গোবর্ধনের চাল – সদানন্দ সিংহ

গোবর্ধনের চাল – সদানন্দ সিংহ

গোবর্ধনের চাল     (ছোটোদের গল্প)
সদানন্দ সিংহ
আজ এপ্রিলের পাঁচ তারিখ। সামনে জংলিমামাকে এগিয়ে আসতে দেখে মাথায় একটা দুষ্টবুদ্ধি খেলে গেল। ভাবলাম একটা এপ্রিল ফুল করে দিই। হলই বা আজ এপ্রিলের পাঁচ তারিখ, কিন্তু এপ্রিলই তো, মে মাস তো আর হয়নি। যেই ভাবা সেই কাজ। জংলিমামাকে ডাক দিলাম, জটুমামা।
জংলিমামা পাশে এসে বলল, আজ দেখি জংলিমামা না বলে জটুমামা বলে ডাকছিস? কোন কু-মতলব আছে নাকি?
আমি হেসে বললাম, আরে না না। তোমাকে একটা খবর দেব বলেই ডাকছি।
কথাটা বলেই আমি একটু চিন্তায় পড়ে গেলাম। এপ্রিল ফুলটা কীভাবে করব তা তো ঠিকই করিনি। তাড়াতাড়ি ভাবতে লাগলাম, কী কী করা যায়?
এদিকে জংলিমামা বলে উঠল, ঠিক আছে, কী বলবি বল। আমাকে আবার এক্ষুনি ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আছে যেতে হবে। কী এক সমস্যার ব্যাপারে উনি আমার হেল্প চেয়েছেন।
মনে মনে বললাম, মিথ্যেবাদী কোথাকার! শুধু বড় বড় কথা। তোমাকে আমরা সবাই চিনি হে। মুখে বললাম, জানি জানি, তুমি বিখ্যাত লোক। তারপরই আগে পিছে চিন্তা না করে বলে দিলাম, গোবর্ধনদা মারা গেছেন।
জংলিমামা যেন চমকে উঠলেন, অ্যাঁ বলিস কি! এমন মিথ্যেকথা!
বললাম, ঠিক আছে। বিশ্বাস না করলে আমার কিছুই করার নেই।
— তাই বুঝি? ঠিক আছে, আমি ওদের বাড়ি যাচ্ছি। যদিও জানি তোদের মাথায় কেবল শয়তানী বুদ্ধি। খবরটা যদি মিথ্যে হয় তাহলে মনে রাখিস মোটেই ভালো হবে না।
— হ্যাঁ হ্যাঁ ঠিক আছে।
জংলিমামা চলে গেল। তখন বিকেল চারটে। আমিও ফুটবল খেলতে চলে গেলাম হিন্দি স্কুলের মাঠে। এই মাঠেই আমরা ফুটবল-ক্রিকেট অনেক কিছুই খেলি। খেলায় মত্ত হয়ে এপ্রিল ফুলের কথা ভুলেই গেলাম।
খেলা শেষ করে যখন বাড়ির দিকে ফিরছি তখন সন্ধ্যে হয় হয়। হঠাৎ শুনলাম পেছন থেকে আমার নাম ধরে কেউ ডাকছে, হা-বু দাঁড়াও। বলতে না বলতেই পেছনদিক থেকে এসে গোবর্ধনদা এক হাত দিয়ে আমার বাঁহাত খপ করে ধরে ফেললেন। গোবর্ধনদার আরেক হাতে একটা মূলি বাশঁ। সঙ্গে সঙ্গে আমার এপ্রিল ফুলের কথা মনে পড়ে গেল। মনে পড়ে গেল জংলিমামাকে আমি কী বলেছিলাম।
আমি কাঁচুমাচু হয়ে বললাম, হাতটা ছেড়ে দিন, লাগছে। আমি আসলে পঞ্চ দিবসীয় এপ্রিল ফুল করেছিলাম। জটুমামাকে বোকা বানিয়েছিলাম।
— মানে ?
— মানে আজ এপ্রিল মাসের পাঁচ তারিখ বলে পঞ্চ দিবসীয় এপ্রিল ফুল করেছিলাম জটুমামাকে।
গোবর্ধনদা যেন অবাক হলেন, জটুমামার কথা কোত্থেকে এল?
আমিও একটু অবাক হলাম, কেন? জটুমামার সঙ্গে দেখা হয়নি?
— না তো।
এবার আমিই বোকা বনে গেলাম। হতচ্ছাড়া জংলিমামা আমার চালাকিটা আগেই ধরে ফেলেছিল তাহলে!
গোবর্ধনদা এবার বললেন, সে যাক গে। এবার আমার বাড়ি চল। সেদিন আমি কলকাতার রসগোল্লা খাওয়াতে পারিনি। আজ আমি উদয়পুরের সন্দেশ খাওয়াবো। গতকাল আমি আর দাদা উদয়পুরে মায়ের মন্দিরে পুজো দিতে গিয়েছিলাম। এক পাতিল ভোগের সন্দেশ আছে। আহা খেতে কী যে স্বাদ সেই সন্দেশের! বার বার খেতে ইচ্ছে হয়।
সন্দেশের কথা শুনে আমিও আর লোভ সামলাতে পারলাম না। গোবর্ধনদার সঙ্গে রওনা দিলাম।
গোবর্ধনদার বাড়িতে ঢুকতে যেতেই দেখলাম হর্ষবর্ধনদা নিচে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। গোবর্ধনদা ঢুকেই বাঁশটা তাঁর দাদাকে ধরিয়ে দিলেন। হর্ষবর্ধনদা বলে উঠলেন, কী ব্যাপার, সেই দু ঘন্টা আগে পাঠালাম পাড়াতে কোন কাঠের দোকান আছে কিনা খোঁজ করতে, আর তুই আমাকে এই বাঁশ দিচ্ছিস?
গোবর্ধনদা একটু মনঃক্ষুণ্ণ হয়ে বললেন, তাই তো করেছি এতক্ষণ হেঁটে হেঁটে। শেষে কোন কাঠের দোকান না পেয়ে একটা বাঁশের দোকান পেয়ে গেলাম বলে স্যাম্পল হিসেবে একটা বাঁশ কিনে নিয়ে এলাম। দেখো না, বাঁশ দিয়ে কোন কিছু করা যায় কিনা।
— বলিস কি! ফার্নিচারের দোকান করব বলে কাঠের দোকানের কথা বলেছিলাম। বাঁশ দিয়ে কি ফার্নিচার করা যায়? তাজ্জব ব্যাপার।
কথাগুলি শুনে গোবর্ধনদা কী যেন ভাবলেন কিছুক্ষণ। তারপর আমাকে দেখিয়ে বললেন, এর নাম হাবু। এর বাবার কাঠের দোকান আছে।
শুনে আমি আকাশ থেকে পড়লাম, এসব কী বলছেন গোবর্ধনদা, এযে ডাহা মিথ্যে কথা। আমি তাড়াতাড়ি বলতে গেলাম, না মানে মানে …। কথাগুলি বলতে যেতেই গোবর্ধনদা আমাকে একটা চিমটি কেটে ফিসফিস করে বললেন, আগে সন্দেশগুলি খেয়ে নিই, তারপর আমি দাদাকে বুঝিয়ে বলব। সন্দেশের লোভে আমিও চুপ করে গেলাম।
বাবার কাঠের দোকান আছে শুনে হর্ষবর্ধনদা খুব খুশি হলেন। ঘরের ভেতরে আমাকে নিয়ে বসালেন। গোবর্ধনদা একটা প্লেটে অনেকগুলি সন্দেশ নিয়ে এলেন। সন্দেশ পেয়ে আমিও গপাগপ সন্দেশ খেতে আরম্ভ করলাম। এইসময় হর্ষবর্ধনদা কেন জানি ঘরে একটু ঢুকে গেলেন। অমনি হঠাৎ গোবর্ধনদাও দেখি আমার প্লেট থেকে গপাগপ করে সন্দেশ খেতে শুরু করলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই সব সন্দেশ শেষ। গোবর্ধনদা জানালেন, ঘরে আর সন্দেশ নেই।
এইসময় হর্ষবর্ধনদা বেরিয়ে এসে আমাদের কাছেই একটা চেয়ার টেনে বসলেন। তারপর আমার কাছে জানতে চাইলেন আমাদের দোকানে কী কী জাতের কাঠ আছে? ফুট প্রতি কাঠগুলির দাম কেমন?
আমি মহা ঝামেলায় পড়ে গেলাম, কী উত্তর দেব ভেবে পেলাম না। বলেই ফেললাম, আমাদের কোনো কাঠের দোকান নেই। বাবা চাকুরি করেন।
আমার কথা শুনে হর্ষবর্ধনদা আশ্চর্য হয়ে গেলেন।
গোবর্ধনদা হে হে করে হাসতে হাসতে বলতে লাগলেন, মানে দাদা, আমরা তোমাকে এপ্রিল ফুল করেছি।
হর্ষবর্ধনদা যেন একটু ক্ষেপে উঠলেন, অ্যাঁ, আজ এপ্রিলের পাঁচ তারিখে এপ্রিল ফুল! কী পেয়েছিস তোরা?
গোবর্ধনদা উত্তর দিলেন, জানি তো, তাই তো আমরা তোমাকে পঞ্চ দিবসীয় এপ্রিল ফুল করলাম। মে মাসে তো আর করিনি।

এসব দেখে বুঝে গেলাম আজ আমিই বোকা বনে গেছি। নিজের তৈরি বাণে নিজেই বিদ্ধ হয়েছি।