চুয়াল্লিশ নাম্বার
সদানন্দ সিংহ
বলরাম চুয়াল্লিশ নাম্বার বাসের নিত্যযাত্রী। তার প্রধান কারণ, অনায়াসে বসার জায়গা পাওয়া যায় এ বাসে; যেহেতু বাসটা এখান থেকেই যাত্রা শুরু করে। মাঝে মাঝে বাসস্ট্যান্ডে আসতে একটু দেরী হয়ে গেলে মিনিবাস, এসি বাস ইত্যাদি সামনে যা পায় সে তাতেই উঠে যায়। চুয়াল্লিশ নাম্বার বাসস্ট্যান্ডের একটু আগে অটোরিক্সা স্ট্যান্ড। ওখানে রোদের মাঝে লাইনে দাঁড়াতে হয় বলে সে চুয়াল্লিশের বাসেই যাতায়াত করে। জ্যাম না হলে মিনিট কুড়ির মধ্যেই সে উল্টাডাঙ্গা পৌঁছে যায়। তারপর উল্টাডাঙ্গা থেকে কাছেই ওর আপিস।
আজও সে চুয়াল্লিশের বাসে উঠে দেখে প্রতিবন্ধীর সীট বাদে অন্য সীটগুলোতে লোক বসে গেছে। এদিকে আবার একটু দেরী হয়ে গেছে। সে প্রতিবন্ধীর সীটেই বসে পড়ে। এই কুড়ি মিনিট সময়ের মধ্যে কদাচিৎ কোনো প্রতিবন্ধী কেউ এলেই তবে তাকে সীট ছেড়ে দিতে হবে। তবে সে সম্ভাবনা এক শতাংশ মাত্র। অর্থাৎ সেটা একশ দিনে একবার হতে পারে। তবে সে অনেকবার দেখেছে কেষ্টপুর থেকে কালো সানগ্লাস পরা একজন লোক অন্ধ সেজে প্রায়ই প্রতিবন্ধীর সীট দখলে নিয়ে নেয়।
বাসটা ছেড়ে দিয়েছে। বলরাম জানালার পাশে। তার পাশে এক স্কুল ছাত্র। আস্তে আস্তে বাসে ভিড়টা বাড়ছে। শেষে পা ফেলার জায়গা আর থাকে না।
দু-দুবার এই চুয়াল্লিশের বাসেই তার মোবাইল চুরি হয়ে গেছে। এখন আর পকেটে মোবাইল রাখে না সে। হাতেই ধরে রাখে। মোবাইল চুরি গেলে ঝামেলাও খুব। প্রথমত সেভ করা দরকারী ফোন নাম্বারগুলো হারিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত কাছাকাছি থানায় ডায়েরি করতে গেলে থানা থেকে সবসময় প্রথমেই জিজ্ঞেস করে, মোবাইলটা সঠিক কোন্ জায়গায় চুরি হয়েছে? তারপর থানা থেকে জানানো হয় ওই জায়গাটা অমুক থানার অধীনে।
সে প্রায়দিনই দেখে যে দুটো কালো বাচ্চা ছেলেমেয়ে এই ভিড়ে বাসে উঠে হিন্দি গান গেয়ে এদিক থেকে সেদিক যায় একটা পাত্র নিয়ে। আর দু-তিনটে যুবক ছেলে টপাটপ কুড়ি-পঞ্চাশ টাকা ছেলেমেয়ে দুটোর পাত্রে ছুঁড়ে দেয়। বলরাম জানে, এই দুটো ছেলেমেয়ে ঐ তিনটে যুবকেরই সাগরেদ। সে একদিন দেখেছে বাস থেকে নামার পর যুবকগুলো ছেলেমেয়ে দুটোর কাছ থেকে সব টাকাপয়সা নিয়ে নেয়। আজও এসেছে ওরা। তারপর সেই আগের দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি।
লেকটাউনে ছেলেমেয়েসুদ্ধ যুবকগুলো নেমে যায়। আর দুটো স্টপেজ পরেই উল্টাডাঙ্গা। বাসটা এগোতে থাকে। বলরাম আস্তে আস্তে দরজার দিকে এগোয়।
সামনের স্টপেজেই বলরাম নামবে। তাই সে পেছনের দরজার সামনে এসে দাঁড়ায়। এইসময় তার একদম বুক ঘেঁষে একটা লোক এসে দাঁড়িয়ে যায়। লোকটার বয়স ত্রিশের কাছাকাছি হবে। মাথার চুল কম; কালো এবং পরনে ময়লা শার্ট-প্যান্ট। বাসের গতিও খুব কম।
বাসটা থামার আগেই লোকটা হঠাৎ সামনের এক মহিলার গলার চেইন টেনে ছিঁড়ে বাস থেকে লাফিয়ে নেমে পেছনের দিকে দৌড়োতে থাকে। ব্যাপারটা বলরাম ছাড়া কেউ লক্ষই করেনি। চোখের সামনেই এরকম চেইন ছিনতাই বলরামও আগে কখনো দেখেনি। কী করবে ভেবে না পেয়ে বলরাম হঠাৎ চেঁচাতে থাকে, বাস থামাও। বাস থামাও। বাসের অন্য যাত্রীরা বলরামের দিকে তাকিয়ে একটু আশ্চর্য হয়ে বলে, আরে দাদা, আর পনের হাত দূরেই থামবে। সামনেই স্টপেজ। বলরাম টের পায়, সবাই খুব তাড়ার মধ্যে আছে, তার কথার কারণ জানার ইচ্ছে কারুরই নেই। বাসও থামে না। অগত্যা সে সেই মহিলাটির দিকে তাকায় যার গলার চেইন ছিনতাই হয়েছে। চোখাচোখি হতেই মহিলাটি মুচকি হাসেন। বলেন, ওটা ইমিটেশান।