সেতু (ছোটোগল্প)
দেবাশ্রিতা চৌধুরী
ছোট্টবেলায় মেয়ে বললো — মা তুমি কবে মরে যাবে!
মরো না কেন? অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেন রে? আমি মরে গেলে তোর কী লাভ! উত্তর এলো — তোমার আলমারিতে কী আছে দেখবো। হাসতে হাসতে আমার চোখে জল এল। নে, চাবি দিয়ে খুলে দেখ। অপার আগ্রহে আলমারি খুলে পাঁচ মিনিটের মাথায় ঠোঁট বেঁকিয়ে চাবি ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে কাঁদতে বসলো। কি রে কী হলো! বললো — এই ক’টা শাড়ি, চুড়ি! আমি ভাবলাম কী জানি আছে! মা তুমি মোরো না তাহলে — বলে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো। আমার খুব লজ্জা হলো।
সত্যিই সারাজীবন কত অপ্রয়োজনীয় বস্তু জড়ো করে আগলে বসে থাকি।
সেদিন একটা ছোট্ট পাঁচ বছরের শিশুর কাছে হেরে গেলাম যেন! চাবি তারপর থেকে খোলা জায়গায় টানানো থাকে। যেদিন সেই পরম বস্তুটি বুকের মাঝে রাখতে পারবো, সেদিন হয়তো আর আড়ালের প্রয়োজন হবে না। কী সেই হারানিধি! তাকে আর কবে পাবো, যাকে অকাতরে বিলিয়ে সুখ!
এখন বললে অবশ্য সে লজ্জিত হয়, আর আমি প্রাণপণে চেষ্টা করি খুঁজতে, পেলে তাকে দিতে পারতাম।
কথাগুলো বলতে বলতে নীরা হাউহাউ করে কাঁদছিল। সুচরিতা ওর মাথায় হাত বোলাতে বোলাতে বলছে — কাঁদিস না। তোর আর কিছুই করার নেই রে। সময় বড় নিষ্ঠুর, সব মেনে নিতে হয়।
তিরিশ বছর আগের কথাগুলো এভাবে সত্যি হয়ে যাবে কে জানতো?
সমীরের চলে যাওয়ার পর নীরা বুঝতে পারলো ! সে যে জীবনভর তাকেই খুঁজেছে!
সুশান্তকে ভালোবেসে নীরা বিয়ে করতে বাধ্য হয়েছিল সমীরকে, কারণ কয়েকদিনের অবাধ মেলামেশার ফলাফল গাছ ধরছে টের পাওয়ায় সুশান্ত’র ভালোবাসা উবে গেছে, নীরাকে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরিয়ে সামাজিক মর্যাদা ও সন্তানের পিতৃত্বের দায় নিয়ে তিরিশ বছর একসাথে থেকেও নদীর দুইপারের মত জীবন কাটিয়েছে সমীর ও নীরা। মাঝখানে ছিল সেতুর মতই সেতু। বিয়ের তিন বছর পর স্বামীর চাকরিসূত্রে সেতু বিদেশে চলে যাওয়ার পর, সমীর নীরার কাছে ছুটি চাইলো।
না, সমীর জীবন থেকে ছুটি চায়নি। তার পৃথিবীতে আর কিছু চাওয়ার নেই, এখন মুক্তির স্বাদ নিতে সে দু’চোখ ভরে খোলা আকাশের নীচের রঙ তুলির আঁকা ছবিতে নিজেকে খুঁজবে। তার জন্য আর কোনো বন্ধন রইলো না। শৈশবের ভালোবাসা যখন অসহায় হয়েছে তখন তার সব কলঙ্ক মাথায় নিয়েছে সমীর, প্রতিদান চায়নি, কোনো স্বীকৃতি চায়নি। এবার মুক্তি।
সমীর কিন্তু জানতে পারলো না নীরা যে পরম বস্তুটির সন্ধান এত বছরেও পায়নি, আজ তাকেই আকুল হয়ে খুঁজে চলেছে। তাদের মাঝখানে থাকা সেতুটার দূরত্ব শুধু বেড়েই চলেছে, হয়তো…হয়তো একদিন সেটি কংক্রিটের শক্ত গাঁথুনিতে গাঁথা হবে, পার হয়ে আসা দু’জনের সহজ হবে। কারণ দূরত্ব নৈকট্যের কাছে ডেকে আনে। কি জানি হয়তো হবে না। সময়ই দেবে উত্তর…