অমূল্য হৃদয়
সদানন্দ সিংহ
আমাদের শরীরের ভেতরের-বাইরের সমস্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গই অমূল্য। অথচ এই অমূল্য অঙ্গগুলির মূল্য জানার খুব একটা চেষ্টা আমরা করি না। আস্তে আস্তে কালের প্রবাহের মধ্যে এগুলির মূল্য ফুরিয়ে যেতে থাকে। তবুই আমরা টের পাই না। তারপর একদিন হঠাৎ টের পাই হৃদয়ে এক বেড়াজাল এসে ঢং ঢং করে ঘন্টা বাজাচ্ছে। হৃদ্রোগ ধরা পড়েছে।
হৃদ্রোগ এমন একটি অবস্থা যা হার্ট এবং কার্ডিওভাসকুলার সিস্টেমকে প্রভাবিত করে। এটি বিভিন্ন কারণ যেমন ধূমপান, অস্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া এবং ব্যায়ামের অভাবের কারণে ঘটে। কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যে প্রতি চার জনের মধ্যে একজন হার্টের রোগে মারা যায়। যারা মারা যায় তাদের অর্ধেকেরও বেশি বয়স ৬৫ বছরের কম। হৃদ্রোগ মহিলাদেরও মৃত্যুর প্রধান কারণ। এরপর ফুসফুসের ক্যান্সার এবং স্ট্রোক।
কিন্তু যাদের হৃদ্রোগ আছে, তাদের জন্য সাধারণত চিকিৎসার একমাত্র উপায় হল ওষুধ। এটি সর্বোত্তম পন্থা হিসেবে দেখাতে পারলেও এটি মেজাজ পরিবর্তন, ওজন বৃদ্ধি এবং বমি বমি ভাবের মতো পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করতে পারে। হৃদ্রোগের জন্য প্রাকৃতিক প্রতিকারের এক-আকার-ফিট কোনো পদ্ধতি নেই; আপনি যা খুঁজছেন তার উপর এটি নির্ভর করবে। কিছু মানুষ ফাইবার বেশি বা কোলেস্টেরল কম এমন খাবার পছন্দ করতে পারেন। আবার কেউ হয়তো মনে করতে পারেন যে তারা যখন কম অ্যালকোহল পান করেন বা ধূমপান পুরোপুরি বন্ধ করেন তখন হয়তো তারা ভাল থাকবেন।
ভাল খবর হল যে এই রোগ প্রতিরোধ বা ধীর করতে সাহায্য করার জন্য কিছু উপায় বা প্রতিকার রয়েছে। ধূমপান, মদ্যপান, ব্যায়ামের অভাব এবং অস্বাস্থ্যকর ডায়েট এমন কিছু ব্যাপার যা হৃদ্রোগের কারণ হতে পারে, সেগুলিকে সিরিয়াস ভাবে নিয়ে বর্জন-গ্রহণের মাধ্যমে সঠিক জীবনযাপন করলে হৃদ্রোগ প্রতিরোধ করা বা সেটাকে ধীরগতিতে নিয়ে আসা অবশ্যি সম্ভব। ওষুধ ছাড়া হৃদ্রোগ প্রতিরোধের যে উপায়গুলি আছে সেগুলি তেমন কিছু কঠিন নয়। অতিরিক্ত তেল এবং তৈলাক্ত খাবার বর্জন কয়াই শ্রেয়। এছাড়া রেডমীট খাবার, সিগারেট এবং মদ খাওয়া বন্ধ করা – এসব মাথায় রাখা প্রয়োজন। আরেকটি উপায় হল স্বাস্থ্যকর খাবার যেমন ফল এবং সবজি খাওয়া এবং নিয়মিত ব্যায়াম করা। আরও কিছু প্রতিকার রয়েছে যা এই অবস্থার সাথে আমাদের দেহমনকে দৃঢ় করতে সাহায্য পারে। যেমন যোগ এবং ধ্যান।
কিন্তু মূল প্রশ্নটি হল, “আপনি কি জানেন আপনার হৃদ্যন্ত্র দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে কি না”? সাধারণত, উত্তরটি হবে, ‘না’। কারণ আমরা প্রাথমিক পর্যায়ে আমরা নিজেদের হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা সম্পর্কে চিন্তা করি না যদিও তখন হয়তো হৃদ্যন্ত্রটি ক্রমান্বয়ে খারাপ হয়ে গুরুতর আকার ধারণ করতে যাচ্ছে, যেহেতু সমস্যার কোন লক্ষণই দেখা যায়না এবং আমাদের দৈনন্দিন জীবনের মেয়াদ শেষ হওয়ার সময়ও হয়তো আমরা আমাদের হৃদযন্ত্রটিকে সুস্থ বলে মনে করতে থাকি। তার অবশ্য কারণও আছে। ধমনির ব্লকেজ শুরু হলেও আমাদের জানার বাইরে থাকে।
ধরুন, আপনার হার্টের ধমনী ব্লকেজ শুরু হয়েছে এবং এটি ৩০%পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। আপনার শরীরে কোন লক্ষণ থাকবে না, তাই আপনি সচেতন হবেন না। ধীরে ধীরে আপনার ব্লকেজ ক্রমান্বয়ে ৩০% থেকে ৪০%, ৪০% থেকে ৫০%, ৫০% থেকে ৬০% এবং শেষে ৬০% থেকে ৭০% বৃদ্ধি হয়ে গেল। তবুও আপনি বলতে পারেন, “আমি পাত্তা দিই না”। কারণ কোন উপসর্গও থাকবে না। যখন আপনার ব্লকেজ ধীরে ধীরে বেড়ে ৭০% থেকে ৮০% হচ্ছে, তখন আপনি সিঁড়ি বা চড়াইতে ওঠার সময় কিছুটা ক্লান্তি অনুভব করতে পারেন। এবং ৮০%এর উপরে যখন হতে থাকবে? তখন? তখন কিন্তু অবিলম্বে আপনার চিকিৎসা প্রয়োজন। কিন্তু সর্বাধিক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে চিকিৎসা ৯০% বা তার বেশি ব্লকেজ হলেই শুরু হচ্ছে। কারণ তখন অনেক উপসর্গই শরীরে ফুটে ওঠে এবং আপনি হয়তো তখন বিছানায়।
তাই আমি আবার বলতে চাই, “আপনি কি জানেন আপনার হৃদযন্ত্র দিনে দিনে খারাপ হচ্ছে কি না”? আবার উত্তর হবে একটি বড় ‘না’। কারণ হয়তো ৮০% ব্লকেজ নিয়েও আপনি সুস্থমনে জীবন অতিবাহিত করে চলেছেন।
তো এখন কি করা যায়? আমাদের হৃদয়টাকে সামলে রাখার জন্য?
উত্তর খুবই সহজ। ধূমপান বন্ধ করুন, অ্যালকোহল পরিহার করুন, নিয়মিত ব্যায়াম করুন এবং ফলমূল এবং শাকসবজির সঙ্গে স্বাস্থ্যকর খাবার খান। লাল মাংস এবং তৈলাক্ত খাবার কম খান বা বন্ধ করুন। ব্যায়াম করার সাথে সাথে সাধ্যানুযায়ী যোগ এবং ধ্যানও করুন।
সবকিছু অনুসরণ করা সহজ মনে হলেও কিন্তু ব্যাপারটি অত সহজ নয়। কারণ আধুনিক জীবনযাপনে অভ্যস্ত আমাদের আরামপ্রিয়তা ত্যাগ করা এবং সুস্বাদু খাবারের প্রতি লোভ দমন করার মতো কাজগুলি করা খুব কঠিন ওঠে। এই কঠিন ব্যাপারটি যিনি জয় করতে পারবেন তিনিই একমাত্র তার অমূল্য হৃদয়কে অনেকদিন রক্ষা করতে পারবেন।