অরণ্যদেব আর আমার ফ্ল্যাশব্যাক (ছোটোগল্প)
সদানন্দ সিংহ
ঝরনার ভেতর দিয়ে খুলিগুহার রাস্তা। সে রাস্তা আমি চিনি। আমার ভাইরা চেনে। হয়তো আপনিও চিনেন। আপনি হয়তো দেখেননি — প্রিয় তুফান, প্রিয় বাঘার সাথে অবিরাম আমি দৌড়ে গেছি। আমি গুরানকে ভালোবাসি। গুরান আমাদের ভালোবাসে।
[ফ্ল্যাশব্যাকঃ- ছোটবেলায় কোনো হি-ম্যানকে আমরা জানতাম না, স্পাইডার-ম্যানকে জানতাম না। মোট কথা এখনকার সুপার হিরোরা তখন হয়তো ছিলো না। কী করেই বা থাকবে? টেলিভিশন তো অনেক পরের ব্যাপার, তখন কিছু কিছু ঘরে মাত্র রেডিও আসা শুরু হয়েছে। আমাদের বাড়িতে তখনো রেডিও ছিল না। হ্যাঁ, টারজানকে ভালো লাগত। টারজানের বই কিনে, বা কারুর কাছ থেকে কয়েক ঘন্টার জন্যে ধার করে এনে কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমি আর আমার ছোটভাই সহদেব একসঙ্গে পড়ে শেষ করে ফেলতাম। তবে টারজানকে সুপার হিরো বলে ভাবিনি।]
জঙ্গলের ঝোপের ভেতর লুকিয়ে ছিলাম অনেকক্ষণ এই রাতে। ঠিক কতক্ষণ, হিসেব নেই। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। জঙ্গি লোকগুলো আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে পেলেই গুলিতে ঝাঁঝরা করে দেবে। আমার ভাইকে করেছে। আমাকেও করবে। আমি পালাতে পেরেছিলাম। ওরা আমার পিছু নিয়েছে। আমার অপরাধ? আমি জানি না। কিন্তু আমি যে বাঁচতে চাই।
[ফ্ল্যাশব্যাকঃ- আমি স্কুল ছুটির পর আধা ঘন্টার জন্য চন্দনকাকুর কাছে চলে যেতাম। চন্দনকাকু রোগী মানুষ, হাড় জিরজিরে চেহেরা নিয়ে বারান্দায় চাটাইয়ের ওপর বসে বা শুয়ে থাকতেন। চন্দনকাকু অবিবাহিত, বয়স মনে হয় ত্রিশের নিচেই ছিল। চন্দনকাকুর বাবা-মা তাকে খুব সেবাযত্ন করতেন। শুধু জানতাম চন্দনকাকু কী এক দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত এবং মৃত পথযাত্রী। রোগটা কি আমি জামতাম না। এখন আমার মনে হয় রোগটা হয় যক্ষ্মা নইলে ক্যান্সার ছিল। সেখানে আমি বাদে অন্য কাউকে খুব একটা আসতে দেখতাম না। ছোঁয়াচে রোগ সম্বন্ধেও আমার কোনো জ্ঞানই ছিল না তখন। চন্দনকাকুর বাড়িতে আসত আনন্দবাজার পত্রিকা। ঐ আনন্দবাজার পত্রিকার জন্যই আমি প্রতিদিন চন্দনকাকুর কাছে যেতাম। উদ্দেশ্য ছিল একটাই, অরণ্যদেবের কমিকস পড়া। রবিবারে ছিল মেনড্রেকের কমিকস। অরণ্যদেবের কমিকস পড়তে পড়তে একাত্ম হয়ে যেতাম। নিজেকেই ভাবতাম অরণ্যদেব। বাড়ি ফিরে ছোটভাই সহদেবকে অরণ্যদেবের গল্প বলতাম। পরের দিন কি হতে পারে তাও আইডিয়া করে বলে দিতাম। তখন থেকেই আস্তে আস্তে অরণ্যদেবই আমার সুপার হিরো হয়ে উঠল।]
হ্যাঁ আমি বাঁচতে চাই। পলে পলে আমি পৃথিবীর বাতাসের ঘ্রাণ নিতে চাই। সে বাতাস আমার ফুসফুসের মাধ্যমে আমার প্রতিটি শিরায়-উপশিরায় ছড়িয়ে পড়বে। তারপর সেই রক্তের অনুরণন ঢেউ খেলে যাবে আমার হৃদয় থেকে মস্তিষ্কে। আমি তাই ঝোপ থেকে বেরিয়ে প্রাণপণে সামনে দৌড়ে যেতে থাকি। সামনের পাহাড়টা আমাকে অবশ্যই পেরিয়ে যেতে হবে।
[ফ্ল্যাশব্যাকঃ- আমাদের সবার ছোটভাই বুলুর বয়স যখন পাঁচ বছর তখন তাকে বোঝালাম আমিই অরণ্যদেব। তাকে আমি প্রায়ই জিজ্ঞেস করতাম, আচ্ছা বলতো, অরণ্যদেব কে? বুলু আমাকে দেখিয়ে বলতো, তুমি। তার উত্তর শুনে আমি খুশিতে ডগমগ হতাম। যাক, অন্তত একজন তো আমাকে অরণ্যদেব বলেছে। আমি মাকে-বাবাকে বলতাম, দেখো দেখো, বুলু আমাকে অরণ্যদেব বলেছে। মা-বাবা মুচকি মুচকি হাসতেন। পরে বুলু যখন আরো কিছু বড় হলো তখন একদিন সে নিজেকেই অরণ্যদেব বলে দেখিয়ে দিল। তারপর থেকে আমি আর ওকে জিজ্ঞেস করিনি, অরণ্যদেব কে?]
আমি প্রাণপণে দৌড়োচ্ছি। টিলা বেয়ে উঠতে আমার বেশ কষ্ট হচ্ছে। তবু এগোচ্ছি। আস্তে আস্তে অন্ধকার হারিয়ে যেতে থাকে, ধীরে ধীরে সকাল হচ্ছে। ঘন গাছপালার মাঝে পাখিদের কলকাকলি শুনতে পাচ্ছি। কিন্তু আমার শরীর যে আর চলছে না। কিন্তু আমাকে যে বাঁচতে হবে। জঙ্গিদের হাত থেকে আমাকে যে বাঁচতে হবে। নিরস্ত্র নিরপরাধ লোকদের হত্যাকারী জঙ্গিদের কাছে আমি কিছুতেই হার মানছি না। মনে আবার এক শক্তি চলে আসে। আমি বিধ্বস্ত শরীরে এগোতে থাকি।
[ফ্ল্যাশব্যাকঃ- আমাদের বাড়িতে জাগরণ পত্রিকা আসতো। জাগরণ পত্রিকা বন্ধ হয়ে গেলে দৈনিক সংবাদ পত্রিকা। পত্রিকা বিলি করতো নারায়ণ কাকা। বিরাট বড় এক বাণ্ডিল পত্রিকা সাইকেলের পেছনে চাপিয়ে নারায়ণ কাকা পত্রিকা বিলি করতেন। সেই পত্রিকার বাণ্ডিলের মধ্যে থাকতো কলকাতার বাংলা, ইংরেজি, স্থানীয় পত্রিকা – সবই। আর সাইকেলের সামনে ঝোলানো ব্যাগগুলিতে থাকতো বিভিন্ন বাংলা-ইংরেজির ম্যাগাজিন। এই নারায়ণ কাকার কাছেই খবর পেলাম অরণ্যদেব-মেনড্রেকের ইন্দ্রজাল কমিকস বইয়ের কথা। তারপর থেকেই আমি আর সহদেব দুজনে মিলে টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ইন্দ্রজাল কমিকসের বই কিনতে শুরু করেছিলাম। কবে ইন্দ্রজাল কমিকসের অরণ্যদেবের বই আসতে পারে তা আমরা নারায়ণ কাকার মারফৎ খবর পেতাম। তারপর আমরা দুজন হা করে তাকিয়ে অপেক্ষা করতাম নারায়ণ কাকার। নারায়ণ কাকার পরনে থাকতো ধুতি আর সার্ট। আমরা দেখতাম পুকুরের পাড় দিয়ে নারায়ণ কাকা তীব্র গতিতে সাইকেল চালিয়ে আসছেন। সাইকেলের পিছে পত্রপত্রিকার বিরাট বাণ্ডিল। নারায়ণ কাকাকে তীব্র গতি নিয়ে সাইকেল চালাতে দেখে আমাদের দুজনের কাছেই মনে হত অরণ্যদেব যেন ঘোড়ায় চড়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছেন। ফলে অরণ্যদেবের কথা মনে হলেই আমাদের মনে কমিকসের অরণ্যদেব এবং নারায়ণ কাকার ছবি একসঙ্গে ফুটে উঠতো।]
প্রায় এসে গেছি। পাহাড়ের চুড়োয়। এখন একদম সকাল হয়ে গেছে। তারপর একসময় পাহাড়ের চুড়ো পেরিয়ে আমি নিচে নামতে থাকি। গাছের গুঁড়ি বাঁচিয়ে পিছল খেয়ে দ্রুত নামতে থাকি। প্রাণ বাঁচাতে হলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে পাহাড় ছেড়ে উপত্যকার জনারণ্যে পৌঁছতে হবে।
[ফ্ল্যাশব্যাকঃ- ক্রমে ক্রমে আমরা বড় হচ্ছিলাম। বছরের পর বছর ধরে ইন্দ্রজাল কমিকসের বই কেনার ফলে আমাদের কাছে একসময় প্রচুর পরিমাণে অরণ্যদেব এবং জাদুকর মেনড্রেকের বই জমে গেল। জমানো কমিকসের বইগুলি আমরা বারবার পড়তাম। নতুন কমিকসের জন্যে হা করে অপেক্ষা করতাম কখন জোরে সাইকেল চালিয়ে আমাদের অরণ্যদেব নারায়ণ কাকা ছুটে আসবেন। কিন্তু বৃথা আমাদের সে অপেক্ষা। হঠাৎ একদিন নারায়ণ কাকা আমাদের সামনে থেকে যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। খোঁজ করেও কোনো খবর পেলাম না। বছর খানেক পর একজন খবর দিল নারায়ণ কাকার পরিবারের কেউ খুব অসুস্থ হলে তার প্রচুর ধার-দেনা হয়ে যায়। তারপর নারায়ণ কাকারা কাউকে কিছু না বলে কোথায় জানি চলে যান। খবরের সত্যতা আমি খুঁজিনি। তবে নারায়ণ কাকাকে কোনদিনই ভুলিনি। এখনো আমি দেখি, ধুতি পরা রক্তমাংসের অরণ্যদেব ঘোড়া চালিয়ে আমাদের দিকে ধেয়ে আসছেন।]
আমার পা কেটে রক্ত ঝরছে। হাত ক্ষতবিক্ষত। আমার জামা-প্যান্ট অনেক জায়গায় ছিঁড়ে গেছে। আমার দমও যেন শেষ হয়ে আসছে। আমি পাহাড়ের নিচের দিকে প্রায় গড়িয়েই নামছি। আমি ক্লান্তিতে অবসন্ন হয়ে পড়েছি। সামনে একটা ঝরনা দেখে একটু থামি। ঝরনার জল পাহাড়ের ওপর থেকে নেমে এসে এখানে এক জলপ্রপাতের মত তৈরি হয়েছে। কাছে গিয়ে আমি আঁজলা ভরে ঝরনার জল পান করতে থাকি। দু আঁজলা পান করতেই হঠাৎ চমকে ওঠি, একটা বুলেট ছুটে এসে আমার কানের পাশ দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমার বুঝতে বাকি থাকে না, জঙ্গির দল আমাকে দেখে ফেলেছে। মনে পড়ে যায়, পাহাড়ি ঝরনার জলের পেছনের দেয়ালের মাঝেই ছিল খুলিগুহার মুখ। আমি ঝরনার জলের মাঝে ঢুকে খাড়া পাহাড়ের দেয়ালে খুলিগুহার মুখ খুঁজতে থাকি। আমাকে যে বাঁচতে হবে। আমি যে বাঁচতে চাই। পৃথিবীটাকে প্রাণপণে উপভোগ করতে চাই।