সুধাময়ের টয়লেট – সদানন্দ সিংহ

সুধাময়ের  টয়লেট – সদানন্দ সিংহ

সুধাময়ের টয়লেট        (ছোটোগল্প)

সদানন্দ সিংহ

দু হাজার সতের সালে সুধাময় অক্ষয় কুমারের অভিনীত হিন্দি সিনেমা “টয়লেট এক প্রেমকথা” দেখে ভেবেছিল, বাব্বা টয়লেট নিয়েও একটা সিনেমা হয়! কিন্তু সেটা ছিল তার চিন্তাভাবনার একটা সূত্র। আর সেই সূত্রটা তাকে ক্রমাগত প্যাঁচিয়ে ধরেছিল। শুধু তাকে নয়, তার বৌ এবং ছেলেমেয়েদেরও প্যাঁচিয়ে ধরেছিল।
তার বাড়িতে যে টয়লেট ছিল না তা নয়। অনেকদিন আগে মনে হয় বছর বিশেক আগে মিউনিসিপালিটি অফিস তাকে পাঁচশ টাকা ঋণ দিয়ে একটা সুলভ পায়খানা তৈরি করে দিয়েছিল। সেই সাবসিডাইজড পাঁচশ টাকা ঋণের সাহায্যে দুটো ছোট ট্যাঙ্কি সহ একটা ইন্ডিয়ান কমোড লাগিয়ে দিয়েছিল মিউনিসিপালিটি থেকে পাঠানো লোকেরা। তারপর অবশ্য তার দেয়াল-দরজা-ছাদ তাকেই নিজের খরচে লাগাতে হয়েছিল।
এই সুলভ টয়লেটের আগেও তাদের ছিল এক কাঁচা পায়খানা। সেটা বানিয়েছিলেন সুধাময়ের বাবা। সেটা আনহাইজিনিক ছিল। হাইজিনিক মেইনটেইন করতে সুধাময় সবসময় তৎপর। সে স্বাস্থ্য সচেতন এবং মিতব্যয়ী। আশ্চর্যের কথা, তার চারজনের সংসারের বৌ এবং এক ছেলে এক মেয়েও ঠিক তার মতোই মিতব্যয়ী এবং স্বাস্থ্য সচেতন। সচরাচর এমন দেখা যায় না। তাই সে নিজের সামান্য আয় থেকে জমিয়ে জমিয়ে পিতৃদত্ত সূত্রে প্রাপ্ত চৌচালা টিনের বড় ঘরটাকে সে ইটের দেয়াল তুলে দু কামরার পাকা ঘরে পরিণত করেছিল। ছাদটা অবশ্য আগের মত টিনেরই চাল রয়ে গেছিল।
তারপর বছরের পর বছর গড়িয়ে যাবার পর ছেলেমেয়েরাও হাইস্কুলে একদিন উঠল। আর তখন থেকেই তাদের সবার মনে একটা সুন্দর অ্যাটাচড টয়লেট-কাম-বাথরুমের স্বপ্ন তৈরি হয়ে গেল। ফলে এক অনামী ট্র্যান্সপোর্ট কোম্পানির হিসাবরক্ষক সুধাময়ের সামান্য আয় থেকেই পরিবারের সবার সাগ্রহে আবার এক সুন্দর অ্যাটাচড টয়লেট-কাম-বাথরুম তৈরির জন্য টাকা জমানো শুরু হয়ে গেল। এরজন্য অনান্য খরচের কাটছাট করতে হল পরিবারের সবার সম্মতিতে। পরিবারের সবার উৎসাহ এবং উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে বছরের পর বছর ধরে ধীরে ধীরে ফান্ড তৈরির চেষ্টা চলল।
অবশেষে একদিন এই প্রচেষ্টা সফল হল। সুধাময় পাড়ার এক রাজমিস্ত্রিকে ডেকে এনে কাজ শুরু করল। ক্লাস ইলেভেনে পড়া সুধাময়ের মেয়ে নেট ঘেটে ঘেটে এমন ডিজাইন বের করতে থাকে যেখানে খরচ বেশি হবে না কিন্তু দেখতে সুন্দর হবে। তবে সুধাময়ের বৌয়ের শুধু একটাই শর্ত যে কমোড ইন্ডিয়ান হতে হবে, ইউরোপিয়ান স্টাইলের হলে চলবে না।
শেষপর্যন্ত ঘরের দেয়াল ভেঙে দরজা বানিয়ে ছ বাই দশ ফুটের এক অ্যাটাচড বাথরূম-কাম-টয়লেট তৈরি করা হল ইন্ডিয়ান কমোড দিয়ে। ভেতরে বেসিন, শাওয়ার ফিট করে মাঝারি দামের টাইলস লাগিয়ে ঝকঝকে টকটকে করা হল। শুধু তার ছাদটা একচালা টিনের দেয়া হল। সেই একচালা টিনের চালের ওপরে একটা আনব্র্যান্ডেড কোম্পানির এক হাজার লিটারের ট্যাঙ্কি ফিট করা হল। সেই ট্যাঙ্কে তাদের নিজেদের টিউওয়েল থেকে জল তুলে ভরার জন্যে একটা হাফ ঘোড়া শক্তির টুলু কোম্পানির সেকেন্ড-হ্যান্ড পাম্প মেশিন ফিট করা হল। বাথরুমের টয়লেটের ময়লা পাইপে করে পুরনো সুলভের ট্যাঙ্কে ফেলার ব্যবস্থা করা হল। বাথরমের জলটা অবশ্য ঘরের বাইরে একটা গর্তে ফেলার ব্যবস্থা হল।

এখন সবাই খুব খুশি। কারণ-অকারণে সবাই বাথরুমে আসছে যাচ্ছে। সুধাময়ের বৌ তো ঘরের একগাদা ময়লা কাপড়চোপড় বাথরুমে কেঁচে ফেলল। কোনো পরিবারের মিলিত প্রয়াসের ফসল যে সত্যিই সুখের হয় সুধাময়রা প্রমাণিত করল।
সুধাময়ের মনে হয়, জীবনে খুশি এলেই সুখ আসে। আর কোনো কিছুতে আপশোশ না থাকলেই খুশি আসে। আর আপশোশও দূর হয় সব কিছু মেনে নিলেই। কিন্তু সেটা তো সবার জীবনে সবসময় সম্ভবও নয়। তাই সুধাময় অনেক কিছুই মেনে নিতে চেষ্টা করে যায়। কিন্তু খুশি কি আর চিরস্থায়ী হয় ?

হঠাৎ একদিন স্বাস্থ্যসচেতন সুধাময়ের পরিবারে এক অদ্ভুত ব্যাপার ঘটল। একদিন ভোরে সুধাময়ের চৌদ্দ বছরের ছেলে বাথরুমে ঢুকতে গিয়েই দেখে, তাদের বাথরম জুড়ে তাজা ইঁদুরের বিষ্ঠার ছড়াছড়ি। সে দৌড়ে এসে বাবাকে তা জানায়। সুধাময় তখন ঘুমিয়ে ছিল। উঠে এসে সুধাময় বাথরুমে ঢুকতে গিয়েই দেখে, দুর্গন্ধে বাথরুমে টেকা দায়, আর বাথরুমের সর্বত্র ইঁদুরের নরম তাজা বিষ্ঠার ছড়াছড়ি। এসব দেখে তার মেজাজ গরম হয়ে যায়, কিন্তু গালি দেবার মত ঠিক ভাষাও খুঁজে পায় না। ‘কুত্তার বাচ্চা’ ‘শুয়োর বাচ্চা’ ‘বালের দল’ ইত্যাদি শব্দগুলি ইঁদুরের চেয়ে অনেক উৎকৃষ্ট বলে তার মনে হয়। তাই ভাষাহীন সুধাময় রাগে গজ গজ করতে করতে জল ঢেলে ঢেলে তারপর হার্পিক দিয়ে তাদের বাথরুম ভালো করে পরিষ্কার করতে থাকে।
পরিষ্কার করা শেষ হলে সে বাথরুমের দেয়াল আর তার টিনের চালের মধ্যে যে ফাঁকফোকর গুলি ছিল তাতে ইট বসিয়ে বসিয়ে সমস্ত ফাঁকফোকর বন্ধ করে দেয় আর বলে, এবার তোরা কোন্ দিয়ে আসবি আয় এবার।

কিন্তু সুধাময়ের চ্যালেঞ্জটা ছিল নেহাতই জলো, তা কয়েকদিন পরেই প্রমাণিত হল। কয়েকদিন পর আবার আগের মতই অবস্থা, এক সকালে ওরা দেখে সারা বাথরুম জুড়ে দুর্গন্ধযুক্ত ইঁদুরের বিষ্ঠার ছড়াছড়ি। সুধাময় তো বেশ অবাক, বাথরুমের কোথাও কোনো ফাঁকফোকর নেই, অথচ কী করে এলো হারামজাদারা ! বাথরুমের ফ্লোরে জল পাস করার জন্য একটা গর্ত আছে বটে, কিন্তু সে গর্তটা তো স্টিলের নেট দিয়ে কাভার করা আছে, ওই স্টিলের নেটের ফাঁক দিয়ে একটা বাচ্চা ইঁদুরও গলে আসতে পারবে না। তাহলে কীভাবে এল হারামজাদারা ? সুধাময় ভেবে পায় না। আবার আগের মত বাথরুম পরিষ্কার করার পর এবার সে ঠিক করে রাত জেগে এবার পাহারা দেবে, দেখবে ইঁদুরগুলি ঠিক কোন্ দিক গিয়ে আসছে?
সেদিনই সে রাত জেগে পাহারা দিতে শুরু করল।
পর পর তিনদিন রাত জেগে পাহারা দেবার পরও দেখা গেল ইঁদুরের টিঁকিরও দেখা নেই। রাতে ঠিকমত না ঘুমোনোর ফলে সুধাময়ের শরীরটাও দুর্বল হতে থাকে। তিনদিন পর সুধাময় বাথরুমের বাইরে একটা চেয়ার এনে বসে চেয়ারেই ঘুমোতে শুরু করে। পঞ্চম দিন সুধাময় রাতে চেয়ারে ঘুমিয়ে পাহারা দেবার সময় সে বাথরুমের ভেতরে এক খটখট আওয়াজ পায়। সে তড়াক করে চেয়ার থেকে লাফিয়ে উঠে বাথরুমের দরজা খুলে ভেতরে ঢুকতেই দেখে, একটা ছোটখাটো বেড়াল সাইজের ধাড়ি ইঁদুর বাথরুমের এদিকসেদিক দৌড়ে হেগে-মুতে নোংরা করে চলেছে। সুধাময় ছ্যা ছ্যা করে ইঁদুরটার দিকে তেড়ে যেতেই ইঁদুরটা সুধাময়ের দিকে তাকিয়ে দাঁত-মুখ বের করে খিঁচিয়ে উঠল। সুধাময় একটু ভয় পেয়ে গেল। সে তাড়াতাড়ি বাইরে এসে একটা ছোট লাঠি নিয়ে বাথরুমের ভেতরে ঢুকতেই দেখে ইঁদুরটা তাকে দেখে কমোডের ফ্লাশ করার বক্সের ওপরে লাফিয়ে উঠে তার দিকে ভ্রূকুটি তুলে চেয়ে রইল, তারপর যেন বলল, গরীবের আবার কতো শখ ! বলেই ইঁদুরটা লাফ দিয়ে কমোডের জলে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবং সেই জলে ডুব দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেল।
সুধাময় হতভম্বের মত দাঁড়িয়ে রইল। আর ভাবতে লাগল, এখন সে কীভাবে মোকাবিলা করবে ?
তবে মোকাবিলা যে করতেই হবে তাকে। যে ভাবেই হোক, তাকে যে জিততেই হবে।