙের, শালিক, চড়ুই, মাছরাঙা আর পানকৌড়ি তাদের খেলা দেখায়। একটা সাপ এঁকে বেঁকে চলে যায় কোন সুদূরে। মিনু জানে কেউ কেউ বুড়ো হয় না, ছেলেমানুষী জীবন ভালো লাগে তাদের। তারা আয়নার সামনে নাচে, গায়, উলঙ্গ হয়ে কথা বলে। মিনুর পায়ের কাছে রঙীন মেঘ উড়ে আসে জলছবি হয়ে, রঙীন মাছ, শরতের আকাশ। এগুলো কী কম পাওনা।
মন একই সময়ের সঙ্গী হয়েও মিনুর মনের খেই ধরতে পারে না। তার কাছে মেঘ ধরা দেয় না, কাশফুলের বনে সে ফড়িং খোঁজে না। জীবনের চলার পথে সংসারের খুটিনাটি তার নজরে আসে। সে উঠে পড়ে, এবার সন্ধ্যা নেমেছে, বাড়িতে চিন্তা করবে। সে মিনুকে ডাকে পাড় থেকে, মিনু ফিরে আয়, সন্ধ্যা হয়েছে, এখন জলে নামিস না,ঠাণ্ডা লেগে যাবে।
মিনু অজয় নদের জলে নামে। হাঁটুজলে, বুকজলে, ধীরে মাথা ডোবে জলে।