সমাজবাবু – দেবাশ্রিতা চৌধুরী

সমাজবাবু      (ছোটোগল্প)

দেবাশ্রিতা চৌধুরী

“আন্ধার রাইতে আসমান জমিন
ফারাক কইরা থোও
বন্ধু কত ঘুমাইবা
ডাইনে পোলা বাঁয়ে মাইয়া
আকাল ফসল রোও
বন্ধু কত ঘুমাইবা…”?

ঠাকুমার মুখে এই গান শুনতে শুনতে বৃন্দার মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। অর্থ-টর্থ তেমন বোঝেনি। কেমন করেই বা বুঝবে! আকাল তো তার জীবনে লেগেই আছে। আকাল শব্দটি সে এভাবেই বোঝে অর্থাৎ অভাবের সঙ্গে সমার্থক হয়ে আছে। এত ব্যবচ্ছেদ করে বোঝার মত শিক্ষা তো পায়নি! রোজ রাতে তবুও এই কয়টি লাইন মনে পড়ে। ঘুম! তাও কী ঠিকমত হয়? ছেলে মেয়ে দুটো ঘুমিয়ে গেলে ভাবে দু’চোখের পাতা এক করবে, তখনই শুরু হয়ে গেল খামচাখামচি, খোঁচাখুঁচি। বৃন্দা এখন চোখ বুজে পড়ে থাকে, শরীর থেকে মন আলগা করে নেয়।

–– নে কত খাবি খা ইচ্ছামত। মাঝে মাঝে ঘুমিয়ে পড়লে সেদিন প্রচণ্ড মার খেতে হয়।
–– এত ঘুম কীসের? হ্যাঁ, এত ঘুম? ঘুম তর বাইর করুম।

দুলতে দুলতে বৃন্দা খাল থেকে সাগরে চলে যায়। উপরের মানুষ বুঝতে পারে কি পারে না!
অথৈ নোনা জলে সাঁতার কাটতে কাটতে কয়েক ঢোক নুনজল মুখে যেতেই দেখে চোখের জল জিহ্বায়। পরেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে বৃন্দার দিকে। কী যে হয় মাঝে মাঝে বুঝতে পারে না। দশ বছর ঘর করার পর, দুই ছেলে মেয়ের জন্ম হবার পরেও চিনতে পারে নি নীচের মানুষটিকে।
সীমাহীন সাগরে ভাসতে ভাসতে বৃন্দা তখন উপকূল ছাড়িয়ে অনেক দূরে…প্রায় মাঝ সমুদ্রে।…

পড়ার টেবিলের ওপাশে চশমা চোখে সমাজবাবু। ওরা এ নামেই ডাকতো তাকে।

কেউ হয়তো বলেছিল। একদল যুবক যুবতী বস্তিতে এসে ওদের অনেক কিছু শেখাতো, যাদের লেখা পড়ায় আগ্রহ ছিল তাদের সাহায্য করতো, আর যাদের ছিল না তাদের আগ্রহ জাগাতে চেষ্টা করতো।
তো, বৃন্দা ওর ঠেলা চালানো বাবা আর পাঁচ বাড়িতে কাজ করা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল বলে তারা খুব উৎসাহী হয়ে উঠল। পড়াশুনা শিখিয়ে যদি এক ধাপ উপরে তোলা যায়। বাবুদের বাড়ির ছেলে মেয়ের মত স্কুলে যাবে, চাকরি করবে। তাদের আর বস্তিতে থাকতে হবে না — স্কুলে ভর্তি করেই দিল বৃন্দাকে ওর বাবা।
স্কুলের দিদিমণি শুনে বলেছেন ওরা সব সমাজ সংস্কারক। সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষের জন্য কাজ করে, অল্পবয়সী ছেলেমেয়েগুলোর খুব প্রশংসা করেছেন দিদিমণি। সেই থেকে বৃন্দা প্রণবকে সমাজবাবু বলে ডাকতে শুরু করে। ওর দেখাদেখি বস্তির সমবয়সী ছেলেমেয়েরা এবং তারপর সব বয়সের সবার কাছে প্রণব সমাজবাবু।
কেটে গেছে বেশ কয়েকটি বছর। বৃন্দাকে আলাদা করে পড়াতে আসত প্রণব। পড়তে বসে তখন প্রণবের কাছে গল্প শুনতে শুনতে পাহাড়, সমুদ্র আকাশ নদী সব — সব যেন দেখতে পেত বৃন্দা। রাতে মায়ের পাশে শুয়ে ক্লাস নাইনে পড়া মেয়েটি কতবার সমুদ্রস্নানে গেছে! পাহাড়ে ওঠার সময় হাতটি শক্ত করে চেপে ধরেছে।
সেই সমাজবাবুর সাথে পায়েল দিদিকে দেখে প্রথম অভিমানের জন্ম। কিন্তু ওরা তো সবসময়ই একসাথে আসে যায়! সেদিন বৃন্দা তাহলে কী দেখেছিল! সুন্দরী পায়েল দিদিকে কেন হিংসে হয়েছিল?
ক’মাস পর ওদের বিয়ের নিমন্ত্রণ পেয়ে বৃন্দা লুকিয়ে লুকিয়ে অঝোরে কেঁদেছে। মা বারবার প্রশ্ন করেছে — তোর মুখখানা অমন শুকিয়ে গেছে কেন রে?
বস্তির সবাইকে ওরা নেমন্তন্ন করেছে, ভোজ খাইয়েছে। প্রচুর খাওয়া দাওয়ার মধ্যেও বৃন্দার চোখ দুটো জ্বালা করছিল।

কেটে গেছে দু’বছর। সময়ের সাথে সাথে বৃন্দা খুব সুন্দরী হয়ে উঠছিল। আশপাশের ছেলেরা বিরক্ত করতে শুরু করলো যথারীতি। ওর বাবা মা খুব ভয়ে ভয়ে থাকে সবসময়। সমাজবাবু এখন একটু কম আসে। তবুও একদিন এলে সব শুনে বলল –– দেখি কি করতে পারি!
কয়েকদিন পর সমাজবাবু একটি হোষ্টেলের সন্ধান এনেছে, যেখানে মোটামুটি ওদের সাধ্যের মধ্যে একটি আশ্রয় জুটে যাবে মেয়েটির। সেই আশ্রয়ের সন্ধানে সকালে বৃন্দার মা-বাবা সমাজবাবুর সাথে বেরিয়ে গেল, ফিরে এল নিস্প্রাণ হয়ে।
ভয়ানক দুর্ঘটনায় বাসটি দুমড়েমুচড়ে লোহা আর মাংসপিণ্ডে পরিণত হয়েছে। সমাজবাবু বেঁচে গেলেও প্রায় একবছর পর হাসপাতাল থেকে বাড়ি ফিরে বিছানায় শুয়ে থাকে।

বস্তির ঘরে অল্পবয়সী মেয়েটিকে রাতবিরেতে যন্ত্রণা করার লোকের অভাব তো ছিলই না এখন আরও বেড়ে গেল। প্রায় ছ মাস পর ওর মায়ের বান্ধবীরা আর বাবার সঙ্গীরা বস্তির বোকাসোকা ভালো মানুষ পরেশের সাথে মন্দিরে নিয়ে গিয়ে চার হাত এক করে দেয়। বৃন্দার প্রয়োজন ছিল একটা সুরক্ষিত জীবন। পেয়েছে। রং মিস্তিরি পরেশের ঘরে দশ বছর তো কেটে গেল। বৃন্দা ওর মায়ের মত আবার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছে। এই বস্তির জীবন থেকে ছেলেমেয়েকে মুক্ত করবে। ভাবতে ভাবতে চোখ জলে ভেসে যায়।

একদিন গা ঝাড়া দিয়ে, চোখের জল মুছে বৃন্দা পরেশকে স্বপ্ন দেখায়, ঠিক ওর বাবার মতই পরেশ উদ্দীপ্ত হয়।

তিনটি বাড়িতে কাজ নিল বৃন্দা, তার মধ্যে একটি পায়েল দিদির বাড়ি।

কয়েকটি মাসে বৃন্দা আবার মোহে জড়িয়ে পড়ছে ধীরে ধীরে। একদিন যখন স্পষ্ট হয়ে নিজের কাছে ধরা পড়লো, বৃন্দা চমকে ওঠে। আবার ভাবে এ তো তার জানা ছিল, তাহলে কেন এখানে এলো? তবে কী ইচ্ছে করে? তারপর থেকে মাঝেমাঝেই ভাবে ও’বাড়ির কাজ ছেড়ে দেবে। রোজ সমাজবাবুর সাথে দেখা হয় বলেই হয়তো এমন হচ্ছে।

আসলে ও কী কোনো দিন এর থেকে বেরোতে পেরেছে? হয়তো সমাজবাবুর জন্যই পরেশ এখনো তার কাছে পরপুরুষ হয়ে আছে! কিন্তু এ বাড়ি ছেড়ে যেতে পারবে তো?
সমাজবাবু বৃন্দার স্বপ্ন সাকারের অংশীদার হয়ে গেছে কখন যেন!
–– তোর ছেলেমেয়ে দুটোকে বড় হলে আমার কাছে পড়তে দিবি বৃন্দা?

এ যে কত বড় লোভ! বৃন্দা কিছু না বলে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে থাকে।

পায়েল দিদিমণির কাছে গেলে বৃন্দা অপরাধবোধে ভোগে। ওর জন্যই তো ওদের জীবনটা এমন হয়ে গেল। যদিও এটা বৃন্দার নিজস্ব ভাবনা। পায়েল দিদিকে দেখে মনে হয় হাঁপিয়ে উঠেছে। তাদের দুজনের মধ্যে স্বাভাবিক বাক্যালাপ কখনো দেখতে পায়নি বৃন্দা।
পায়েল যখন কর্মক্লান্ত হয়ে অফিস থেকে ঘরে ফেরে বৃন্দা খুব যত্ন করে এককাপ চা দেয়, এবার বৃন্দার ছুটি।
কিন্তু যেতে যেতে ভাবে তাদের দুজনের মুখে যে আকস্মিক ছায়াটা দেখতে পায় — তার জন্য কে দায়ী?…

সে নিজে ? নাকি বাবু ও দিদিমণির বন্ধু সায়ন দাদাবাবু? গতমাসে অফিসের কাজে মন্দারমণি কী দিদিমণি একা গিয়েছিল!