সম্পত্তি – সদানন্দ সিংহ

সম্পত্তি          (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

নদীর পারের জমি বেদখল করে করে এখানে একটা বড় বস্তি গড়ে উঠেছে। এই বস্তির পুরুষ লোকেরা কেউ দিনমজদুর, কেউ রিক্সাচালক, কেউ ইট ভেঙে বিক্রি করে, কেউ বাজারে মাছ বিক্রি করে, কেউ শাকসবজি বিক্রি — এইসব বিভিন্ন কৃচ্ছ্বকর্ম করে জীবনধারণ করে। আর মহিলারা বেশির ভাগ গৃহপরিচারিকার কাজ করে।
সুখলাল এই বস্তিরই একজন লোক। বৌ নিয়ে সংসার করে।

সুখলালের মনে ইদানীং একটা প্রশান্তি এসেছে। কারণ তার হাতে কিছু সম্পদ যেন এসেছে। সেগুলি হচ্ছে কিছু অচল টাকা। দশ-বিশ-পঞ্চাশ নয়, একেবারে পাঁচশ টাকার নোট। হ্যাঁ, কড়কড়ে পাঁচশ টাকার দশটি নোট। মানে পাঁচ হাজার টাকা। কিন্তু অচল। বাজারে যার মূল্য এখন একটুকুও নেই। তবে একদিন এই টাকার অনেক মূল্য ছিল।
মাস কয়েক আগে দোকানদার বাবুলাল একদিন পাঁচশ টাকার এই দশটি নোট সুখলালের দিকে বাড়িয়ে ধরে বলেছিল, এই নাও। ধর। এগুলি তুমি রাখবে কিনা বল।
সুখলাল অবাক হয়ে বলেছিল, এতোগুলো টাকা আপনি আমাকে কেন এমনিই দিচ্ছেন !
দোকানদার বাবুলাল বলেছিল, আরে এগুলো অচল টাকা। মোদীজির সিদ্ধান্তের শিকার। এগুলো এমন জায়গায় রেখেছিলাম ব্যাঙ্কে জমা দেবার সময়সীমার মধ্যে খুঁজে পাইনি। এগুলো আমার দরকার নেই আর। তুমি না রাখলে ড্রেনের জলে ফেলে দেবো।
সুখলাল নিজের কাছে কখনো পাঁচশো টাকার দশটি নোট রাখতে পারেনি, তাই তাড়াতাড়ি বলেছিল, দিন, দিন।

নোটগুলি অচল হলেও, সুখলালের কাছে কিন্তু এর মূল্য এখন অপরিসীম। এগুলি তাঁর একমাত্র সম্পত্তি। মাঝে মাঝে কেউ না থাকলে সে একা বিকেলে বা বৌ ঘুমিয়ে গেলে প্রতিদিন ঘুমোবার আগে সে পাঁচশ টাকার নোটগুলি বের করে চোখের সামনে মেলে ধরে প্রাণভরে দেখে। দেখে খুশি হয় । হাসে। তারপর ওগুলিকে সে পুরোনো খবরের ভাঁজের ভেতর রেখে সেটাকে তার ময়লা তোষকের নিচে যত্ন করে রাখে। রাত হলে গভীর ঘুমে তলিয়ে যায়। ঘুমিয়ে অনেক কিছু উদ্ভট স্বপ্ন দেখে। তবে দিনের বেলায় তার সেই স্বপ্নগুলি হারিয়ে যায়।

দিনের বেলায় সকাল থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রাম। সকালে পান্তা ভাত খেয়ে তার পুরোনো ঝরঝরে সাইকেলটা নিয়ে সে পুরানো খবরের কাগজ-বই-খাতা কেনার জন্যে অলিগলি ছেদিয়ে পাড়ার পর পাড়া পেরিয়ে প্রতিদিন মাইলের পর মাইল ঘুরে বেড়ায়। বিকেল গড়াতে শুরু হলেই সে তার কেনা পুরোনো কাগজ-বই-খাতাগুলি মহাজনের কাছে বিক্রি করে ঘরে ফিরে আসে। তারপর স্নান করে ভাত বেড়ে খায়। মায়ারানির তখন ফিরে আসবার সময় হয়নি। তাই সে তাদের পুরনো ডাব্বা টিভি চালিয়ে দূরদর্শনের চ্যানেল দেখে।

সুখলালের বৌ মায়ারানি রান্না-বান্না সেরে সকাল ন’টার দিকে বেরিয়ে যায়। মায়ারানি রমাদির বাচ্চাকে দেখাশুনার কাজ করে। রমাদি এবং দাদাবাবু সরকারি চাকুরি করেন এবং দুজনেই সাড়ে ন’টার দিকে আপিসে চলে যান। উনাদের একজন আপিস ছুটির পর ফিরে এ্লেই মায়ারানির ছুটি। তাই মায়ারানির ঘরে ফিরে আসতে ছ’টা-সাতটা বেজে যায়।

আর এও আশ্চর্য যে সুখলালের মতো লোকের গাঁজার নেশা নেই। মদের নেশাও নেই। বাচ্চা-কাচ্চাও নেই। একেবারে যেন নির্ভেজাল মানুষ।

কিন্তু এই নির্ভেজাল মানুষটিরই একদিন ভেজাল খুঁজে পায় মায়ারানি। বলে, তোমার চরিত্রটা দিনে দিনে খারাপ হয়ে যাচ্ছে দেখছি।
সুখলাল একটু অবাক, কী যা তা বলছ ?
— যা তা বলছি মানে ? আমার চোখ আছে। অন্ধ হইনি এখনো।
সুখলাল ভাবে পাঁচশ টাকা নোটগুলির কথা বলছে বুঝি মায়ারানি, সে তো এখনো মায়ারানিকে ওগুলো দেখায়নি কিনা। জিজ্ঞেস করে, কী দেখেছ তুমি ?
— শুকলালের বৌয়ের প্রতি তোমার কুনজর আমি কিছুদিন ধরে দেখছি।
শুনে সুখলাল কপাল চাপড়ায়, বলে, মোটেই না। আমি কুনজর দিইনি।
— তাহলে কি ? সুনজর দিচ্ছ তাহলে ?
— হ্যাঁ তাই। বলেই সুখলাল জিভ কামড়ায়, হায় রাম, কি বলতে কি বলে ফেলেছে নিজের বৌকে!

এদিকে মায়ারানি প্যান প্যান করে যায়, যা ভেবেছিলাম তাই। আমার চোখ কখনো মিথ্যা হতে পারে না। নিজের বৌকে একটা ভাল শাড়ি কিনে দেবার ক্ষমতা নেই, আবার অন্যের বৌয়ের প্রতি কুনজর ! এমন সোয়ামি থাকলেই কি আর না থাকলেই কি। শুকলালের বৌটাও এক হারামজাদি। লজ্জা-শরম বলে কিছুই নেই, হাঁ করে পরপুরুষের দিকে চেয়ে থাকে ……।

শুকলাল ব্যাটারি লাগানো রিক্সা চালায়। তবে তার বৌটার যৌবন যেন ফেটে বেরুয়। রং শ্যামলা হলেও সেজে বেরুলে তাকে হাঁ করে চেয়ে থাকতে ইচ্ছে হয়। এটা সত্যিই যে শুকলালের বৌয়ের সঙ্গে ইদানীং সুখলালের একটা দড়ি টানাটানির খেলা চলছে।
এই খেলাটা শুরু হয়েছিল সপ্তাহ খানেক আগে। সেদিন বিকেলে ঘরে ফিরে স্নান সেরে ভাত খেয়ে মৌজ হয়ে পাঁচশ টাকার নোটগুলি বের করে চোখের সামনে মেলে একাগ্র দৃষ্টিতে দেখছিল। আর এই সময়েই কিনা অনাহত রবাহূতের মত শুকলালের বৌটা দুম করে ঘরে ঢুকে গেছিল। তাকে হঠাৎ করে ঘরে ঢুকতে দেখে সুখলাল থতোমতো খেয়ে চটপট টাকাগুলি বালিশের নিচে লুকোয়। কিন্তু ততক্ষণে শুকলালের বৌ যা দেখার সব দেখে ফেলেছে, তাই আশ্চর্য হয়ে বলে, এ মা, দাদার কাছে তো অনেক টাকা ! কথাগুলি শুনে সুখলাল পাশ কাটানোর চেষ্টা করে, না, ওটা কিছু না। কাগজ।
— ওটা কিছু না মানে ? তাহলে এ রকম আরো অনেক আছে।
— না নেই। কেন এলে এবার বলো।
আসার কারণটা এবার জানা যায়। কিছু লবণ দরকার। সুখলাল তাড়াতাড়ি এক কাপ লবণ দিয়ে তাকে বিদেয় করে।
তারপর থেকে সুখলাল দেখেছে শুকলালের বৌটা তাকে দেখলেই একদৃষ্টে চেয়ে থাকে। ফিক করে হাসে। আর সেটা সুখলালেরও ভালো লাগে, পর নারীর প্রতি একটা আকর্ষণ বোধ করে।

কিছুদিন গেলে সুখলাল টের পায় বস্তির প্রায় সবাই তাকে দেখলে একটু হাঁ করে চেয়ে থাকে। শুকলালের বৌ মারফৎ প্রচার হয়ে গেছে সুখলালের কাছে অঢেল পাঁচশ টাকার নোট আছে। বস্তিতে সুখলালের সম্মানও বাড়তে থাকে। আগে যারা কথা বলত না, তারা এখন নিজ থেকে এগিয়ে এসে কথাবার্তা বলে। কুশল বিনিময় করে। এটা সুখলালের ভালোও লাগে। তবে কাজেকর্মে ব্যস্ত মায়ারানি এসব টের পায় না।

কিন্তু সুখলালের সে সম্মান বেশিদিন টিকে থাকে না। একদিন বিকেলে বাড়ি ফিরে এসে সে দেখে তার ঘরের তালা ভাঙা। ভেতরে ঢুকে দেখে বিছানাপত্তর উলটপালট। পুরোনো খবরের কাগজ যার ভাঁজে পাঁচশ টাকাগুলি রেখেছিল, সে খবরের কাগজটা নিচে পড়ে আছে। সেটা তুলে সে দেখে পাঁচশ টাকার নোটগুলি নেই।
ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে সুখলাল চিৎকার করে, চোর চোর। কাছাকাছি লোকজন সব চলে আসে। দরজায় লটকানো ভাঙা তালাটা দেখে। ঘরের ভেতরে গিয়ে উলটপালট বিছানাপত্তর দেখে। তারপর সুখলালকে জিজ্ঞেস করে, কত টাকা চুরি হল গো ? এর উত্তরে সুখলাল কী জবাব দেবে প্রথমে ঠিক ভেবে পায় না। তারপর বলে, সে হাজার পাঁচেক টাকা। সুখলালের উত্তর শুনে লোকজন পরস্পর বলাবলি করে, ওটা পাঁচ না, পঞ্চাশ হাজার, আর অসৎ উপায়ে উপার্জন করা টাকা এভাবেই চলে যায়। লোকজনরা পরামর্শ দেয়, থানায় জানাও, চোর ধরা পড়বেই। সুখলাল জবাব দেয়, না, পুলিশি ঝামেলার দরকার নেই; যা গেছে যাক গে। সুখলালের জবাব শুনে লোকজনের ধারণা আরো দৃঢ় হয়, চুরি যাওয়া টাকাগুলি সব অসৎ উপায়ে উপার্জন করা। লোকজনেরা একে একে একসময় চলে যায়।

সন্ধ্যের পর মায়ারানি যখন ঘরে ফিরছে তখন রাস্তাতেই বস্তির লোকেরা চুরির ব্যাপারটা সব তাকে জানিয়ে দেয়। ঘরে ফিরে সে দেখে সুখলাল ঘরের পুরনো ডাব্বা টিভিতে দূরদর্শনের ফ্রী চ্যানেলগুলি রিমোটের সাহায্যে পালটিয়ে যাচ্ছে, তাকে দেখেও কিছু বলছে না। ব্যাপার দেখে মায়ারানির মেজাজ চড়ে যায়, বলে, আমি কি তোমার কেউ না ? ঘরে এত বড় একটা চুরি হয়ে গেল, আমাকে কিছুই জানালে না। এসব আমায় জানতে হল বস্তির লোকদের কাছ থেকে ?
এবার সুখলাল নিজের বৌয়ের দিকে তাকায় এবং দেখে, বৌ রাগে ফুঁস ফুঁস করছে। কীভাবে সে শুরু করবে ঠিক বুঝতে পারে না। বলে, তুমি আগে একটূ হাত-মুখ ধুয়ে ঠাণ্ডা হয়ে নাও, সব বলছি।
মায়ারানি গজরায়, জানি তুমি কী বলবে। বলবে কিছুই হয়নি। লোকজন সব বলছে পঞ্চাশ হাজার টাকা চুরি হয়ে গেছে। তোমার কাছে যে টাকা রয়েছে সেটা তো আমাকে কোনোদিন জানাও নি। আমি কি তোমার বৌ না ? সেই হারামজাদির সঙ্গে ফস্টিনস্টি করেই যাচ্ছ কিনা বুঝতে পারছি না।
সুখলাল বলার চেষ্টা করে, পঞ্চাশ নয়, পাঁচ হাজার। তোমাকে সব বুঝিয়ে বলছি, একটু ঠাণ্ডা হও আগে।
— অ্যাঁ। পাঁচ হাজার টাকা তোমার কাছে ছিল তাহলে। আমাকে জানাও নি একদম। নিশ্চয়ই ঐ হারামজাদি জানে।
এবার সুখলাল ভেবেই পায় না, কী করে মায়ারানিকে অচল টাকার সম্পত্তির কথা বলবে। আর এখন বললেও মায়ারানি সেটা হয়তো একদম বিশ্বাসই করবে না। সে তাই আবার বলে, কাউকেই আমি পাঁচ হাজার টাকার জানাই নি। বিশ্বাস করো, কারুর সঙ্গেও আমি ফস্টিনস্টিও করিনি।
সুখলাল উঠে মায়ারানির হাত ধরতে যায়। সঙ্গে সঙ্গে মায়ারানি এক ঝটকায় নিজের হাত ছাড়িয়ে চেঁচায়, খবরদার, আমাকে স্পর্শ করবে না। আমি তোমার কেনা সম্পত্তি নই।
সুখলাল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে। কোনটা তার সম্পত্তি, কোনটা তার নয়, কোনটা অচল সম্পত্তি আর কোনটাই বা সচল সম্পত্তি — তার মাথায় এখন একদম ঢোকে না।